হেদায়াত

আল্লাহর সাথে সম্পর্কের বিকাশ সাধনের উপকরণ

প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কর্মপন্থা অনুসরণ করা মোটেই সহজসাধ্য নয়। এটা অত্যন্ত দুর্গম লক্ষ্যস্থল। এ পর্যন্ত পৌছুতে হলে বিশেষ শক্তি সামর্থের প্রয়োজন। নিম্নলিখিত উপায়ে এ শক্তি অর্জন করা সম্ভব।

এক . সালাত : শুধু ফরজ ও সুন্নত ই নয় , বরং সাধ্যানুযায়ী নফল সালাতও আদায় করা দরকার। কিন্ত নফল সালাত অত্যন্ত গোপনে আদায় করতে হবে, এবং আপনার মধ্যে নিষ্ঠার ভাব জাগ্রত হয়। নফল পড় বিশেষত তাহাজ্জুদ পড়ার কথা বাহির করতে থাকলে মানুষের মধ্যে এক প্রকার মারাত্মক। অন্যান্য নফল সাদকা এবং যিকর-আযকারের প্রচারের মধ্যেও অনুরূপ ক্ষতির আশাংকা রয়েছে।

দুইঃ আল্লাহর যিকর- জীবনের সকল অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলার যিকর করা উচিত। কিন্তু বিভিন্ন সুফী সম্প্রদায় এজন্য যে সমস্ত প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন কিংবা অপরের নিকট হতে গ্রহণ করেছেন,তা মোটেই ঠিক নয়। বরং এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) যে পন্থা অনুসরণ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছেন তাই হচ্ছে উত্তম ও সঠিক প্রক্রিয়া। হুজুরে আকরাম (স) এর অনুসৃত দোয়া, যিকর ইত্যাদির মধ্যে যতখানি সম্ভব আপনারা মুখস্ত করে নিবেন এবং শব্দ এ তার অর্থ উত্তমরূপে বুঝে নিবেন; অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে তা মাঝে মাঝে পড়তে থাকবেন। বস্তুত আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ রাখা তা মাঝে মাঝে পড়তহে থাকবেন। বস্তুত আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ রাখা এবং তাঁর প্রতি মনকে নিবিষ্ট রাখার জন্য এটা একটি বিশেষ কার্যকরী পন্থা।

তিনঃ সওম : শুধু পরয নয় ; বরং নফল সওমও প্রয়োজন। প্রত্যেক মাসে নিয়মিত তিনটি সওম রাখাই উত্তম। নফল সম্পর্ক এটাই বিশেষ উপযোগী ব্যবস্থা। এ সময়ে সওমের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ কুরআন শরীফে বর্ণিত তাকওয়া অর্জনের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করা উচিত।

চারঃ আল্লাহর পথে অর্থ খরচ করা :

এ ব্যাপারে শুধু ফরযই নয়; সাধ্যানুসারে নফলও আদায় করতে হবে। এ সম্পর্কে একটি কথা উত্তমরূপে বুঝে নেয়া দরকার যে, আপনি আল্লাহ তাআলার পথে কি পরিমাণ অর্থ-সম্পদ ব্যায় করেছেন,মূলত তার কোনো গুরুত্ব নেই; বরং আপনি আল্লাহর জন্য কতখানি কুরবানী করলেন তা-ই হচ্চে প্রকৃত আপনি আল্লাহর জন্য কতখানি কুরবানী করলেন তা-ই হচ্ছে প্রকৃত বিচার্য। একজন গরীব যদি অভূক্ত থেকে আল্লাহর রাস্তায় একটি পয়সাও ব্যয় করে তবে তার সেই পয়সাটি ধনী ব্যক্তির এক হাজার টাকা হতে উত্তম। ধনী ব্যক্তির এক হাজার টাকা হয়তো তার ভোগ সামগ্রীর দশমাংশ কিংবা বিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ প্রসংগে আরও একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার, আত্মার বিশুদ্ধিকরণের (তাযকিয়ায়ে নাফস) জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (স) যে সব পন্থা নির্দেশ করেছেন তার মধ্যে সাদকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর কার্যকরী ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি অনুশীলন করে দেখতে পারেন কোনো ব্যাপারে আপনার একমাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে আপনি অনুতপ্ত হৃদয়ে শুধু তাওবা করেই ক্ষান্ত হবেন। ঘটনাক্রমে পুনরায় যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে তখন আপনি তাওবা করার সাথে সাথে সাদকা করলে আত্মা অধিকতর বিশুদ্ধ হয়ে থাকে এবং অসৎ চিন্তার মুকাবিলায় আপনি অধিক সাফল্যের সাথে অগ্রসর হতে পারবেন।

পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ আমাদেরকে এ সহজ-সরল পন্থা অনুসরণেরই নির্দেশ দান করেছে। নিষ্ঠার সাথে এর অনুশীলন করলে কঠোর সাধনা, তপস্যা কিংবা মোরাকাবা ছাড়াই আপনি নিজ গৃহে স্ত্রী-পুত্রাদির সাথে অবস্থান করে এবং সমস্ত সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেই আল্লাহ তাআলার সাথে সংযোগ সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবেন।

আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক যাচাই করার উপায়

এখন একটি সমস্যার সমাধান হওয়া আবশ্যক। তা এই যে, আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সংযোগ-সম্পর্ক কতখানি স্থাপিত হয়েছে তা কিভাবে ও কি উপায়ে বুঝবো? আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে, না হ্রাস পাচ্ছে তা-ই বা আমরা কি উপায় বুঝবো? এর জবাবে আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে, এটা অনুভব করার জন্য স্বপ্নযোগে সু-সমাচার প্রাপ্ত অথাব কাশফ ও কারামত যাহির করার প্রয়োজন নেই; কিংবা অন্ধকার কুঠরীর মধ্যে বসে আলোক প্রাপ্তির অপেক্ষা করার কোনো আবশ্যক নেই। এ সম্পর্ক পরিমাপ করার ব্যবস্থা তো আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে করেই রেখেছেন। আপনি জাগ্রত জীবন ও কর্ম প্রচেষ্টা এবং দিনের বেলায়ই তা পরিমাপ করে দেখতে পারেন। নিজের জীব্ন ও কর্ম প্রচেষ্টা এব আপনার চিন্তা-ভাবধারা সম্পর্কে পর্যালোচনা করে দেখুন। নিজের হিসেব-নিকেশ আপনি নিজেই ঠিক করে দেখুনঃ আল্লাহ তাআলার সাথে যে চুক্তিতে আপনি আবদ্ধ রয়েছেন তা কতখানি পালন করেছেন। আল্লাহ তাআলার আমানাতসমূহ কি আপনি একজন আমানাতদার হিসেবে ভোগ-ব্যবহার করেছেন, না আপনার দ্বারা কোনো প্রকার খেয়ানত হচ্ছে? আপনার সময়, শ্রম, যোগ্যতা, প্রতিভা, ধন-সম্পদ ইত্যাদির কতটুকু আল্লাহ কাজে ব্যয়িত হচ্ছে আর কতটুকু অন্য পতে নিয়োজিত হচ্ছে? আপনার স্বার্থ কিংবা মনোভাবের উপর আঘাত লাগলে আপনি কতখানি বিরক্ত ও রাগান্বিত হন। তখনই বা আপনার ক্রোধ, মর্মপীড়া, মানসিক অশান্তি কতখানি হয়? এরূপ আরো অনেক প্রশ্ন আপনি নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন এবং এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবের উপর ভিত্তি করে আপনি প্রত্যেহ বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক ও যোগ আছে কিনা? থাকলে তা কতখানি এবং তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, না কমে যাচ্ছে? কাজেই স্বপ্নের সুসংবাদ, কাশফ-কারামত, কিংবা নূরের তাজাল্লী ইত্যাদি অতি-প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বনের চেষ্টা হতে আপনি বিরত থাকুন। প্রকৃতপক্ষে এ বস্তুজগতের প্রবঞ্চনামূলক বৈচিত্রের প্রলোভন ও ভয়ভীতির মুকাবিলায় সরল-সত্য পথে মযবুতভাবে কায়েম থাকা অপেক্ষা বড় কারামত আর কিছুই হতে পারে না। কুফরী, ফাসেকী ও গুমরাহীর ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে সত্যের আলো দেখতে পাওয়া এবং তা অনুসরণ করার চেয়ে কোনো বড় নূরের তপস্যা থাকতে পারে না। তার মুমিনগণ সবচেয়ে বড় সুসংবাদ লাভ করতে চাইলে-আল্লাহ তাআলাকে নিজের রব (প্রভু ও পালনকর্তা) হিসেবে স্বীকার করে এর উপর দৃঢ়ভাবে কায়েম থাকা এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলাই হচ্ছে এর একমাত্র উপায়।

যারা বলছে যে, আল্লাহ আমাদের রব অতপর তারা এ ব্যাপারে অটল-অবিচল থাকে, নিসন্দেহে তাদের উপর ফেরেশতা নাযিল হয় (এবং তাদেরকে বলে) তোমরা ভয় করো না, দু:খ করো না, বরং তোমাদের সাথে যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে তার সুসংবাদে আনন্দিত হও। সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৩০

আখেরাতের অগ্রাধিকার দান

আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক-সংযোগ স্থাপনের পর আমি আপনাদের আরো একটি কথা বলতে চাই। তা এই যে, আপনারা সকল অবস্থায়ই পার্থিব সুযোগ-সুবিধার চেয়ে আখেরাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করবেন ও নিজেদের কাজের মূলে আখেরাতের সাফল্য লাভের আকাঙ্ক্ষাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন।

কুরআন মজীদ আমাদেরকে বলছে, স্থায়ী অনন্ত জীবন ক্ষেত্র হচ্ছে আখেরাত। দুনিয়ার এ অস্থায়ী বাসস্থানে আমাদেরকে শুধু পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত সামান্য সাজ-সরঞ্জাম, সীমাবদ্ধ ক্ষমতা-ইখতিয়ার, সামান্য অবকাশ ও সুযোগোর সদ্ব্যবহার করে আমাদের মধ্যে হতে কতো লোক আল্লাহ তাআলার জান্নাতের স্থায়ী সাসিন্দা হওয়ার যোগ্য প্রতিপন্ন হতে পারে আমাদেরকে সেই পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু শিল্প,বাণিজ্য, কৃষি কাজ ও রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কতখানি কৃতিত্ব রয়েছে, রাস্তাঘাট ও বাড়ী নির্মাণে আমরা কতখানি পটু কিংবা এক শানদার সভ্যতা সংস্কৃতি গঠনে আমরা কতখানি সাফল্য লাভ করতে পারি, সেই বিষয়ে আমাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হবে না। বরং আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত আমানাতসমূহের ব্যাপারে আমরা তাঁর খিলাফতের দায়িত্ব পালনে কতখানি যোগ্যতার অধিকারী এটাই হচ্ছে আমাদের পরীক্ষার মূল বিষয়। আমরা কি এখানে বিদ্রোহী ও স্বাধীন হয়ে বসবাস করি, না তাঁর অনুগত বান্দাহ হিসেবে; আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর মর্জি পূরণ কির; আল্লাহর দুনিয়াকে তাঁর ইচ্ছানুসারে সুসজ্জিত করি, না বিভেদ-বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শয়তানী শক্তিগুলোর সামনে আত্মসমর্পণ করি, না তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকি, এটাই হলো আমাদের পরীক্ষা। জান্নাতে হযরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস হলো আমাদের পরীক্ষা হয়েছিলো মূলত তাও ছিলো ঠিক এ পরীক্ষা। আর আখেরাতের জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে মানব জাতির মধ্যে হতে যাদেরকে নির্বাচিত করা হবে তাও হবে। এ চূড়ান্ত প্রশ্নটির ভিত্তিতে। সুতরাং সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল মাপকাঠি এটা মোটেই নয় যে, কে রাজ সিংহাসনে বসে পরীক্ষা দিয়েছে, আর কে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে, কাউকে বিরাট সাম্রাজ্য দান করে পরীক্ষা করা হয়েছে আর কাউকে জীর্ণ কুটিরে বসিয়ে। পরীক্ষা কেন্দ্রের সাময়িক সুযোগ-সুবিধা যেমন সাফল্যের কোনো প্রমাণ নয়, তেমনি তা কোনো অসুবিধা ও ব্যর্থতার ও লক্ষণ নয়। আসল কামিয়াবী-যেদিকে এ পরীক্ষা কেন্দ্রের যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন আমাদের সাজ-সরঞ্জাম যাই হোক না কেন, আমরা যেন নিজেদেরকে আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দাহ এবং তাঁর মর্জির সঠিক তাবেদার সাব্যস্ত করতে পারি। একমাত্র এভাবেই আমরা আখেরাতে আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দাহদের নির্দিষ্ট মর্যাদা লাভে সক্ষম হবো।