৫১. আরও একটি মনগড়া ব্যাখ্যা
অভিযোগঃ ষষ্ঠ যে আয়াত আপনি পেশ করেছেন তা হলোঃ
(আরবী*****************************************)
“আর আল্লাহ যখন তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, দুই দলের (অর্থাৎ ব্যবসায়ী কাফেলা এবং কুরাইশ সৈন্যবাহিনী) মধ্যে একটি তোমাদের করায়ত্ব হবে এবং তোমরা চাচ্ছিলে যে, শক্তিহীন দলটি (ব্যবসায়ী কাফেলা) তোমাদের হস্তগত হোক। অথচ আল্লাহ তাঁর কলেমার দ্বারা সত্যকে সত্য প্রমাণ করে দেখাতে এবং কাফেরদের শক্তি চূর্ণ করে দিতে চাচ্ছিলেন”-(সূরা আনফালঃ ৭)।
অতপর আপনি জিজ্ঞেস করছেন, “আপনি কি সমগ্র কুরআন মজীদে একটি আয়াত দেখাতে পারবেন যার মধ্যে আল্লাহ তাআলার এই ওয়াদার কথা ব্যক্ত হয়েছিলঃ হে লোকেরা যারা মদীনা থেকে বদরের দিকে যাচ্ছ আমরা দুই দলের মধ্য থেকে একটি দল তোমাদের আয়ত্বে এনে দেব?”
নীতিগতভাবে এটা ছিল সেই পরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি যার ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জামাআতকে বলেছিলেন যে, তাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফতের পদে আসীন করা হবে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল জয়যুক্ত থাকবেন, বিজয় ও অবরোধ আল্লাহর দলভুক্তদের অনুকূলে থাকবে, মুমিনগণ সমুন্নত থাকবে। আল্লাহ কখনও মুমিনদের উপর কাফেরদের বিজয়ী করবেন না। মুজাহিদগণ বিরুদ্ধবাদীদের ধনসম্পদ ও মালিকানার অধিকারী হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই বিশেষ ঘটনায় এই “ওয়াদা” এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন করে –যার ব্যাখ্যা কুরআন করীম এভাবে করেছে যে,
(আরবী******************************) –অর্থাৎ তাদের মধ্যে একটি দল ছিল অস্ত্রহীন এবং তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া নিশ্চিত মনে হচ্ছিল।
আমি ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে বলেছি যে, যেসব কথা প্রাকৃতিক বিধানের সাথে সামঞ্জস্যশীল আল্লাহ তাআলা তাও নিজের সাথে সম্পৃক্ত করেন। আল্লাহর উপরোক্ত দুটি প্রতিশ্রুতিও এই শ্রেণীভুক্ত ছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যে, আলোচ্য দুটি দলের মধ্যে একটির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ ছিল নিশ্চিত।
উত্তরঃ এখানেও পূর্বাপর সম্পর্ক এবং স্থান-কাল উপেক্ষা করে নিপুণতা প্রদর্শনের চেষ্টা করা হয়েছে। একটি বিশেষ অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা চলছে। একদিকে কাফের সৈন্যবআহিনী অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্রে সজ্জিত হয়ে মক্কা থেকে রওনা হয়ে আসছে এবং তাদের সামরিক শক্তি ছিল মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশী। অপরদিকে সিরিয়া থেকে কুরাইশ ব্যবসায়ী কাফেলা প্রত্যাবর্তন করছিল, যাদের সাথে ছিল প্রচুর পণ্য এবং নামমাত্র সামরিক শক্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন, এ স্থানে আমরা মুসলমানদের প্রতিশ্রুতি দিলাম যে দুটি দলের মধ্যে যে কোন একটির বিরুদ্ধে তোমরা জয়যুক্ত হবেই। এটা ছিল পরিস্কার ও সুস্পষ্ট একটি প্রতিশ্রুতি, যা দুটি নির্দিষ্ট জিনিসের মধ্যে যে কোন একটি সম্পর্কে প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু ডকটর সাহেব তার দ্বিবিধ ব্যাক্যা দান করেন। একটি এই যে, উক্ত প্রতিশ্রুতি দ্বারা পৃথিবীতে শাসকের পদে আসীন করা এবং পরিপূর্ণ প্রতিপত্তির স্বাভাবিক ওয়াদা বুঝানো হয়েছে। কিন্তু যদি তাই বুঝানো হত তবে উভয় দলের উপর বিজয়ী হওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকত, দুটির মধ্যে একটির উপর নয়। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা তিনি এই করেন যে, সেই সময়ের পরিস্থিতি বলছে যে, দুটি দলের মধ্যে একটির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ ছিল নিশ্চিত এবং পরিস্থিতির এই নিদর্শনকে আল্লাহ তাআলা নিজের প্রতিশ্রুতি সাব্যস্ত করেছেন। অথচ বদরের যুদ্ধে বিজয়ের পূর্বে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তা বলছে যে, ব্যবসায়ী কাফেলার উপর নিয়ন্ত্রণলাভ তো নিশ্চিত, কিন্তু কুরাইশ বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। আল্লাহ তাআলা আলোচ্য আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে স্বয়ং বলছেন, কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাওয়াকালীন মুসলমানদের যে অবস্থা হয়েছিল তা এই যে (আরবী**************************) “তাদের যেন চাক্ষুস মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছিল”।–(সূরা আনফালঃ ৬)।
এটা কি সেই পরিস্থিতি যা বলছিল যে, কুরাইশ বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কাফেলার উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের মতই নিশ্চিত? এ ধরনের নিপুণতার মাধ্যমে প্রতিভাত হয় যে, হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী এই দলটি কুরআন থেকে নিজেদের মতবাদ গড়ে না, বরং কুরআনের উপর তাদের কল্পিত মতবাদ চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে, কুরআনের বাক্যসমূহ তাদের মতবাদকে যতই প্রত্যাখ্যান করুক না কেন।
৫২. উল্টাপাল্টাপ জবাব
অভিযোগঃ সবশেষে আপনি যে আয়াত পেশ করেছেন তা এই যে,
(আরবী*************************************************)
“তোমরা যখন তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলে তখন তিনি তোমাদের প্রার্থনার জবাবে বলেছিলে, আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য অব্যাহতভাবে এক হাজার ফেরেশতা পাঠাব”-(সূরা আনফালঃ ৯)।
অতপর আপনি জিজ্ঞেস করেছেন, “আপনি কি বলতে পারেন যে, মুসলমানদের সাহায্য প্রার্থনার এই জওয়াব কুরআনের কোন আয়াতে নাযিল হয়েছিল?”
আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেষ করতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা যখন বললেন- (আরবী***********) (“আমি প্রত্যেক আবেদনকারীর আবেদনে সাড়া দিয়ে থাকি যখন সে আমাকে ডাকে”-(সূরা বাকারাঃ ১৮৬); তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার জওয়াব কোন লিখিত দলীলের মাধ্যমে পাওয়া যায়? যে পন্থায় প্রত্যেক প্রার্থনাকারী আল্লহার পক্ষ থেকে তার প্রার্থনার জওয়াব পেয়ে থাকে ঠিক সেই পন্থায় ঈমানদারদের জামাআত তাদের প্রার্থনার জওয়াব পেয়েছিল। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতিটি কথা কাগজে মুদ্রিত পেতে চায়, প্রার্থনার জওয়াব তাদের নজরে কিভাবে পতিত হবে?
উত্তরঃ প্রশ্ন কি আর তার উত্তর কি! আমার প্রশ্ন ছিল, আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের প্রার্থনার জবাবে এক হাজার ফেরেশতা পাঠানোর যে সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতির উল্লেখ এ আয়াতে করেছেন তা কুরআনের কোন আয়াতে নাযিল হয়েছিল। ডকটর সাহেব উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলে, প্রত্যেক প্রার্থনাকারী যে পন্থায় তার প্রার্থনার জবাব আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয় ঠিক সেই পন্থায় বদরের প্রান্তরে মুসলমানগণও তাদের প্রার্থনার জবাব লাভ করেছিল। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রত্যেক প্রার্থনাকারীই কি আল্লাহর পক্ষ থেকে এরূপ সুস্পষ্ট জওয়াব পেয়ে থাকে যে, তোমার সাহায্যের জন্য এত এত হাজার ফেরেশতা পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে? সুনির্দিষ্ট সংখ্যার উল্লেখপূর্বক পরিস্কার ভাষায় এই জওয়াবের কথাও কি আল্লাহর কিতাবে লিখিত পাওয়া যায়?
এখানে আরও একটি অদ্ভুত ও চিত্তাকর্ষক কথাও লক্ষণীয় যে, আমাদের উপর “আল্লাহর প্রতিটি কথা কাগজে লিখিত পেতে চাই” এরূপ অপবাদ এমন লোকেরা আরোপ করছে যারা জেদ ধরে বসে আছে যে, যেসব ওহী লিখিত আকারে আছে আমরা শুধু তাই মানব।
৫৩. অক্ষরশূন্য ওহীর ধরন ও বৈশিষ্ট্য
অভিযোগঃ আপনি সামনে অগ্রসর হয়ে লিখেছেন, আপনি সামনে অগ্রসর হয়ে লিখেছেন, “ওহী অপরিহার্যরূপে শব্দসমষ্টির আকারেই হয় না, তা একটি ধারণার আকারেও হতে পারে যা অন্তরে ঢেলে দেয়া হয়”। আপনার দাবী তো সবজান্তার, অথচ এতটুকুও জানা নাই যে, কারো অন্তরে একটি ধারণার উদয় হবে এবং তার বাহন ভাষা হবে না এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কোন ধারণাই ভাষা ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না, আর না কোন ভাষা ধারণা ছাড়া অস্তিত্ব লাভ করতে পারে। বিশেষজ্ঞ আলেমদের নিটক জিজ্ঞেস করুন, “ভাষাশূন্য ওহীর” “অর্থহীন সমাচার”-এর তাৎপর্য কি?
উত্তরঃ হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীদের জানা নাই যে, ধারণা ও শব্দের রূপায়ন উভয়ই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যেও স্বতন্ত্র এবং তা একত্রেও সংঘটিত হয় না। মানবীয় মেধা কোন ধারণাকে ভাষায় রূপ দিতে এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের একভাগই সময় নিক না কেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে ধারণার উদয় হওয়া এবং মন তাকে ভাষায় রূপ দিতে সময়ের ক্রমধারা অবশ্যই রয়েছে। কোন ব্যক্তি যদি দাবী করে যে, মানুষের মনে অবশ্যই ভাষার আকারেই ধারণার উদয় হয় তবে সে একথার কি ব্যাখ্যা দিবে যে, একই ধারণা ইংরেজের মনে ইংরেজী ভাষায়, আরবদের মনে আরবী ভাষায় এবং আমাদের মনে আমাদের ভাষায় কেন উদিত হয়? অতএব এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মানব মনে প্রথমে একটি ধাপরণা এককভাবে উদিত হয়, অতপর মেধাশক্তি তাকে নিজের ভাষায় ব্যক্ত করে। একাজটি খুব দ্রুততার সাথে সংঘটিত হয়, কিন্তু যেসব লোকের কখনও চিন্তা করে বলা অথবা লেখার সুযোগ হয়েছে তারা জানে যে, কখনও কখনও মনের মধ্যে একটি ধারণা ঘুরপাক খেতে থাকে এবং তা ভাষায় ব্যক্ত করতে মেধাশক্তির যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করতে হয়। তাই একথা কেবলমাত্র এক আনাড়ীই বলতে পারে যে, ধারণা বাক্যের আকারেই উদিত হয় অথবা ধারণা ও ভাষা অপরিহার্যরূপে একসাথেই উপস্থিত হয়। ওহীর বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে একটি এই যে, আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে কেবলমাত্র একটি ধারণা নবীর ওহী গায়র মাতলূ হওয়ার কারণ এই যে, এর ভাষা না আল্লাহর তরফ থেকে প্রদান করা হয়, আর না নবী তা বিশেষ শব্দসমষ্টির মাধ্যমে লোকদের পর্যন্ত পৌঁছাতে আদিষ্ট হন।
৫৪. ওহী মাতলূ ও ওহী গায়র মাতলুর মধ্যে পার্থক্য
অভিযোগঃ আপনি বলেছেন, “আরবী ভাষায় ওহী শব্দের অর্ত সূক্ষ্ম ইংগীত”। ওহীর আভিধানিক অর্থ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন নেই, এর পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কেই প্রশ্ন যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম প্রাপ্ত হতেন। এই ওহীর শুধু “সূক্ষ্ম ইংগীত”-ই কি আল্লাহর পক্ষ থেকে হত না এর শব্দ সমষ্টিও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হত? শুধু ইশারাই যদি হত তবে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কুরআনের ভাষা ছিল স্বয়ং নবী (সা)-এর নিজস্ব।
উত্তরঃ এর জওয়াব ৩৫ নম্বর আলোচনায় বর্তমান রয়েছে, যার এক-দুইটি অংশ নিয়ে ডকটর সাহেব এই বিতর্কের অবতারণা করেছেন। কুরআন করীমের শব্দসমষ্টি ও তার বিষয়বস্তু উভয়ই আল্লাহ তাআলার এবং মহানবী (সা)-এর উপর তা এজন্য নাযিল করা হয়েছিল যে, তিনি নাযিলকৃত ভাষায় তা লোকদের নিকট পৌঁছাবেন। তাই এটাকে ওহী মাতলূ বলা হয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর ওহী অর্থাৎ ওহী গায়র মাতলূ তার ধরন, বৈশিষ্ট্য, অবস্থা ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে পূর্বোক্ত ওহী হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তা রসূলুল্লাহ (সা)-কে পথনির্দেশ দেয়ার জন্য আসত এবং লোকদের নিকট তা আল্লাহ তাআলার ভাষায় নয়, বরং মহানবী (সা)-এর সিদ্ধান্ত, বক্তব্য ও কর্মের আকারে পৌঁছত। যদি কোন ব্যক্তি স্বীকার করে নেয় যে, মহানবী (সা)-এর নিকট প্রথমোক্ত শ্রেণীর ওহী আসতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত তার এটা স্বীকার করতে কি প্রতিবন্ধকতা আছে যে, সেই নবীর নিকট শেষোক্ত শ্রেণীর ওহীও আসতে পারে? কুরআনের মুজিযাসুলভ বাণী আমাদের যদি এই নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে যে, এটা আল্লাহ পাকেরই কালাম হতে পারে, তবে কি রসূলুল্লাহ (সা)-এর মুজিযাসুলভ জীবন এবং তাঁর মুজিযাপূর্ণ কার্যাবলী আমাদের এই নিশ্চয়তা দেয় না যে, এটাও আল্লাহ তাআলার পথনির্দেশেরই ফল?
৫৫. প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত অস্বীকার করা রসূলুল্লাহ (সা) –এর আনুগত্য অস্বীকার করার নামান্তর
অভিযোগঃ আপনি বলেছেন, “হাদীসের বর্তমান ভান্ডারের মধ্য থেকে যেসব সুন্নাতের প্রমাণ পাওয়া যায় তা দুটি বৃহৎ শ্রেণীভুক্ত। এক প্রকারের সুন্নাত যার সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে শুরু থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত উম্মাত ঐক্যমত প্রকাশ করে আসছে। অন্য কথায় এগুলো হচ্ছে মুতাওয়াতির সুন্নাত। এর উপর উম্মাতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কোন একটি সুন্নাত মান্য করতে যে কোন ব্যক্তিই অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে সে ঠিক সেইভাবে ইসলামের গন্ডী থেকে বের হয়ে যায়, যেভাবে কোন ব্যক্তি কুরআনের কোন আয়াত অস্বীকার করলে ইসলামের গন্ডী বহির্ভূত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় প্রকারের সুন্নাত, যার প্রামাণ্যতা সম্পর্কে মতভেদ আছে অথবা হতে পারে। এই প্রকারের সুন্নাতের একটি সম্পর্কে যদি কোন ব্যক্তি বলে যে, তার তথ্যানুসন্ধান ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে অমুক সুন্নাত প্রামাণ্য নয়, তাই সে তা মানতে বাধ্য নয়, তবে তার এই কথায় তার ঈমানের উপর কোন আঘাত আসবে না”।
আপনি কি বলবেন, আল্লাহ তাআলা কোথায় একথা বলেছেন, যে ব্যক্তি এই মুতাওয়াতির সুন্নাত মানতে অস্বীকৃতি জানাবে, যার উপর উম্মাতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে কাফের হয়ে যাবে? আর যে ব্যক্তি বিতর্কিত সুন্নাত অস্বীকার করবে তার ঈমানের কোন ক্ষতি হবে না?
উত্তরঃ আল্লাহ তাআলা রসূলুল্লাহ (সা)-এর আনুগত্য ও অনুবর্তন করা বা না করাকে ইসলাম ও কুফরের মধ্যেকার সীমারেখা সাব্যস্ত করেছেন। অতএব যেখানে নিশ্চিতভাবে জানা যাবে যে, মহানবী (স) অমুক কাজের নির্দেশ দিয়েছেন অথবা অমুক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন অথবা অমুক বিষয়ে এই পথনির্দেশ দিয়েছেন, সেক্ষেত্রে আনুগত্য প্রত্যাহার অবশ্যম্ভাবীরূপে কুফরীর কারণ হবে। কিন্তু যেখানে মহানবী (সা)-এর কোন নির্দেশের সপক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া না যায়, সেখানে নিম্নতম পর্যায়ের সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করা বা না করার বিষয়ে মতভেদ হতে পারে। যদি কোন ব্যক্তি দুর্বল সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে বলে যে, এই হুকুমের সপক্ষে মহানবী (সা)ত-এর নিকট থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাই আমি এর অনুসরণ করি না, তবে তার এই সিদ্ধান্ত স্বয়ং সঠিক হোক অথবা ভুল তাতে কুফরীতে পতিত হওয়ার কোন কারণ নেই। পক্ষান্তরে যদি কোন ব্যক্তি বলে যে, এটা রসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশ হলেও আমি তা মানতে বাধ্য নই, বা তা আমার জন্য কোন দলীল নয়, তবে এই ব্যক্তির কাফের হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। এটি একটি সম্পূর্ণ সোজা ও পরিস্কার কথা, যা হৃদয়ংগম করতে কোন ব্যক্তির মধ্যেই জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে না।
পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়
[পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব মুহাম্মদ শফীর যে রায়টির অধিকাংশের অনুবাদ-[মূল রায়টি ছিলো ইংরেজী ভাষায়। জনাব মালিক গোলাম আলী তার ঊর্দূ অনুবাদ করেন। রায়ের ইংরেজী কপি সহজলভ্য না হওয়ায় এখানে তার ঊর্দূ অনুবাদের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে] নিম্নে প্রদত্ত হচ্ছে তা মূলত একটি আপিল মামলার রায়। এর মূল বক্তব্য বিষয় ছিলঃ কোনো বিধবা নারী তার নাবালক সন্তানদের বর্তমানে যদি এমন কোন ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, যে তার সন্তানদের মুহরিম নয় তবে এই অবস্থায় উক্ত মহিলার জন্য সেই সন্তানদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব অবশিষ্ট থাকে কি না? এই বিতর্কিত বিষয়ে রায় প্রদান করতে গিয়ে বিজ্ঞ বিচারপতি বিস্তারিতভাবে একটি মৌলিক বিষয়ের উপরও নিজের মত ব্যক্ত করেন। তা এই যে, ইসলামে আইনের ধারণা ও রূপরেখা এবং আইন প্রণয়নের পদ্ধতি কি, কুরআনের সাথে হাদীসকেও মুসলমানদের জন্য আইনের উৎস হিসাবে মেনে নেয়া যায় কি না এবং বিশেষত পাকিস্তানের মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে হানাফী ফিকহ-এর নীতিমালার কতটা অনুসারী মনে করা যেতে পারে? এই প্রসংগে মোকদ্দমার এ রায় ইসলামী আইনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ নিজের যুক্তি ও আলোচনার আওতায় নিয়ে এসেছে।
এই রায়ের যে অংশ আসল মোকদ্দমার সাথে সংশ্লিষ্ট তা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এর মূলনীতিগত যুক্তিসমূহের অনুবাদ এখানে প্রদান করা হচ্ছে। এর কোনো কোনো স্থানে কুরআনের যেসব আয়াত উধৃত করা হয়েছে তা অনুবাদসহ শুধুমাত্র সূরা ও আয়াত নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। পি, এল, ডি, ১৯৬০ খৃ. লাহোর (পৃ. ১১৪২-১১৭৯) কর্তৃক মুদ্রিত ইংরেজী পাঠের এখানে উর্দূ অনুবাদ করা হয়। মূল ও পূর্ণাংগ আলোচনা পূর্বোক্ত মুদ্রিত গ্রন্থে দেখা যেতে পারে।–মালিক গোলাম আলী।]
৪. মনে করুন যদি একথা স্বীকার করে নেয়া হয় যে, অভিভাবক নিয়োগ অত্যাবশ্যক ছিল এবং Guardianship and Words Act-এর ১৭ ধারা এই মোকদ্দমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হত, তবে যে বিরাট সিদ্ধান্তের প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে তা এই যে, সেই আইন-বিধান কি যা এক নাবালক মানতে বাধ্য? একথা সম্পূর্ণ সঠিক যে, নাবালকগণ এবং তাদের পিতামাতা মুসলমান এবং মুসলিম আইনের অধীন। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয় যে, নাবালকের অভিভাবকত্বের বিষয়ে সে আইন কোনটি যার অনুসরণ অপরিহার্য? প্রায় সমস্ত গ্রন্থাবলী অন্তর্ভুক্ত আছে, এমন আইন-কানুন ও নীতিমালা বর্ণিত আছে, নাবালকদের সত্তা এবং সহায়-সম্পদের অভিভাবকত্বের বিষয়ে, দীর্ঘকাল ধরে ভারত ও পাকিস্তানে অনুসৃত হয়ে আসছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টসহ সমস্ত বিচারালয় বিভাগ-পূর্ব বৃটিশযুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কঠোরভাবে এসব আইনের অনুসরণ করে আসছে। এমনও হতে পারে যে, বৃটিশ রাজত্বের পূর্বেকার কাযীগণ এবং আইনজ্ঞগণও এসব নীতিমালার অনুসরণ করে থাকবেন এবং পরেও তার অনুসরণ চলতে থাকে। কারণ ইংরেজগণ অথবা অন্য কোন অমুসলিম জাতি স্বীয় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী কুরআন পাকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করুক এবং আইন প্রণয়ন করুক তা মুসলিম আইনজ্ঞগণ পছন্দ করতেন না। মুসলিম আইনের সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে ফাতওয়া আলমগীরী নামক গ্রন্থের যে গুরুত্ব রয়েছে তা এই সত্যের প্রতি দিকনির্দেশ করে। ক্নিতু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সংক্ষেপে এখানে উল্লেখিত নীতিমালা তুলে ধরা হল।
[এরপর ধারা নং ৪-এর অবশিষ্ট অংশে এবং ৫ ও ৬ নং ধারার বিজ্ঞ বিচারপতি অভিভাবকত্ব সম্পর্কে হানাফী, শাফিঈ ও শীআ ফিকতের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।]
৭. যেমন আমি ইতিপূর্বে বলেছি, আসল যে প্রশ্নের সন্তোষজনক মীমাংসার দাবী রাখে তা হচ্ছে, এসব বিধিবিধানকে কি কোন প্রকার অকাট্যতার সাথে সে রকম অবশ্য পালনীয় আইন বলা যেতে পারে, যে মর্যাদা রয়েছে কোন গ্রন্থবদ্ধ আইনের? ভিন্নভাবে বলা যায় যে, এটা কি সেই আইন যার অনুসরণ Guardianship and Words Act-এর ১৭ নং ধারায় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী একজন মুসলিম নাবালকের জন্য বাধ্যতামূলক?
৮. মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী তারা যে ফেরকার সাথেই সম্পর্কিত হোক না কেন, যে আইন তাদের জীবনের প্রতিটি বিভাগে বলবৎ হওয়া উচিৎ চাই তা তাদের জীবনে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিভাগ হোক, তা কেবলমাত্র আল্লাহর আইন। মহান আল্লাহই সর্বোচ্চ আইনদাতা, মহাজ্ঞানী ও সুবিচারক এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। ইসলামে আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানের সম্পর্ক সহজ সরল এবং সরাসরি। কোন নেতা, ইমাম, পীর অথবা অন্য কোন ব্যক্তি (চাই সে জীবিত হোক অথবা মৃত, কবরে হোক অথবা কবরের বাইরে) এই সম্পর্কের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারীর বেশে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। আমাদের এখানে পেশাদার নেতা বা ধর্মীয় গুরুদের এমন কোন সংস্থা বর্তমান নাই যা নিজের ধ্যানধারণাকে রাজকীয় ভংগীতে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। কুরআন মজীদ যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে তার আওতায় অবস্থান করে মুসলমানদের চিন্তা ও কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ইসলামে মানসিক ও আত্মিক স্বাধীনতার পরিবেশ বর্তমান রয়েছে। আইন যেহেতু মানবীয় স্বাধীনতার উপরে বাধ্যবাধকতা আরোপকারী শক্তি, তাই আল্লাহ তাআলা আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পূর্ণরূপে নিজের হাতে রেখেছেন। ইসলামে কোন ব্যক্তির এমনভাবে কাজ করার অধিকার নেই যেন সে অন্যদের নিকট জবাবদিহির উর্ধে। কুরআন ব্যক্তিপূজা ও একনায়কত্ব খতম করে দিতে চায়। ইসলাম বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও পূর্ণ সাম্যের শিক্ষা দিয়ে নিজের নৈতিক ব্যবস্থার অধীনে মানুষের বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও পূর্ণ সাম্যের শিক্ষা দিয়ে নিজের নৈতিক ব্যবস্থার অধীনে মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করেছে, চাই সেই প্রাধান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে হোক অথবা জীবনের অন্য কোন শাখায়। গোটা বিশ্বের মুসলমানরা না হলেও অন্তত একটি দেশের মুসলমানদের একই মালায় সুগ্রথিত করে দেয়া অত্যাবশ্যক। ইসলামী রাষ্ট্রের এমন লোকের অস্তিত্ব অসম্ভব যে একনায়কসুলভ ও রাজতান্ত্রিক ক্ষমতার দাবী করতে পারে। একটি ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের কার্যাবলীও সঠিক অর্থে এই যে, সে আল্লহার বিধান ও তাঁর ফরমানসমূহ বাস্তবায়িত করবে। কুরআন তথা ইসলাম এব ব্যক্তি কর্তৃক সমস্ত মুসলমানদের জন্য আইন প্রণয়ন করার ধারণার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত। কুরআন মজীদ বারবার ঘোষণা করছে যে, আল্লহা এবং একমাত্র আল্লাহ তাআলাই দুনিয়া ও আখেরাতের শাহানশাহ এবং তাঁর বিধানই সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত। ৬:৭, ১২:৪০ ও ৬৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, শাসনক্ষমতার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। অনুরূপভাবে ৪০:১২ আয়াতে বলা হয়েছেঃ (আরবী*******************) “সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা আল্লাহর যিনি সমুন্নত ও মহান”।
একথা ৫৯:২৩ আয়াকে পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে যে, সার্বভৌমত্বের অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ তাআলার সত্তা।
(আরবী*******************************************)
“তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নাই, তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত, তারা যাকে শরীক স্থির করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র, মহান। তিনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা, রূপদাতা, সকল উত্তম নাম তাঁরই। আকাশ মন্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”-(সূরা হাশরঃ ২৩-২৪)।
৯. মহানবী (সা) ও তাঁর চার খলিফার কার্যক্রম একথার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে যে, রাজতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পরিপন্থী, অন্যথায় তাদের জন্য নিজেদেরকে মুসলিম জাতির বাদশা হিসাবে ঘোষণা দেয়ার চেয়ে সহজতর কথা আর কিছুই ছিল না। তাঁরা যদি তাই করতেন তবে তাদের দাবী ত্বরিৎ সমর্থন করা হত। কারণ তাদের যোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তা ছিল সন্দেহ সংশয়ের উর্ধে। একথাও নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে, তাঁরা নিজেদের ইসলামী দুনিয়ার একনায়ক ও স্বার্বভৌম শাসক হিসাবে না চিন্তা করতেন আর না এর ঘোষণা দিতেন। তাঁরা যে কাজই করতেন অন্য মুসলমানদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতেই করতেন। সমস্ত মুসলমান ছিল একটি ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ যা ছিল তাদের অথবা অন্য কথায় ইসলামী আকীদার অপরিহার্য দাবী। এই আকীদা-বিশ্বাসের স্বাভাবিক স্পীরিট এই ছিল যে, মানুষের উপর প্রাধান্য খতম হয়ে গেছে। কেউ রাজাও ছিল না এবং কেউ প্রজাও ছিল না। আর না কোন পুরোহিত বা পীর ছিল। প্রত্যেক ব্যক্তিই নেতা হতে পারত। কিন্তু সাথে সাথে তাকে তাকওয়া বা অন্য কোন যোগ্যতার দিক থেকে তার চেয়ে উত্তম লোকদের অনুসরণ করতে হত। আমীর মুআবিয়াই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের ভ্রাতৃবন্ধনের উপর একটি কষাঘাত করেন এবং নিজের পুত্রকে রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে গোটা জাতিকে নিজের গোত্রের আওতায় জড়ো করেন। আমাদের গণতন্ত্রপ্রিয় রসূল (সা)-এর ইন্তেকালের পরপরই ইসলামের আনীত গণতন্ত্রকে সাম্রাজ্যবাদে পরিবর্তিত করে দেয়া হয়। আমীর মুআবিয়া বংশগত খিলাফতের সূচনা করে ইসলামের মূল শিকড়ের উপর কুঠারাঘাত হানেন। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা) যদিও নিজের কোন নিকটাত্মীয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করতেন, কিন্তু তিনি তাদের মধ্যে কাউকেও নিজের পরে মুসলিম উম্মাহর শাসক নিয়োগ করেননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সব সময় সুস্পষ্টভাবেই গণতান্ত্রিক। আমীর মুআবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র খিলাফতের উপর জবরদখল প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বয়ং মহানবী (সা)-এর নাতি নিজের এবং নিজের প্রিয়তমদের জীবন পর্যন্ত কোরবানী করে দিলেন। এটা ছিল উমাইয়্যা বংশের অপপ্রচার যে, ইমাম হুসাহইন (রা) খিলাফতকে আহলে বায়ত-এর জন্য সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে জীবন দিয়েছেন। এই অপপ্রচার ছিল সম্পূর্ণত মিথ্যার উপর ভিত্তিশীল। আশ্চর্যের বিষয় যে, শীআ সম্প্রদায়ও এই অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত ইমাম হুসাইন (রা) সফল হতে পারেননি। যার ফল এই দাঁড়ায় যে, রাজতন্ত্র ও একনায়কত্ব মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বীকৃত পন্থার রূপ পরিগ্রহ করে। এরপর থেকে নিজেদের শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের কোন অধিকার থাকল না এবং নিজেদের বিষয়াবলীর উপর নিজেদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকল না। আমীর মুআবিয়া যে কাজের সূচনা করেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভবত তার কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটেনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা মুসলিম সমাজের সুস্থ ও সুষ্ঠু ক্রমোন্নতি ও পরিপালনকে অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রভাবিত করে এবং আজ আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে তার মর্যাদা দ্বিতীয় পর্যায়ের রয়ে গেছে।
১০. কুরআন মজীদের আলোকে মুসলমানদের আমীর কেবলমাত্র সেই ব্যক্তি হতে পারে যে বুদ্ধিজ্ঞান ও দৈহিক দিক থেকে এই পদের যোগ্য বিবেচিত হবে। এর দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বংশীয় ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে নাকচ হয়ে যায়। এই প্রসংগে নিম্নোক্ত আয়াতের উল্লেখ যুক্তিসংগত হবেঃ
(আরবী********************************************)
“এবং তাদের নবীঢ তাদের বলেছিল, আল্লাহ তালূতকে তোমাদের রাজা করেছেন। তারা বলল, আমাদের উপর তার কর্তৃত্ব কিভাবে হবে যখন আমরা তার চেয়ে কর্তৃত্বের অধিক হকদার, এবং তাকে প্রচুর ঐশর্য দেয়া হয়নি। নবী বলল, আল্লাহ-ই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দৈহিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় কর্তৃত্ব দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাময়”-(সূরা বাকারাঃ ২৪৭)।
১১. যেমন উপরে বর্ণিত করা হয়েছে যে, ইসলামী আইনের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল বিধান রচনার অধিকার আল্লাহর এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আদম (আ) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা নবী-রসূলগণের মাধ্যমে তাঁর বিধান কার্যকর করেছেন। অতপর এমন একটি যুগসন্ধিক্ষণ উপস্থিত হল যখন মহান আল্লাহর পূর্ণতম প্রজ্ঞার ইচ্ছা অনুযায়ী মানবজাতির সর্বশেষ শরীআত দান করা হয়। এই ওহী লিপিবদ্ধ করে নেয়া হয় কিংবা স্মৃতিপটে মুখস্ত করে ধরে রাখা হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাকে একটি গ্রন্থের রূপ দান করা হয়, যা ‘কুরআন’ নামে খ্যাত। এরপর থেকে মানবজাতির সমস্ত পুরুষ, নারী ও শিশুদের সাথে সম্পর্কিত ব্যাপারসমূহের সমাধান ও মীমাংসা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নাযিলকৃত কুরআন অনুযায়ীই করা হত। এই বিধানই বলে দেয় কোনটি সঠিক, কোনটি ভুল, কি পছন্দনীয়, কি অপছন্দনীয়, কোনটি বৈধ, কোনটি অবৈধ, কোনটি মুস্তাহাব ও কোনটি মাকরূপহ। মোটকথা কুরআন মজীদ মুসলিম সমাজের এক অপরিহার্য ভিত্তি। এটা সেই কেন্দ্র যার চারপাশে ইসলামী আইন আবর্তিত হয়।
১১ (ক). এ এক স্বীকৃত সত্য যে, মানুষের সমন্বয়ে গঠিত সমাজ একটি দারুন জটিল জিনিস। প্রকৃতি যদিও চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব ইচ্ছার প্রকাশের নাম এবং তা একটি স্থায়ী বিধানের অধীন, কিন্তু মানবীয় অবস্থা ও রুচি প্রতি যুগ ও প্রতিটি স্থানের বিচারে এক নয়। ব্যক্তিত্ব ও বস্তুগত অবস্থার সমন্বয় ভবিষ্যতের ঘটনার জন্য কোন নমুনা রেখে যায় না। মানুষের হাজারো রকমের ব্যাপার রয়েছে যেখানে হাজারো ধরনের অবস্থা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, পৃথিবীতে প্রতিটি শিশু নিজের সাথে কল্পনার এক নতুন জগত নিয়ে পদার্পণ করে। নিত্য নতুন অচিন্তনীয় পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এই পৃথিবীতে যেহেতু মানবীয় পরিবেশ ও সমস্যা নিত্য নতুন রূপ নিচ্ছে, তাই এই সদা পরিবর্তনশীল জগতে চিরস্থায়ী ও পরিবর্তনের অযোগ্য কোন বিধান চলতে পারে না। কুরআন মজীদও এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। এ কারণে কুরআন মজীদ মানব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন ব্যাপারে কতিপয় ব্যাপক ও সাধারণ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা আমাদেরকে একক নীতিমালার একটি পূর্ণতর ব্যবস্থা এবং কল্যাণ ও সুফলের উপর ভিত্তিশীল একটি নৈতিক ব্যবস্থা দান করেছে। কতিপয় বিশেষ ব্যাপারে (যেমন উত্তরাধিকার) তা অধিক সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত। এমন কতিপয় ব্যাপার রয়েছে যার উল্লেখ দৃষ্টান্ত ও ইশারা-ইংগীতের আকারে করা হয়েছে। এমনও কতক বিষয় রয়েছে যে সম্পর্কে কুরআন মজীদ সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করেছে –যাতে মানুষ কালের পরিক্রমায় এসব ব্যাপারে পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ণয় করতে পারে। কুরআন মজীদে পুনপুন একথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে, তা নেহায়েত সহজ ভাষায় নাযিল করা হয়েছে যাতে প্রত্যেকেই তা বুঝতে পারে। যেসব আয়াতে এ কথার উপর জোর দেয়া হয়েছে তা এখানে উধৃত করা উপকারী হবে। [অতপর বিজ্ঞ বিচারপতি নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ ও তার অনুবাদ পেশ করেন]।
২৫:২৪২, ৬৫:৯৯, ১০৬, ১২৭, ১১:১, ১২:২, ১৫:১, ১৭:৮৯, ১০৬, ৩৯:২৮, ৫৪:১৭, ২২, ৫৭:৯, ১৭, ২৫, ৩০:৫৮, ৪১:৪৪।
অতএব বিষয়টি সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট যে, কুরআন পড়া ও তা হৃদয়ংগম করা এক দুই ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার নয়। কুরআন সহজ-সরল ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তা বুঝতে পারে, সমস্ত মুসলমান ইচ্ছা করলেও বুঝতে পারে এবং তদনুযায়ী কাজ করতে পারে। এটা এমন এক অধিকার যা প্রত্যেক মুসলমানকে দান করা হয়েছে এবং কোন ব্যক্তি-যত বড় পদমর্যাদা সম্পন্নই হোক-সে মুসলমানদের নিকট থেকে কুরআন পড়ার ও বুঝার এ অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে না। কুরআন মজীদের বক্তব্য হৃদয়ংগম করার জন্য কোন ব্যক্তি অতীত কালের নির্ভরযোগ্য তাফসীরকারদের ভাষ্যগ্রন্থসমূহ থেকে মূল্যবান সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা এ পর্যণ্তই সীমিত থাকা উচিৎ। এসব তাফসীরকে স্ব স্ব আলোচ্য বিষয়ের চূড়ান্ত রূপ বলা যেতে পারে না। কুরআন মজীদ পড়া ও হৃদয়ংগম করার বিষয়টি স্বয়ং দাবী করে যে, পাঠক তার ব্যাখ্যা বিশ্লেসণ করবে এবং তার ব্যাখ্যা প্রদানের সময় সে সমকালীন পরিস্থিতি ও পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রয়োজনের উপর তার প্রয়োগ করবে। এই পবিত্র গ্রন্থের যেসব ব্যাখ্যা অতীত কালের ভাষ্যকারগণ, যেমন ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ প্রমুখ করেছেন যার প্রতি সমস্ত মুসলমান এবং স্বয়ং আমি সম্মান প্রদর্শন করি –তা আজকের যুগে অক্ষরে মান্য করা যেতে পারে না। তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মূলত অন্যান্য অনেক বিজ্ঞ আলেমও সমর্থন করেননি যাদের মধ্যে তাদেরই শাগরিদবৃন্দও রয়েছেন। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতের যে গভীর অধ্যয়ন তাঁরা করেছেন তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমকালীন পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর দ্বারা তা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ব্যাপকভাবে প্রাভাবিত হয়েছে। তাদের যুগে অথবা তাদের দেশে উদ্ভুত সমস্যাবলী সম্পর্কে তাঁরা একটি বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। আজ থেকে ১২/১৩ শত বছর পূর্বেকার তাফসীরকারদের বক্তব্যকে যদি চূড়ান্ত ও সর্বশেষ ভাষ্য মেনে নেয়া হয় তবে ইসলামী সনমাজ একটি লৌহপিঞ্জরে বন্দী পড়ে থাকবে এবং কালের পরিক্রমায় তা ক্রমবিকাশের সুযোগ পাবে না। অতপর তা আর একটি চিরস্থায়ী ও বিশ্বজনীন জীবন ব্যবস্থা হিসাবে টিকে থাকতে পারবে না, বরং যে যুগে ও স্থানে নাযিল হয়েছিল তা সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে। যেমন উপরে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কুরআন যদি কোন অপরিবর্তনীয় নীতিমালা নির্ধারণ না করে থাকে তবে ইমাম আবু হানীফা প্রমুখের ভাষ্যসমূহ সম্পর্কেও অনুমতি দেয়া যায় না যে, তা মাঝখানে সেই পরিণতির কারণ হবে। দুর্ভাগ্য বশত সমকালীন পরিস্থিতির আলোকে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথ কয়েক শতক ধরে সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, যার ফল এই দাঁড়িয়েছিল যে, মুসলমানগণ ধর্মীয় স্থবিরতা , সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা উন্নতিতে এককালে মুসলমানদের একচেটিয়া অবদান ছিল তা অন্যদের হাতে চলে গেছে এবং মনে হচ্ছে যে, মুসলমানরা চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অবশ্যই পরিসমাপ্তি হওয়া উচিৎ। মুসলমাদের জাগ্রত হয়ে যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে যে অসচেতনতা ও অকর্মন্যতা মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলেছে তা থেকে অবশ্যই নিস্কৃতি পেতে হবে। কুরআন মজীদের সাধারণ মূলনীতিগুলোকে সমাজের পরিবর্তিত প্রয়োজনের উপর প্রয়োগ করার জন্য তার এমন যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে লোকেরা নিজেদের ভাগ্য, নিজেদের চিন্তাধারা ও নৈতিক কাঠামো তদনুযায়ী গঠন করতে পারে এবং নিজেদের দেশেও যুগোপযোগী পন্থায় কাজ করতে পারে। অন্য লোকদের মত মুসলমানরাও জ্ঞান ও বুদ্ধিবিবেকের অধিকারী এবং এই শক্তি ব্যবহার করার জন্যই দেয়া হয়েছে, অযথা নষ্ট করার জন্য দেয়া হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের এই স্বাধীনতা রয়েছে যে, তারা চিন্তা গবেষণা করে দেখবে যে, আল্লাহর নিকট কুরআনের আয়াতের দাবী ও তাৎপর্য কি এবং তাকে কিভাবে নিজেদের বিশেষ পরিস্থিতির উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে? অতএব সকল মুসলমানকে কুরআন পড়তে হবে, হৃদয়ংগম করতে হবে এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে।
(আরবী***************************************)
“তাদের মধ্যে কতেকে তোমার কথা শুনে, অতপর তোমার নিকট থেকে বের হয়ে গিয়ে যারা জ্ঞানবান তাদের বলে, এই মাত্র সে কি বলেছে? এদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং এরা নিজেদের খেয়াল-খুশীরই অনুসরণ করে”-(মুহাম্মদঃ ১৬)।
(আরবী******************************************)
“তিনি উম্মীদের মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রসূল হিসাবে –যে তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করে, তাদের পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। ইতিপূর্বে এরা তো ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে” (সূরা জুমুআঃ ২)।
জনগণের কর্তব্য হল তারা যেন কুরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা করে এবং নিজেদের অন্তরের উপর তালা ঝুলিয়ে না দেয়।
(আরবী*****************************************)
এক কল্যাণময় কিতাব, তা আমি তোমার উপর নাযিল করেছি যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে”-(সাদঃ ২৯)।
লোকদের কর্তব্য হচ্ছে, তারা কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে এবং তা হৃদয়ংগম করার চেষ্টা করবে। অন্যান্য উদ্দেশ্য লাভের জন্য যেভাবে দুনিয়াতে কঠোর চেষ্টাসংগ্রাম করতে হয়, অনুরূপভাবে কুরআন বুঝবার এবং তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছার কঠোর পারিশ্রমের নামই হচ্ছে ইজতিহাদ।
(আরবী*********************************************)
“যে কেউ চেষ্টা সাধন করে সে তো নিজের জন্যই তা করে। আল্লাহ তো বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন”-(আনকাবুতঃ ৬)।
পুনর্বার একথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে, লোকেরা কুরআন মজীদের সঠিক ও পূর্ণ জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হবে।
(আরবী**********************************************)
“এরা যখন সমাগত হবে তখন আল্লাহ তাদের বলবেন, তোমরা কি আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিলে, অথচ তা তোমরা নিজেদের জ্ঞানে আয়ত্ত করতে পারনি? না, তোমরা অন্য কিছু করছিলে” –(সূরা নামলঃ ৮৪)।
(আরবী**************************************************)
“আর কঠোর প্রচেষ্টা চালাও আল্লাহর (পথে) যেভাবে তাঁর জন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ। তিনি তোমাদের মনোনীত করেছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। এই পন্থা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের। তিনি পূর্বে তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম এবং এতেও, যাতে রসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হন এবং তোমরা সাক্ষী হও মানব জাতির জন্য। অতএব তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে অবলম্বন ধর, তিনিই তোমাদের অভিভাবক। কত উত্তম অভিভাবক তিনি এবং কত উত্তম সাহায্যকারী”।–(সূরা হজ্জঃ ৭৮)।
(আরবী***********************************************)
“আল্লাহ অতি মহান, প্রকৃত অধিপতি। তোমার উপর আল্লাহর ওহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কুরআন পাঠে তুমি ত্বরা কর না এবং বল, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞানের বৃদ্ধি সাধন কর”-(সুরা ত-হাঃ ১১৪)।
উল্লেখিত সব আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমস্ত মুসলমানের নিকট শুধু তাদের বিশেষ পর্যায়ের লোকের নিকট নয়, এই আশা করা হচ্ছে যে, তারা কুরআনের জ্ঞান অর্জন করবে, তা উত্তমরূপে হৃদয়ংগম করবে এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কতিপয় স্বীকৃতি নীতির অনুসরণ একান্ত অপরিহার্য। এসব মূলনীতির মধ্যে কয়েকটি এও হতে পারেঃ
১. কুরআন মজীদের কতক বিধান গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক। কখনো সেগুলো অমান্য করা এবং সেগুলোর বিরোধিতা করা যাবে না, বরং সেগুলোর উপর অক্ষরে অক্ষরে আমর করতে হবে।
২. এমন কতিপয় আয়াত রয়েছে যার ধরন পথনির্দেশনামূলক এবং কমবেশী যার অনুসরণ করা অপরিহার্য।
৩. যেখানে বক্তব্য সম্পূর্ণ সরল ও সুস্পষ্ট, যা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অরর্থ প্রকাশ করে, সেখানে তার সেই অর্থই গ্রহণ করতে হবে, যা অভিধান ও ব্যাকরণের আলোকে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য অন্য কথায় এই পবিত্র গ্রন্থের শব্দাবলী নিয়ে কোনরূপ টানাহেঁচড়া করা ঠিক নয়।
৪. একথা স্বীকার করে নেয়া উচিৎ যে, কুরআন মজীদের কোন অংশে অর্থহীন, অপূর্ণাংগ অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়।
৫. পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোন অর্থ নির্গত করা উচিৎ নয়।
৬. কুরআনের ব্যাখ্যা যুক্তিগ্রাহ্য হওয়া উচিৎ। এ কথার উদ্দেশ্য এই যে, তাকে পারিপার্শ্বিক দ্বারা প্রভাবিত হওয়া মানবীয় রীতিনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। সর্বদা নতুন ও অনাকাংখিত অবস্থার প্রকাশ ঘটতে থাকে, একথা বিবেচনার যোগ্য। সমাজের প্রয়োজনের তালিকা দিন দিন বর্ধিত হচ্ছে এবং এসব পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের আলোকে কুরআন ব্যাখ্যা প্রদান করা আবশ্যক।
১১ (খ). স্থান-কালের ব্যবধানের কারণে যে বিভিন্নরূপ অবস্থার উদ্ভব ঘটে তার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্যের পারস্পরিক তুলনা হওয়া উচিৎ। তুলনা করার সময় আমাদেরকে পরিস্থিতি ও প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি লক্ষ্য রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে এবং দূরের ও কাছের সত্যসমূহ যাচাই করতে গিয়ে অতীত ও বর্তমানের দিকে এমনভাবে অগ্রসর হতে হবে যে, কল্পিত বিষয়, অনুমান, অস্বাভাবিক ও বর্জনযোগ্য আকীদা-বিশ্বাস সবই আমাদের দৃষ্টির সামনে থাকবে।
১২. দুর্ভাগ্যবশত এই দুনিয়ায় অন্ততপক্ষে খিলাফতে রাশেদার পরে এমন কোন সঠিক ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়নি যেখানে লোকেরা পূর্ণ সচেতনতা, আগ্রহ ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজ করতে পারতো। কুরআন মজীদের নির্ধারিত মূলনীতি চিরস্থায়ী, কিন্তু তার প্রয়েঅগ চিরন্তন নয়। কারণ প্রয়োগ এমন সত্য তথ্য ও উদ্দেশ্যের ফলশ্রুতি যা অব্যাহতভাবে পরিবর্তিত হবে থাকে। এখন যদি কুরআন মজীদের কোন একটি বিশেষ আয়াতের একাধিক ব্যাখ্যা সম্ভব হয় এবং প্রত্যেক মুসলমানকে যদি নিজ নিজ অনুধাবন ক্ষমতা ও রুচি অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদানের অধিকার দেয়া হয় তবে এর ফলে অসংখ্য ব্যাখ্যা অস্তিত্ব লাভ করে একটি বিশৃংখলার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অনুরূপভাবে কুরআন মজীদ যেসব ব্যাপারে নীরব, সে সম্পর্কেও যদি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার দৃষ্টিভংগী অনুযায়ী একটি নীতিমালা তৈরীর অধিকার দেয়া হয় তবে সে ক্ষেত্রেও একটি বিশৃংখল ও অসংলগ্ন সমাজের সৃষ্টি হবে। অন্যান্য সমাজের মত ইসলামী সমাজও যতোটা সম্ভব কষ্টের সাথে হলেও সর্বাধিক সংখ্যক লোককে সুখশান্তির আশ্বাস দেয়। তাই অধিকাংশের রায়ই বিজয়ী হবে।
১৩. এক বা কয়েক ব্যক্তি প্রকৃতিগতভাবে বুদ্ধিজ্ঞান ও শক্তিতে অপূর্ণাঙ্গ হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি যতই অধিক শক্তিশালী ও মেধার অধিকারী হোক না কেন, তার কামেল (পূর্ণাঙ্গ) হওয়ার আশা করা যায় না। একজন উচ্চ স্তরের সচেতন ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিও নিজের পর্যবেক্ষণের আওতায় আসা সমস্ত বিষয়ের গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুমান করতে পারে না। একটি সুশৃংখল সামাজিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর অধীন বসবাসকারী লাখো কোটি মানুষ সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির তুলনায় অধিক জ্ঞান ও শক্তির অধিকারী। তাদের পর্যবেক্ষণশক্তি ও ধারণাশক্তি তুলনামূলকভাবে উত্তম ও উন্নত হয়ে থাকে। কুরআন মজীদের আলোকেও আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা এবং পরিস্থিতির উপর তার সাধারণ মূলনীতিসমূহের প্রয়োগের কাজটি এক ব্যক্তি অথবা কয়েক ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় না, বরং একাজ মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
(আরবী******************************************)
“যারা নিজেদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে, পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদের কার্য সম্পাদন করে এবং তাদের আমি যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে”-(সূরা শূরাঃ ৩৮)।
(আরবী**********************************************)
“আর তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হও না। তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর-যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার”।-(সূরা আল ইমরানঃ ১০৩)।
আরও অনেক আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন কুরআন মজীদ বুঝবার এবং তার আয়াতসমূহের উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবার চেষ্টা করে। এর অর্থ এই যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয় বরং সমষ্টিগতভাবে কাজ আঞ্জাম দিতে হবে।
১৪. আলোচনার এই প্রাসংগিকতার মধ্যে অবস্থান করেই ‘কানূন’ (বিধান) শব্দের অর্থ জানার চেষ্টা করা জরুরী। আমার মতে ‘কানূন’ বলতে সেই নিয়ম প্রণালী ও রীতিনীতিকে বুঝায়, যে সম্পর্ক অধিকাংশ লোক এই ধারণা পোষণ করে যে, তাদের যাবতীয় বিষয় তদনুযায়ী চলা উচিৎ।
১৫. প্রাথমিক পর্যায়ে মানবজাতির সংখ্যা অনেক কম এবং তারা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করত। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ মর্জি মাফিক চলতে পারত। পরবর্তীকালে মানব জাতির সংখ্যা যখন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বসবাসের প্রয়োজন দেখা দিল। উদাহরণস্বরূপ পঞ্চাশ ব্যক্তির একটি দলে হত্যাকান্ড সংঘটিত হল। অধিকাংশের ধারণা অনুযায়ী এটা ছিল না। শক্তি যেহেতু অধিকাংশের কুক্ষিগত ছিল, তাই তারা সংখ্যালঘুদের উপর নিজেদের ইচ্ছা জোরপূর্বক কার্যকর করে এবং সেটাই আইনের মর্যাদা লাভ করে, হয়ত এই পঞ্চাশ ব্যক্তির মধ্যে কেউ হত্যাকারী না হতে পারে। এই যুক্তি বর্তমান কালের দৃষ্টিভংগী থেকেও সঠিক। কয়েক কোটি অধিবাসীর একটি দেশে অধিকাংশ অধিবাসীর কুরআনের একাধিক ব্যাখ্যা সাপেক্ষ আয়াতসমূহের এমন ব্যাখ্যা পেশ করা উচিৎ যা হবে তাদের পারিপার্শিক অবস্থার সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনুরূপভাবে কুরআনের সাধারণ নীতিমালাকে বর্তমান পরিস্থিতির উপর প্রয়োগ করা উচিৎ যাতে চিন্তা ও কর্মের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হতে পারে। তদ্রুপ যেসব সমস্যা ও ব্যাপারসমূহের ক্ষেত্রে কুরআন নীরব, সেসব ক্ষেত্রেও আইন প্রণয়নের দায়িত্ব অধিকাংশকে পালন করতে হবে।
অতপর যে প্রশ্নটি আলোচনার দাবী রাখে তা এই যে, কোটি কোটি মানুষ কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা, এর প্রয়োগ এবং যে বিষয়ে কুরআন নীরব সে সম্পর্কে আইন প্রণয়নের অধিকার কিভাবে ব্যবহার করবে? কোন দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণপূর্বক এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যেতে পারে যে, তথাকার অদিবাসীদের জন্য নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সর্বোত্তম পন্থা কি হতে পারে যাদের উপর তারা বিশ্বস্ততার সাথে নিজেদের এখতিয়ার ও মত প্রকাশের অধিকার অর্পণ করতে পারে। তারা এক ব্যক্তিকেও নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের বলে দিচ্ছে যে, এক ব্যক্তিকে সঠিক কর্তৃত্বের অধিকারী বানানোর পরিণাম সর্বকালেই ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষমতার নেশা ব্যক্তি, সংগঠন ও আইনের শাসনে প্রতিবন্ধকতা ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তিন গুণ বিপর্যয়সহ নিজের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। কোন দেশের ইতিহাসে এমন অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে যে, পরিস্থিতি পরিবর্তন ও দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এক ব্যক্তিকে নিজের হাতে সার্বিক ক্ষমতা তুলে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কিন্তু এটা একটা অস্বভাবিক অবস্থা, যা গণতন্ত্র বহাল করতে এবং ক্ষমতার আমানত জনগণের নিকট হস্তান্তরের জন্য ক্ষমতার বন্টনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপুর্ণ, যাতে তাদের প্রত্যেকে পরস্পরের জন্য নিয়ন্ত্রক এবং জবাবদিহির কারণ হতে পারে এবং সকলে মিলে গোটা জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য আইন-কানূন ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। পরিস্থিতির স্বাভাবিক দাবী এই যে, এই কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সাধারণ লোকদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। কেবলমাত্র এই অবস্থায়ই একটি সুশৃংখল কর্মপন্থা সহকারে কোন কর্মসূচীকে সাফল্যের স্তরে পৌঁছানো যেতে পারে। ইসলামে সমস্ত মুসলমান সমানভাবে ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের উপর রয়েছে কেবলমাত্র আল্লহার স্বার্বভৌমত্ব। তাদের সিদ্ধান্তসমূহ স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সামগ্রিকভাবে ও সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয়। এরই নাম “ইজমা” (ঐক্যমত)।
“ইজতিহাদ” আইনের একটি স্বীকৃত উৎস। এর অর্থ কোন সন্দেহপূর্ণ বা কঠিন আইনগত সমস্যার সমাধান বের করার জন্য নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাকে পূর্ণভাবে প্রয়োগ করা। ইমাম আবু হানীফা ব্যাপকভাবে ইজতিহাদের প্রয়োগ করেছেন। ইজতিহাদের যেসব ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা ও অপরাপর ফকীহগণ কর্মরত ছিলেন সে গুলো হচ্ছে কিয়াস, ইসতিহসান, ইসতিসলাহ ও ইসতিদলাল। মুসলিম ফকীহগণ এক ব্যক্তি বা কয়েক ব্যক্তির ইজতিহাদকে বিপদজনক মনে করতেন। তাই তাঁরা কোন বিশেষ আইনগত সমস্যার ক্ষেত্রে ফকীহগণের অথবা মুজতাহিদগণের ইজমা অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করতেন। অতীতকালে ইজতিহাদকে কতিপয় ফকীহর মধ্যে সীমিত রাখা হয়ত সঠিক ছিল। কারণ জনগণের মধ্যে স্বাধীনভাবে এবং ব্যাপক আকারে জ্ঞানের প্রসার ঘটানো হত না। কিন্তু আধুনিক কালে এই দায়িত্ব জনগণের প্রতিনিধিদের আঞ্জাম দেয়া উচিৎ। কারণ যেমন আমি ইতিপূর্বে বর্ণনা করেছি, কুরআন মজীদ পাঠ করা, অনুধাবন করা এবং তার সাধারণ নীতিমালাকে বিরাজমান পরিস্থিতির উপর প্রয়োগ করা এক অথবা দুই ব্যক্তির বিশেষ অধিকার নয়, বরং সমস্ত মুসলমানের অধিকার ও কর্তব্য এবং একাজ তাদেরই আঞ্জাম দেয়া উচিৎ যাদেরকে মুসলমানগণ এই উদ্দেশ্যে নির্বাচন করে থাকবে। অতএব একথা আপনা আপনি অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, যেসব ব্যাপারে কুরআন মজীদের নির্দেশ সুস্পষ্ট তা মুসলমানদের জন্য আইনের মর্যাদা রাখে এবং যেখানে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা এবং তার সাধারণ নীতিমালাকে আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপর প্রয়োগের ব্যাপার রয়েছে সেখানে সর্বসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ যা কিছু সিদ্ধান্ত নিবে তাও আইনের মর্যাদা লাভ করবে।
১৬. উপরে যে দৃষ্টিভংগীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে সুস্পষ্ট করা যায়। আমি সর্বপ্রথম কুরআন মজীদের সূরা নিসার তৃতীয় আয়াতটি পেশ করব যা বেশীরভাব ক্ষেত্রে ভ্রান্তভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।
(আরবী********************************************)
“তোমরা যদি আশংকা কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিবাহ করবে মহিলাদের মধ্যে যাকে তোমার ভালো লাগে-দুই দুই, তিন তিন, চার চার। আর যদি আশংকা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী বিবাহ কর। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে”।
যেমন আমি আমার রায়ের প্রাথমিক অংশের বর্ণনা করেছি যে, কুরআন মজীদের কোন হুকুমের কোন অংশই অর্থহীনব মনে করা উচিৎ নয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হলঃ তারা এ বিষয়ে আইন প্রণয়ণ করবে যে, একজন একের অধিক বিবাহ করতে পারবে কি না, যদি করতে পারে তবে কি অবস্থায় এবং কোন কোন শর্ত সাপেক্ষে। কিয়াসের দিক থেকে এই ধরনের বিবাহ ইয়াতীমদের উপকারের জন্য হওয়া উচিৎ।
১৭. যাই হোক এই আয়াতের দ্বারা শুধু বৈধতা প্রমাণিত হয়, বাধ্যতামূলক নয় এবং আমার জ্ঞানমতে সরকার এই অনুমতিকে সীমিত করতে পারে। যদি পঞ্চাশ ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ এই আইন প্রণয়ন করতে পারে যে, তাদের মধ্যে কেউই নরহত্যার অপরাধ করবে না, তবে এই উদাহরণের উপর কিয়াস করে বলা যায় যে, যদি কোন একজন মুসলমানের জন্য একথা বলা সম্ভব হয় যে, “আমি একের অধিক বিবাহ করব না, কারণ এই সামর্থ আমার নেই”, তবে আট কোটি (তৎকালীন পাকিস্তানের জনসংখ্যা) মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল গোটা জাতির জন্য এই বিধান প্রণয়ন করতে পারে যে, জাতির অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অথবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন ব্যক্তিকে একের অধিক বিবাহ করার অনুমতি দেয় না। এই আয়াতটি কুরআন মজীদের অন্য দুটি আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়া উচিৎ। প্রথম আয়াত ২৪:৩৩, যাতে বলা হয়েছেঃ বিবাহ করার উপায়-উপকরণ যার নাই তার বিবাহ করা অনুচিৎ। উপায়-উপকরণের স্বল্পতার কারণে যদি এক ব্যক্তিকে এক বিবাহ করা থেকে বিরত রাখা যায় তবে এসব কারণে অথবা এ জাতীয় কারণে তাকে একের অধিক বিবাহ করা থেকেও বিরত রাখা উচিৎ। বিবাহ স্ত্রী ও সন্তানদের অস্তিত্বের যামিনস্বরূপ। পরিবারের ভরণপোষণের অভাবহেতু যদি এক ব্যক্তির জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ হতে পারে তবে তাকে যতটি বাচ্চার ভরণপোষণে সে সক্ষম ততটি জন্মদানে বাধ্য করা যেতে পারে। সে নিজে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তবে সরকারকে তার জন্য একাজ করে দিতে হবে। এই নীতির ব্যাপক আকারে প্রয়োগ করতে গিয়ে, যেমন কোন দেশের খাদ্য পরিস্থিতি যদি খারাপ হয় এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় তবে সরকারের জন্য এরূপ আইন প্রণয়ণ সম্পূর্ণ বৈধ হবে যে, কোন ব্যক্তি একের অধিক স্ত্রী রাখবে না এবং একজনও এমন অবস্থায় রাখবে যখন সে নিজের স্ত্রীর ভরণপোষণের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে এবং সন্তানও একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত রাখবে। তাছাড়া উপরোক্ত আয়াতে বিশেষভাবে এই নিদের্শ দেয়া হয়েছে যে, কোন মুসলমান নিজ স্ত্রীদের মধ্যে সবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না বলে আশংকা বোধ করলে সে কেবল একজন স্ত্রীলোকই বিবাহা করবে। সূরা নিসার ১২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা একথা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
(আরবী************************)
“আর তোমার যতই ইচ্ছা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার কখনই করতে পারবে না। তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সর্ম্পূণভাবে ঝুঁকে পড়বে না এবং অপরকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখ না। যদি তোমরা নিজেদের সংশোধন কর এবং সাবধান হও তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”
এই দুই আয়াতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য আইন প্রণয়ন এবং একাধিক বিবাহের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা সরকারের দায়িত্ব।
১৮. সরকার বলতে পারে যে, দুই স্ত্রী বিবাহ করার ক্ষেত্রে যেহেতু বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রকাশ পেয়েছে এবং কুরআনেও স্বীকার করা হয়েছে যে, দুই স্ত্রীর সাথে সমান ব্যবহার অসম্ভব, তাই এই প্রথা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হল। এই তিনটি আয়াত সাধারণ নীতিমালা বর্ণনা করে। এই তিনটি মূলনীতির প্রয়োগ সরকারকেনিজ তত্ত্ববাধানে করতে হবে। সরকার লোকদের একাধিক বিবাহ করে নিজেকে এবং নিজের সন্তানদের ধ্বংস করা থেকে বাঁচাতে পারে। জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দাবী এই যে, যখনই প্রয়োজন অনুভূত হবে বিবাহের উপর বিধিনিষধ আরোপ করা হবে।
১৯. চুরির ব্যাপারে সূরা ৫ঃ ৩৮-এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পুরুষে চোর অথবা নারী চোর উভয়ের হাত কাটা যাবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের অপরাধের দৃষ্টান্তমূক শাস্তি। একই সূরার ৩৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, “যে কেই যুলুম করার পর তওবা করলে এবং সংশোধন হলে নিশ্চয় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।“ অতএব সাধারণ মূলনীতি এই যে, চুরির সর্বোচ্চ শাস্তি হাত কেটে দেয়া। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেয়া সরকারের দায়িত্ব যে, চুরি কি এবং কোন ধরনের চুরির কি শাস্তি? এ থেকে যে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় তা এই আইন-কানূন রচনার এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। এই এখতিয়ারের আওতা বহুত প্রশস্ত, এবং সুশৃংখল বাস্তব কর্মসূচী কার্যকর করার জন্য তার স্বাধীন ব্যবহার হওয়া উচিত।
২০. ভারত ও পাকিস্তানে যতগ্রলো গ্রন্থ আইনগত দিক থেকে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় সেগুলোর মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তাদের সম্পর্কে বর্ণিত নীতিমালা কুরআন মজীদের উপর ভিত্তিশীল নয়। এই পবিত্র গ্রন্থে নাবালক শিশুদের সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলঃ
(আরবি***************************)
“যে পিতা দুধপান-কাল পূর্ণ করতে চায়, তার জন্য মায়েরা তাদের সন্তাদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে। এমতাবস্থায় পিতার কর্তব্য যথারীতি তাদের (মায়েদের) ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। কারো উপর তার সামর্থের অধিক দায়িত্বভার চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। কোন মাকে তার সন্তানের জন্য এবং কোন পিতাকে তার সন্তানের জন্য কষ্টে নিক্ষেপ করা উচিত নয় এবং উত্তরাধিকারীদেরও অনুরূপ কর্তব্য রয়েছে। কিন্তু তারা যদি পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে দুধপান বন্ধ রাখতে চায় তবে তাদের কারো কোন অপরাধ নাই। তোমরা যা কিছু মূল্য নির্ধনারণ করবে তা যদি নিয়মিত আদায় কর, তবে অন্য মেয়েলোক দ্বারা তোমাদের সন্তানদের দুধ পান করা চাইলে তোমাদের কোন পাপ নাই। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা” (সূরা বাকারাঃ ২৩৩)।
“তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তোমরা যে স্থানে বাস কর তাদেরকে সেই স্থানে বাস করতে দাও, তাদের উত্ত্যক্ত করো না সংকটে ফেলার জন্য। তারা গর্ভবতী হয়ে থাকলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাদের জন্য ব্যয় করবে, যদি তারা তোমাদের সন্তানদের দুধ পান করায় তবে তাদের পারিশ্রমিক দেবে এবং সন্তানের কল্যাণ সর্ম্পকে তোমরা সংগতভাবে নিজেদের মধ্যে পরার্মশ করবে। তোমরা যদি নিজ নিজ দাবীতে অনমনীয় হও তবে অন্য স্ত্রীলোক তার পক্ষে স্তন দান করবে”( সূরা তালাকঃ ৬)।