বন্ধগণ! এটাই হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু এটা এমন একটি বিষয় যে, একবার মাত্র জানলে, বুঝলে ও স্বীকার করলেই এ কাজটি সম্পন্ন হতে পারে না,বরং সদা-সর্বদা স্মরণ রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও যত্ন করতে নয়। নতুবা এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যে, আখেরাতকে অস্বীকার না করেও আমরা হয়তো আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসীদের ন্যায় নিছক পার্থিব কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বো। কেননা পরকাল হচ্ছে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অবস্থিত, শুধু মৃত্যুর পরেই তা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হবে। পার্থিব জীবনে আমরা শুধু চিন্তা কল্পনা-শক্তির সাহায্যেই এর ভালো-মন্দ ফলাফল অনুভব করতে পারি। পক্ষান্তরে এ দুনিয়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, এটা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব এবং ভালো-মন্দ প্রত্যকটি বিষয় সম্পর্কে আমরা সর্বক্ষণ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এর বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনবলী ও পরিণতিকে অনেক সময়ে চূড়ান্ত বলে আমাদের মনে ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আখেরাত সম্পর্কিত কোনো কাজ হলে সেই বিষয় শুধু আমাদের অন্তরের এক কোণায় লুক্কায়িত বিবেক সামান্য কিছুটা তিক্ততা অনুভব করি মাত্র, অবশ্য যদি তা সজীব থাকে। কিন্ত আমাদের পার্থিব কোনো স্বার্থ বিনষ্ট হলে আমাদের প্রতিটি লোমকূপও তার জন্য ব্যথা অনুভব করে। আমাদের স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নির্বিশেষে সমাজের সাধারণ লোকজন সকলেই তা অনুভব করতে পারে। অনুরপভাবে আখেরাত যদি সাফল্য হয়, তবে আমাদের অন্তরের একটি নিভৃত কোণ ছাড়া আমাদের গাফলতির দরুন সম্পূর্ণরূপে নিষ্পন্দ হয়ে গিয়ে না থাকে। কিন্তু আমাদের পার্থিব সাফল্যকে আমাদের গোটা সত্ত্বা ও ইন্দ্রিয়নিচয় অনায়সে অনুভব করতে পারে এবং আমাদের সমগ্র পরিবেশ তা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এ কারণেই একটি ধারণা বা বিশ্বাস হিসেবে আখেরাতকে স্বীকার করা হয়তো কোনো কঠিন কাজ নয়; কিন্তু গোটা চিন্তাধারা, দৈনতিক চরিত্র ও কর্মজীবনের সমগ্র ব্যবস্থাপনার বুনিয়াদ হিসেবে এটাকে গ্রহণ করে তদানুযায়ী আজীবন কাজ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। মুখে দুনিয়া কিছু নয় বলা যতই সহজ হোক না কেন; কিন্তু অন্তর হতে এর বাসনা কামনা এবং চিন্তাধারা হতে এর প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদূরিত করা মোটেই সহজ নয়। এ অবস্থায় উপনীত হবার জন্য বহু চেষ্টা-যত্ন আবশ্যক। আর অবিশ্রান্ত চেষ্টার ফলেই তা স্থায়ী হতে পারে।
চলমান পেজের সূচীপত্র
আখেরাতের চিন্তার লালন
আপনারা হয়তো জিজ্ঞেস করবেন যে, আমরা সেই জন্য কিরূপ চেষ্টা করতে পারি? এবং এ জন্য আমরা কোন কোন জিনিসের সাহায্য গ্রহণ করবো? এর জবাবে আমি বলতে চাই যে, এরও দুটি উপায় রয়েছে : একটি চিন্তাও আদর্শমূলক। অপরটি হলো বাস্তব কর্মপন্থা।
চিন্তা ও আদর্শিক অনুশীলনের পন্থা এই যে, আপনি শুধু আমি আখেরাতের প্রতি ঈমান আনলাম। একথাটির মুখে উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হবেন না। বরং অর্থ বুঝে কালামে পাক অধ্যয়নের অভ্যাস করবেন। এর ফলে আপনার বিশ্বাসের চোখে ক্রমাগত পার্থিব দুনিয়ার এ আবরণের অন্তরালে অবস্থিত আখেরাত অত্যন্ত স্পষ্টরূপে ধরা দেবে। কারণ কালামে পাকে সম্ভবত এমন একটি পৃষ্ঠাও নেই যেখানে কোনো না কোনোরূপে আখেরাতের উল্লখ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন স্থানে আখেরাতের এমন বিস্তারিত নকশা দেখতে পাবেন যে, আপনার মনে হবে, যেন কেউ চাক্ষুসভাবে দেখার পরেই এটা বর্ণনা করেছে। এমনকি অনেক স্থানে এ চিত্র এমন সুন্দরভাবে ফুটে উছেছে বলে অনুভব করতে থাকে তখন মনে হয় যেন, এজড় জগতের হাল্কা পর্দাখানা একটু একটু সরে গেলেই বর্ণিত ঘটনবলী প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হতো। সুতরাং নিয়মিত কুরআন শরীফ বুঝে তেলাওয়াত করতে থাকলে মানুষের মনে ক্রমশ সর্বদা স্মরণ রাখতে পারবে যে, তার স্থায়ী হতে পারবে। তখন সে কথাটি সর্বদা স্মরণ রাখতে পারবে যে, তার স্থায়ী বাসভূমির সন্ধান লাভ মৃত্যুর পরই সম্ভব এবং দুনিয়ার এ অস্থায়ী জীবনেই এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
হাদীস অধ্যয়ন করলে এ মনোভাব আরও বলবত ও মযবুত হয়। কারণ হাদীস শরীফে পরলোক সম্পর্কে প্রায় চাক্ষুস অভিজ্ঞতার মতোই বিবরণ সন্নিবিষ্ট রয়েছে। এছাড়া হযরত নবী করীম (স) স্বয়ং এবং তাঁর সাহাবায়ে কিরাম সর্বদা আখেরাত সম্পর্কে কতখানি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন তা থেকে তা জানা যায়। কবর যিয়ারত করলে এ বিষয়ে আরো সাহায্য লাভ করা যায়। নবী করীম (স) কবর যিয়ারত উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বলেছেন যে, মানুষ এর সাহায্য নিজের মৃত্যুর স্মরণ করতে সক্ষম হয় এবং লোভ-লালসায় পরিপূর্ণ এ দুনিয়ার বুকে অবস্থান করেও একথা তার মনে জাগরুক রাখতে পারে যে, সকল মানুষ যেখানে গিয়েছে এবং প্রত্যহ অসংখ্য লোক যেখানে পৌঁছাছে তাকেও একদিন সেখানে এবং প্রত্যহ অসংখ্য লোক যেখানে পৌঁছেছে তাকেও একদিন সেখানে যেতে হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, বর্তমানে গুমরাহ লোকেরা যে সমস্ত মাযারকে মকছুদ হাসিল কিংবা মুশকিল আসানের কেন্দ্র হিসেবে খাড়া করেছে,তার পরিবর্তে সাধারণ গরীব লোকদের কবরস্থান এদিক দিয়ে অনেক বেশী উপকারী। অথবা এ উদ্দেশ্যে প্রাচীন রাজা-বাদশাহদের শূন্য ও পাহারাদার বিবর্জিত বিরাটকার কবরগুলো পরিদর্শন করা চলে।
অতএব বাস্তব কর্মপন্থার কথায় আসুন। এ পার্থিব জীবনে আপনাকে ঘর-সংসার, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, নিজের শহর ও দেশের ব্যবস্থাপনা, আদান-প্রদান এবং অর্থনৈতিক কাজ-কারবার এক কথায় জীবনের প্রতি পদেই আপনাকে উভয় সংকটের সম্মুখীন হতে হয় এবং একদিকে আখেরাত বিশ্বাস আর অপরদিকে দুনিয়াদারী আপনাকে হাতছানি দেয়। এমতাবস্থায় আপনাকে প্রথমোক্ত পথেই অগ্রসর হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যদি নফসের দুর্বলতা কিংবা আলস্যবশত আপনি কখনো ভিন্ন পথেই অগ্রসর হন, তবে সেই কথা স্মরণ হওয়ার সাথে সাথেই আপনি পথ পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন, ভুল পথে আপনি অনেক দূল অগ্রসর হলেও কোনো কথা নেই। তাছাড়া আপনি মাঝে মাঝে নিজের হিসেব-নিকেশ করে দেখবেন, কোন কোন ক্ষেত্রে দুনিয়া আপনাকে নিজের দিকে টানতে সমর্থ হয়েছে আর আপনিইবা কতবার আখেরাতের দিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছেন। এ পর্যালোচনার দ্বারাই আপনি কতখানি মযবুত হয়েছে আর কতখানি আপনাকে অভাব পূরণ করতে হবে। যতখানি অভাব দেখেবেন তা নিজেই পূরণের চেষ্টা করবেন। এ ব্যাপারে বাহির থেকে কোনো প্রকার সাহায্য লাভ করতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম দুনিয়াদার লোকদের সংশ্রব পরিত্যাগ করতে হবে এবং আপনার জানা মতে যাঁরা দুনিয়ার তুলনায় আখারতেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, এধরনের নেক লোকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু একটি কথা আপনাকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, আপনার নিজের চেষ্টা ছাড়া কোনো গুণের হ্রাস-বৃদ্ধি করার বাস্তব কোনো পন্থা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কিংবা নিজের মধ্যে মূল উপাদান পর্যন্ত বর্তমান নেই, এমন গুণ সৃষ্টিও করাও সম্ভব নয়।
অযথা অহমিকা বর্জন
তৃতীয় যে বিষয়ে আমি আপনাদেরকে উপদেশ দিতে চাই তা এই যে, গত কয়েক বছর যাবৎ ক্রমাগত চেষ্টার ফলে আপনাদের ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিকভাবে কখনো দেখা না দেয়। আপনারা যেন ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিকভাবে কখনো এরূপ ভুল ধারণা পোষণ না করেন যে, আমরা এখন পূর্ণত্ব লাভ করেছি, যা কিছু যোগ্যতা অর্জন করা দরকার ছিলো, তার সবই আমরা হাসিল করে ফেলেছি। সুতরাং এখন আর আমাদের কাম্য এমন কোনো বস্তু নেই, যেজন্য আমাদেরকে আরো চেষ্টা-যত্ন করতে হবে। আমাকে এবং জামায়াতের অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণকে অনেক সময়ই একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বেশ কিছুদিন যাবত কিছু সংখ্যক লোক জামায়াতে ইসলামীর-প্রকৃতপক্ষে জামায়াত পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের মূল্য হ্রাস করার মতলবে প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, এ জামায়াত নিছক একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার আত্মশুদ্ধি বা আধ্যাত্মিকতার কোনো নাম-নিশানা নেই। এর কর্মীদের মধ্যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক এবং আখেরাত চিন্তার অভাব রয়েছে। এদলের পরিচালক নিজে যেমন কোনো পীরের মুরীদ নয়, তেমনি তিনি কোনো খানকা হতেও তাকওয়া পহহেযগারী বা ইহসান-কামালিয়াতের ট্রেনিং-এর সুযোগ পাবেন, তারও কোনো সম্ভবনা নেই। এধরনের প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং আন্দোলনের প্রতি আগ্রহশীল লোকদের মনে জামায়াতের প্রতি বীতশ্রদ্ধার সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে পুনরায় এমন আস্তনায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করা, যেখানে কুফরীর আশ্রয়ে থেকে ইসলামের আংশিক খেদমত করাকেই আজ পর্যন্ত এক বিরাট কীর্তীরূপে গণ্য করা হচ্ছে, যেখানে দীন ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ী করার কোনো কল্পনারই অস্তিত্ব নেই। বরং যেখানে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনার কথা উত্থাপন করার পার নানাভাবে এটাকে এক অধর্মীয় প্রস্তাব বলে প্রমাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে এবং এরূপ প্রস্তাবকে এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে, কুফর ও ফাসেকীর পরিবর্তে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পুন: প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য বিস্তারের কল্পনাকে একটি নিতান্ত বৈষায়িক চিন্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে। একারণেই আমাদরকে বাধ্য হয়ে খানকার আত্মশুদ্ধি ও ইসলামী আত্মশুদ্ধির মধ্যকার পার্থক্য উদঘাটন করতে হয় এবং প্রকৃত তাকওয়া পরহেযগারী ও ইহসানের সঠিক পরিচয় যা ইসলামের কাম্য-পরিষ্কার করে বর্ণনা করতে হয় এবং ধর্ম শিল্পে লোকগণ যে সনাতন ও কামালিয়াতের শিক্ষা বা ট্রেনিং দিচ্ছেন, তার সাথে ইসলামের পার্থক্য কতটুকু তা বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেই সাথে জামায়াতে ইসলামী কর্তক অনুসৃত সংশোধন ও ট্রেনিং পদ্ধতি এবং এর ফলাফলও আমাদেরকে প্রকাশ করতে হয়, যেন ইসলাম সম্পর্কে সঠিক চেতনা সম্পন্ন যে কোনো লোক একথা বুঝতে পারেন যে, জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও কর্মনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পর প্রাথমিক ভাবধারা সৃষ্টি হতে শুরু করে, তা জীবন ব্যাপী আত্মশুদ্ধির ট্রেনিং লাভের পরও এমনকি ট্রেনিংদাতাদের মধ্যেও দেখা যায় না।
এ সকল কথা আমরা আমাদের সমালোচকদের বে-ইসাফীর কারণেই বলতে বাধ্য হচ্ছি। নিছক আত্মরক্ষার জন্য নয়, বরং ইসলামী আন্দোলনের নিরাপত্তার জন্য এটা আমাদের বলতে হয়, কিন্তু এ সমস্ত কথার ফলে আমাদের সহকর্মীদের মনে যেন কোনো প্রকার গর্ব-অহংকার কিংবা নিজেদের কামালিয়াত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা না জন্মে, সে জন্য আমরা আল্লাহর নিকট পানাহ চাচ্ছি। আল্লাহ না করুন, আমাদের মধ্যে যদি কোনো প্রকার মিথ্যা অহমিকা দেখা দেয়, তবে এ পর্যন্ত আমরা যতটুকু লাভ করেছি তাও হয়তো হারিয়ে বসবো।
এ বিপদ হতে আত্মরক্ষার জন্যই আমি আপনাদেরকে তিনটি নিগুঢ় সত্য ভালো করে বুঝে নিতে এবং তা কখনো বিস্মৃত না হতে অনুরোধ করি।