রসূলের আনুগত্যের প্রকৃত অর্থ
মহানবী (সা)-এর আনুগত্যের যে হুকুম কুরআন মজীদে দেয়া হয়েছে তাকে বিজ্ঞ বিচারক এই অর্থে গ্রহণ করেন যে, “আমাদেরকেও সেই রকম ঈমানদার, সৎ এবং সেই রকম কর্মতৎপর, দীনদার ও খোদাভীরু হতে হবে- যেমনটি ছিলেন মহানবী (স)”। তার মতে আনুগত্যের এই (কুরআনে উল্লেখিত) অর্থ “স্বভাববিরোধী এবং অবাস্তব যে, আমাদেরকেও ঠিক সেইভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং কাজকর্ম করতে হবে –যেভাবে মহানবী (সা) চিন্তা করতেন এবং কাজ করতেন”। তিনি বলেন, এই অর্থ গ্রহণ করলে জীবনটাই দুর্বিসহ হয়ে পড়বে।
এ ব্যাপারে আমাদের নিবেদন এই যে, এতবড় মৌলিক বিষয়টিকে খুবই হালকাভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। আনুগত্যের অর্থ কেবলমাত্র রং-বৈশিষ্ট্যের সমরূপ হওয়া নয়, বরং চিন্তাধারার পদ্ধতি, মূল্যবোধের মানদন্ড, মূলনীতি ও দৃষ্টিভংগী, চরিত্র-নৈতিকতা ও আচার-ব্যবহার, জীবনাচার ও কার্যক্রম-সব কিছুরই আনুগত্য করা তার মধ্যে অপরিহার্যরূপে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মহানবী (স) যেখানে শিক্ষক হিসাবে দীনের কোন হুকুম অনুযায়ী কাজ করে বলে দিয়েছেন, সেখানে ছাত্রের মতই সেই কাজে তাঁর অনুসরণ করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। এর অর্থ কখনও এই নয় যে, তিনি যে কাঠামোর পোশাক পরিধান করতেন আমাদেরও তাই পরিধান করতে হবে। তিনি যে ধরনের আহার করতেন আমাদেরও সেই জাতীয় খাদ্য আহার করতে হবে। তিনি যে ধরনের যানবাহন ব্যবহার করতেন আমাদেরও অনুরূপ যানবাহনে ভ্রমন করতে হবে। অথবা তিনি যে ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করতেন তা ছাড়া অন্য কোন প্রকারের অস্ত্র আমরা ব্যবহার করতে পারব না। আনুগত্যের এ ধরনের অর্থ গ্রহণ করলে নিসন্দেহে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। কিন্তু উম্মাতের মধ্যে আজ পর্যন্ত এমন কোন জ্ঞানবান ব্যক্তি অতীত হননি, যিনি আনুগত্যের উপরোক্তরূপ অর্থ গ্রহণ করে থাকবেন। আনুগত্যের অর্থ সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানরা এই বুঝেছে যে, মহানবী (স) তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে ইসলামী চিন্তাপদ্ধতি এবং দীনের মূলনীতি ও হুকুম-আহকামের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তাতে আমরা তাঁর অনুসরণ করব।
উদাহরণস্বরূপ ঐ একাধিক বিবাহ সম্পর্কিত বিষয়টিই নেয়া যেতে পারে, যে সম্পর্কে বিজ্ঞ বিচারক ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। এই বিষয়ে মহানবী (স)-এর কথা ও কাজের দ্বারা চূড়ান্তভাবেই এই চিন্তাভংগীর প্রকাশ পায় যে, একাধিক বিবাহ মূলত কোন খারাপ কিছু নয়, যার উপর বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজন রয়েছে এবং এক বিবাহ মূলত কোন কাংখিত মূল্যবোধ নয় যাকে মানদণ্ড হিসাবে দৃষ্টির সামনে রেখে আইন প্রণয়ন করতে হবে। অতএব মহানবী (সা)-এর আনুগত্যের দাবী এই যে, উল্লেখিত বিষয়ে আমাদের চিন্তাপদ্ধতিও তদ্রুপ হতে হবে। তাছাড়া এ প্রসংগে কুরআনের পথনির্দেশের উপর মহানবী (সা)-এর নিজের শাসনকালে যেভাবে আমল করা হয়েছিল তা ঐ পথনির্দেশের যথার্থ ব্যাখ্যা যার আনুগত্য আমাদের করতে হবে। তাঁর যুগে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের বর্তমান অবস্থার তুলনায় অনেক গুণ বেশী খারাপ ছিল। কিন্তু তিন ইংগিতেও এসব কারণে একাধিক বিবাহের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেননি। দ্বিতীয় বিবাহে আগ্রহী কোন ব্যক্তিকে তিনি একথা বলেননিঃ প্রথমে প্রমাণ কর যে, বাস্তবিকই তোমার দ্বিতীয় বিবাহের প্রয়োজন এবং তুমি দুই বা ততোধিক স্ত্রীর খোরপোষ বহনে সক্ষম। তিনি কাউকে জিজ্ঞেস করেননি যে, কোন ইয়াতীম শিশুর লালন-পালনের জন্য তুমি দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাও? তিনি কাউকেও বলেননি যে, প্রথমে তোমার বর্তমান স্ত্রীকে সম্মত কর। তাঁর শাসনকালে কোন ব্যক্তির জন্য স্বেচ্ছায় চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণের পরিস্কার অনুমতি ছিল। তাঁর যুগে যদি কখনও হস্তক্ষেপ হয়ে থাকে তবে তা কেবল তখনই হয়েছে, যখন কোন ব্যক্তি স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার করেনি। এখন আমরা যদি রসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুসারী হয়ে থাকি তবে আমাদের কাজ এই হওয়া উচিৎ নয় যে, দুই-তিনটি আয়াত নিয়ে স্বয়ং ইজতিহাদ করতে বস যাব। বরং আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে যে, যে রসূলের উপর এসব আয়াত নাযিল হয়েছিল তিনি এর কি উদ্দেশ্য অনুধাবন করেছিলেন এবং কিরূপে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন।
মহানবী (স) এর পথনির্দেশ কি তাঁর যুগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল?
বিজ্ঞ বিচারকের বক্তব্য হলো, মহানবী (সা)-এর কথা, কাজ ও আচার-ব্যবহারকে সর্বাধিক যতটুকু কাজে লাগানো যেতে পারে তা শুধু এই যে, তার মাধ্যমে “এটা জানার জন্য সাহায্য নেয়া যেতে পারে যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কুরআনের ব্যাখ্যা কিভাবে করা হয়েছিল, অথবা কোন বিশেষ ব্যাপারে কুরআনের সাধারণ নীতিমালাকে কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল”।
উপরোক্ত বক্তব্য তার পাঠকের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা এই যে, বিজ্ঞ বিচারকের মতে মহানবী (স)-এর পথনির্দেশ গোটা বিশ্ববাসীর জন্য ছিল না এবং চিরকালের জন্যও ছিল না, বরং তাঁর যুগের একটি বিশেষ সমাজের জন্য ছিল। তার নিম্নোক্ত বাক্য থেকেও একই প্রতিক্রিয়া হয়ঃ ‘একজন একক ব্যক্তির জীবনকালের ঘটনাবলীর অভিজ্ঞতা একটি সীমিত সংখ্যার অধিক লোকের জন্য দৃষ্টান্ত সরবরাহ করতে পারে না”।
এ বিষয়ে তিনি যেহেতু বিস্তারিতভাবে নিজের দৃষ্টিভংগী ব্যক্ত করেননি, তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তো করা যায় না, কিন্তু তার বক্তব্য যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি কথা নিবেদন করা আমরা জরুরী মনে করি।
কুরআন মজীদ সাক্ষী যে, তা (কুরআন) স্বয়ং একটি বিশেষ যুগে একটি বিশেষ জাতিকে সম্বোধন করা সত্ত্বেও যেমন একটি বিশ্বজনীন ও চিরস্থায় নির্দেশনামা, অনুরূপভাবে তার বাহক রসূলও একটি সমাজে কয়েক বছর যাবত রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া সত্ত্বেও গোটা মানব জাতির জন্য আজ পর্যণ্ত এবং অনাগত কাল পর্যন্ত পথপ্রদর্শক। যেভাবে কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
“এই কুরআন আমার নিকট ওহী করা হয়েছে –যাতে আমি এর সাহায্যে তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট তা পৌঁছে তাদেরকে সতর্ক করতে পারি”।–(সূরা আনআমঃ ১৯)।
ঠিক তদ্রুপ কুরআনের বাহক রসূল (সা) সম্পর্কেও বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************************************)
“(হে মুহাম্মদ!) বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসূল”-(সূরা আরাফঃ ৫৮)।
(আরবী************************************************************************)
“আমরা তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসাবে প্রেরণ করেছি”।–(সূরা সাবাঃ ২৮)।
(আরবী**************************************************************)
“মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং সে আল্লাহর রসূল এবং নবীগণের শেষ”-(সূরা আহযাবঃ ৪০)।
এদিক থেকে “কুরআন ও মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ” (স)-এর পথনির্দেশের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। যদি সাময়িক ও সীমিত হয় তবে উভয়ই হবে, যদি বিশ্বজনীন ও চিরস্থায়ী হয় তবে উভয়ই হবে। কে না জানে যে, ৬১০ খৃষ্টাব্দে কুরআন নাযিল শুরু হয় এবং ৬৩২ খৃষ্টাব্দে তার অবতরণের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত হয়। কে না জানে যে, এই কুরআনের সম্বোধনকৃত লোক ছিল তৎকালীন আরবজাতি এবং তাদের অবস্থা সামনে রেখে তাতে পথনির্দেশ দান করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কিসের ভিত্তিতে এই পথনির্দেশকে সর্বকালের জন্য এবং আগত-অনাগত গোটা মানবজাতির জন্য হেদায়াতের উৎস বলে স্বীকৃতি দেই? এই প্রশ্নের যে উত্তর হতে পারে –নিম্নোক্ত প্রশ্নেরও ঠিক একই উত্তর হবে যে, এক ব্যক্তির নবুওয়াতী জীবন যা সপ্তম শতকে মাত্র ২২টি সৌর বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তার অভিজ্ঞতা সর্বকালের জন্য এবং গোটা মানবজাতির জন্য কিভাবে পথনির্দেশের মাধ্যম হতে পারে? হেদায়াতের এই দুটি উৎস বা মাধ্যম স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে সর্বকালীন ও বিশ্বব্যাপক পথনির্দেশ দান করতে পারে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনার অবকাশ এখানে নাই। এখানে আমরা শুদু এতটুকু জানতে চাই যে, যেসব লোক কুরআনের সর্বকালীন ও বিশ্বজনীন হওয়ার প্রবক্তা, তারা আল্লারহ কিতাব ও আল্লাহর রসূলের মধ্যে কিসের ভিত্তিতে পার্থক্য করে? অবশেষে কোন যুক্তিতে একের (কুরআনের) পথনির্দেশ সাধারণ বা ব্যাপক এবং অপরের (রসূলের) পথনির্দেশ সীমিত ও নির্দিষ্ট?
খোলাফায়ে রাশেদীন কর্তৃক সুন্নাত অনুসরণের কারণ
এই নীতিগত আলোচনার পর ২৪ নং প্যারায় বিজ্ঞ বিচারপতি প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, খোলাফায়ে রাশেদীন নিজ নিজ যুগে যদিও সুন্নাতের অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু তার কারণ কি? এ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ
“চারজন খলীফা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-এর কথা ও কাজ ও আচার-ব্যবহারের কতটা গুরুত্ব দিতেন তা জ্ঞাত হওয়ার মত কোন নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বিদ্যমান নাই। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেয়া হয় যে, তাঁরা লোকদের সমস্যাবলী এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর সমাধান পেশ করার জন্য ব্যাপকভাবে হাদীসের প্রয়োগ করতেন, তবে তাঁরা ঠিকই করেছেন। কারণ তাঁর স্থান-কারের বিচারে আমাদের তুলনায় মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী ছিলেন”।
আমাদের নিবেদন এই যে, অতীত কালের কোন ঘটনা সম্পর্কে যে সাক্ষ্য সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য হওয়া সম্ভব এতটা নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যই নিম্নোক্ত বিষয়ে বর্তমান রয়েছে যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের চারজনই অত্যন্ত কঠোরতার সাথে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ করতেন এবং তার কারণ এই ছিল না যে, তাদের যুগের পরিস্থিতি রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগের পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল, বরং তার কারণ এই ছিল যে, তাদের মতে কুরআনের পরেই সুন্নাত ছিল আইনের উৎস। তার থেকে সীমাতিক্রম করাকে তাঁরা নিজেদের জন্য বৈধ মনে করতেন না। এ সম্পর্কে তাদের নিজেদের সুস্পষ্ট বক্তব্য আমরা এই গ্রন্থের ১১১ পৃষ্ঠা থেকে ১১৮ নং পৃষ্ঠা পর্যন্ত “খোলাফায়ে রাশেদীনের বিরুদ্ধে অপবাদ” শীর্ষক অনুচ্ছেদে উধৃত করে এসেছি। তাছাড়া এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে চতুর্দশ হিজরী শতক পর্যন্ত প্রতি শতকের ফিকহ সাহিত্য অব্যাহত ও অবিচ্ছিন্নভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনের এই মত ও কর্মধারাই বর্ণনা করে আসছে। বর্তমান কালে কতিপয় লোক তাঁদের সুন্নাত অমান্য করার যেসব নজীর পেশ করছে তার মধ্যে একটিও মূলত একথার নজীর নয় যে, কোন খলীফায়ে রাশেদাও কার্যত সুন্নাত অমান্য করেছেন। এর মধ্যে কতিপয় নজীরের তাৎপর্য আমরা এই গ্রন্থের ১৯২-১৯৬ পৃষ্ঠায় ব্যক্ত করে এসেছি (২৬-২৮ নং অভিযোগের উত্তর দ্র.)।
ইমাম আবু হানীফা (রহ) –এর হাদীসের জ্ঞান ও সুন্নাতের অনুসরণ
অতপর বিজ্ঞ বিচারপতি ইমাম আবু হানীফা (রহ) –এর দৃষ্টিভংগীকে প্রমাণ
“কিন্তু আবু হানীফা, যিনি ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭০ বছর পরে মারা যান, মাত্র ১৭ কি ১৮ টি হাদীস তার সামনে পেশকৃত বিষয়ের সমাধানের জন্য ব্যবহার করেন। খুব সম্ভব এর কারণ এই ছিল যে, তিনি চার খলীফার অনুরূপ রসূলুল্লাহর যুগের নিকটবর্তী ছিলেন না। তিনি তার সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি কুরআনের লিপিবদ্ধ নির্দেশনামার উপর রাখেন এবং কুরআনের মূল পাঠের শব্দসমষ্টির পেছনে সেইসব ক্রিয়াশীল উপাদান অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন যা সেই নির্দেশের কারণ ছিল। তিনি যুক্তি প্রদান ও সমাধান বের করার পর্যাপ্ত শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি বাস্তব অবস্থার আলোকে কিয়াসের ভিত্তিতে আইনের মূলনীতি ও নিয়ম-প্রণালী প্রণয়ন করেন। হাদীসের সাহায্য ব্যতিরেকে সমসাময়িক পরিস্থিতির আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদানের অধিকার যদি ইমাম আবু হানীফার থেকে থাকে, তবে অপর মুসলমানদের এই অধিকার প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না”।–(প্যারা ২৪)।
উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণতো ভুল বিবরণ ও কল্পনা প্রসূত বিষয়ের উপর ভিত্তিশীল। ইমমা আবু হানীফা (রহ) সম্পর্কে ইবনে খালদুন না জানি কোন সনদের ভিত্তিতে এ কথা লিখে দিয়েছেন যে, “হাদীস গ্রহণ করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা এতো বেশী কঠোর ছিলেন যে, তাঁর মতে ১৭-এর অধিক হাদীস সহীহ ছিল না”।
উপরোক্ত কথা প্রচলিত হতে হতে লোকদের মধ্যে এভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, ইমাম আবু হানীফার মাত্র ১৭ টি হাদীসের জ্ঞান ছিল, অথবা বলা হয় তিনি ১৭টি হাদীস থেকে সমাধান বের করেছেন। অথচ এটা সম্পূর্ণরূপে বাস্তব ঘটনার পরিপন্থী কল্পকাহিনী। আজ ইমাম আবু হানীফার সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ)-এর প্রণীত ‘কিতাবুল আছার’ শীর্ষক গ্রন্থ মুদ্রিত আকারে বিদ্যমান রয়েছে, যার মধ্যে তিনি নিজ উস্তাদের বর্ণনাকৃত এক হাজার হাদীস একত্র করেছেন। তাছাড়া ইমাম সাহেবের অপরাপর প্রসিদ্ধ ছাত্রবৃন্দ ইমাম মুহাম্মদ (রহ) ও ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ আল-লুলুঈ (রহ) এবং ইমামের পুত্র হাম্মাদ ইবনে আবু হানীফাও তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীসসমূহের কংকলন তৈরী করেছিলেন। অতপর অব্যাহতভাবে কয়েক শতাব্দী যাবত অসংখ্য আলেম তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীসসমূহ ‘মুসনাদে আবী হানীফা’ [হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় –একক ব্যক্তির রিওয়ায়াতকৃত হাদীসসমূহ যে গ্রন্থে সংকলনাবদ্ধ করা হয় তাকে “মুসনাদ” বলা হয়।] শীর্ষক নামে জমা করতে থাকেন। তার মদ্যে ১৫ খানা মুসনাদের একটি ব্যাপক সংকলন কাযীল কুযাত (প্রধান বিচারপতি) মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ আল-খাওয়ারাযমী “জামি মাসানিদিল ইমাম আল-আজম” শিরোনামে সংকলন করেছেন যা হায়দরাবাদের ‘দাইরাতুল মাআরিফ’ শীর্ষক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে। এসব কিতাব এই দাবী চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করে যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ) মাত্র ১৭টি হাদীস জানতেন অথবা তিনি ফিকহী মাসআলা প্রণয়নে মাত্র ১৭টি হাদীস ব্যবহার করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে ইমাম সাহেবের উস্তাদের সংখ্যা (যাদের রিওয়ায়াত তিনি গ্রহণ করেছেন) চার হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাঁকে হাদীসের প্রবীণ হাফেজদের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তাঁর সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ একত্রকারীদের মধ্যে ইমাম দারু কুতনী, ইবনে শাহীন এবং ইবনে উকদার মত নামকরা হাদীসবেত্তাগণ শামিল রয়েছেন। কোন ব্যক্তি হানাফী ফিকহ-এর নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্য থেকে শুধুমাত্র ইমাম তাহাবী (রহ)-এর “শারহু মাআনিল আছার”, আবু বাকর আল-জাসসাস (রহ)-এর “আহকামুল কুরআন” এবং ইমমা সারাখসীর “আল-মাবসূত” দেখে নিলে সে কখনও এই ভুল ধারণার শিকার হবে না যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ) হাদীসকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র কিয়াস ও কুরআনের উপর নিজের ফিকহ এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
আবার হাদীস থেকে যুক্তিপ্রমাণ গ্রহণ করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর যে দৃষ্টিভংগী ছিল তা তিনি নিজেই নিম্নোক্ত বাক্যে বর্ণনা করেনঃ
“আমি যখনই কোন হুকুম আল্লাহর কিতাবে পেয়ে যাই তখনই তা দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরি। যদি তাতে না পাই তবে রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাত এবং তাঁর সেইসব হাদীস গ্রহণ করি যা নির্ভরযোগ্য লোকদের কাছে নির্ভরযোগ্য লোকদের মাধ্যমে প্রসিদ্ধ। অতপর যখন আল্লাহর কিতাবেও নির্দেশ পাওয়া যায় না এবং রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাতেও না, তখন আমি রসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীগণের বক্তব্যের (অর্থাৎ তাদের ইজমার অনুসরণ করি এবং তাদের মদ্যে মতভেদের ক্ষেত্রে যে সাহাবীর বক্তব্য ত্যাগ করে অপর কারো কথা গ্রহণ করি না। অন্যদের ব্যঅপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, ইজতিহাদের অধিকার যেমন তাদের আছে, তেমন আমারও আছে” –(তারীখে বাগদাদ, আল খাতীব রচিত, ১৩ খৃ., পৃ. ৩৬৮; আল-মুওয়াফফাক আল-মাক্কী, মানাকিব ইমাম আজম, ১খ., পৃ. ৭৯; আয-যাহাবী, মানাকিব ইমাম আবু হানীফা ওয়া সাহিবাইন, পৃ. ২০)।
ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর সামনেই একবার তাঁকে অপবাদ দেয়া হল যে, তিনি কিয়াসকে কুরআনের উপর অগ্রাধিকার দেন। এর জবাবে তিনি বলেন, “আল্লাহর শপথ! ঐ ব্যক্তি মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে যে বলেছে –আমি কিয়াসকে কুরআনের উপর অগ্রাধিকার দেই। আল্লাহর কিতাবে দলীল বর্তমান থাকতে কিয়াসের কি আর প্রয়োজন থাকে”-(শারানী, কিতাবুল মীযান, ১খ, পৃ. ৬১)।
আব্বাসী খলীফা মানসূর একবার ইমাম সাহেবকে লিখে পাঠান, আমার কানে এসেছে আপনি কিয়াসকে হাদীসের উপর অগ্রাধিকার দেন। উত্তরে তিনি লিখে পাঠান, “আমীরুল মুমিনীন! যে কথা আপনার কানে পৌঁছেছে তা ঠিক নয়। আমি সর্বপ্রথম আল্লাহর কিতাবের উপর আমল করি, অতপর রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাতের উপর, অতপর আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী (রা)-এর সিদ্ধান্তের উপর, এরপর অবশিষ্ট সাহাবীদের সিদ্ধান্তের উপর। অবশ্য সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ থাকলে আমি কিয়াসের আশ্রয় নেই”।–(শারানী, কিতাবুল মীযান, ১খ, ৬২)।
আল্লামা ইবনে হাযম (রহ) তো এ পর্যন্ত লিখেচেন, “আবু হানীফা (রহ) এর সকল সংগী একমত যে, আবু হানীফা (রহ)-এর মাযহাব ছিলঃ যঈফ হাদীসও পাওয়া গেলে তা গ্রহণপূর্বক কিয়অস ও রায় পরিত্যাগ করতে হবে” –(যাহাবী, মানাকিব ইমাম আবু হানীফা ওয়া সাহিবাইন, পৃ. ২১)। প্রকাশ থাকে যে যঈফ হাদীসের অর্থ জাল হাদীস নয়। এখানে যঈফ হাদীস বলতে এমন হাদীস বুঝানো হয়েছে যার সনদসূত্র শক্তিশালী নয়, কিন্তু যা থেকে প্রবল ধারণা জন্মে যে, এটা মহানবী (সা)-এর কথাই হবে।
বিচারপতির মতে হাদীসের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করার কারণ
এরপর বিজ্ঞ বিচারকের মতে যেসব কারণে হাদীস নির্ভারযোগ্য নয় এবং দলীল-প্রমাণও নয়, ২৫ প্যারায় তিনি বর্ণনা দিয়েছেন। এ প্রসংগে তার আলোচনার বিষয়গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
“ইসলামের সকল ফকীহ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, যুগের পরিক্রমায় জাল হাদীসের একটি বিরাট স্তূপকে ইসলামী আইনের এক বৈধ ও স্বীকৃত উৎস হিসাবে মেনে নেয়া হয়েছে। মিথ্যা হাদীস স্বয়ং মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগে প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। মিথ্যা ও ভ্রান্ত হাদীসের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, হযরত উমার (রা) তার খিলাফতকালে হাদীস বর্ণনার উপর বিধিনিষেধ আরোপ কারেন, বরং তার বর্ণনা নিষিদ্ধ করে দেন। ইমাম বুখারী ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্য থেকে মাত্র নয় হাজার সহীহ হিসাবে নির্বাচন করেন।“ ২. “আমি বুঝতে পারছি না কোন লোক কি একথা অস্বীকার করতে পারে যে, কুরআনকে যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তদ্রপ প্রচেষ্টা রসূলুল্লাহ (স)-এর নিজের যুগে হাদীসসমূহের সংরক্ষণের জন্য নেয় হয়নি। পক্ষান্তরে যে সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে তা এই যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স) লোকদেরকে তাঁর কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করতে চরমভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দেন, কোন ব্যক্তি তাঁর হাদীসসমূহ সংরক্ষণ করে থাকলে সে যেন তা অবিলম্বে নষ্ট করে দেয়।
(আরবি*****************************)
এ হাদীস অথবা এ ধরনেরই একটি হাদীসের তরজমা মাওলানা মুহাম্মদ আলী
হতে তার উপর তা লিখে নেয়া হত এবং এই উদ্দেশ্যে রসূলে করীম (স) কতিপয় সুশিক্ষিত সাহাবীকে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু হাদীস সম্পর্কে বলা যায় যে, তা না মখস্ত করা হয়েছিল, আর না সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তা এমন লোকদের মগজে লুক্কায়িত ছিল যারা ঘটনাক্রমে কখনও অন্যদের সামনে তা বর্ণনা করার পরপরই মরে গেছে। এমনকি রসূলের ওফাতের কয়েক শত বছর পর তা সংগ্রহ ও সংকলনাবদ্ধ করা হয়।“
৫. “একথা স্বীকার করা হয় যে, পরবর্তী কালে প্রথম বারের মত রসূলু্ল্লাহ (স)-এর প্রায় একশত বছর পর হাদীসসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু তার রেকর্ড আজ দুষ্প্রাপ্য। এরপর তা নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ সংগ্রহ করেনঃ
ইমাম বুখারী ( মৃ. ২৫৬ হি.) ইমাম মুসলিম ( মৃ. ২৬১ হি.), আবু দাউদ ( মৃ. ২৭৫ হি.), জামে তিরমিযী বিজ্ঞ বিচারক নামটা এভাবে লিখেছেন, অথচ জামে তিরমিযী সংকলকের নাম নয়, বরং সংকলনের নাম। সংকলক ইমাম তিরমিযী নামে পরিচিত। ( মৃ. ২৭৯ হি.), সুনানে নাসাঈ ( মৃ. ৩০৩ হি.), সুনানে ইবনে মাজা এও সংকলকদের নাম নয়, সংকলনের নাম। সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজার তো একনও মৃত্যু হয়নি (কারণ উভয়ই দুটি গ্রন্থ)। ( মৃ. ৩৮৩ হি.), সুনানে দরীবী আমাদের জানমতেও এ নামের কোন সংকলক নেই , না এই কোন কিতাব আছে। ( মৃ. ১৮১ হি.), বায়হাকী ( জ. ১৬৪ হি.)।“ বিজ্ঞ বিচারপতি এরপর শীঅ সম্প্রদায়ের মুহাদ্দিসদের উল্লেখ করেছেন। এদের উল্লেখ আমরা এজন্য করলাম না যে, তাদের সম্পর্কে কিছু বলা শীআ আলেমগণের দায়িত্ব।
৬. “এমন হাদীস খব কমই আছে যে সম্পর্কে হাদীসের এই সংকলকগণ একমত হতে পেরেছেন। এই জিনিস (মতানৈক্য) কি হাদীসসমূহের উপর আস্থা স্থাপনের ব্যাপারটি চরমভাবে সন্দেহপূর্ণ বানিয়ে দেয় না?
৭. “যাদের উপর তথ্যানুসন্ধানের কাজ অর্পন করা হবে তারা অবশ্যই এদিকে দৃষ্টি রাখবে যে, হাজার হাজার জাল হাদীস ছড়ানো হয়েছে যাতে ইসলাম ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর দুর্নাম গাওয়া যেতে পারে।“
৮. “ তাদেরকে এদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে যে, আরবদের স্মৃতিশক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, শধুমাত্র স্মৃতি থেকে নকলকৃত বিবরণ কি নির্ভরযোগ্য মনে করা যেতে পারে, অবশেষে বর্তমান আরবদের স্মৃতিশক্তি তদ্রূপই রয়ে গেছে যেরূপ স্মৃতিশক্তি তেরশত বছর পূর্বে তাদের পুর্বপুরুষদের থেকে থাকবে। আজকাল আরবদের যা কিছু স্মরণশক্তি আছে তা আমাদের এই সিদ্ধান্ত পৌছতে এক গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশিকা হিসাব আমাদের কাজে আসতে পারে যে, যেসব রিওয়ায়াত আমাদের পযর্ন্ত পৌছেছে তা সঠিক ও যথার্থ হওয়ার ব্যাপারে কি আস্থা স্থাপন করা যায়?”
৯. “আমাদের বাড়াবাড়ি এবং যেসব বর্ণনাকারীর মাধ্যমে এসব রিওয়ায়াত আমাদের পযর্ন্ত পৌছেছে তাদের নিজস্ব ধ্যানধারণা ও গোঁড়ামিও অবশ্যই ব্যাপক আকারে রিওয়ায়াত নকল করতে গিয়ে তাকে কদাকার করে থাকবে। শব্দসমষ্টি যখন এক মস্তক থেকে অন্য মস্তকে স্থানান্তরিত হয়, সেই মস্তক চাই আরবদের হোক বা অপর কারো, মোটকথা এই শব্দভান্ডারে এমন পরিবর্তন মূচীত হয় যা প্রতিটি মস্তিষ্কের নিজস্ব ছাঁচের ফলশ্রুতি হয়ে থাকে। প্রতিটি মস্তিষ্ক অতিক্রম করে আসে তখন যে কোন ব্যক্তি ধারণা করতে পারে যে, তার মধ্যে কত ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
উল্লেখিত কারণসমূহের সমলোচনা
এই নয়টি দফা আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির নিজের বাক্যে তার নিজস্ব ধারাবাহিকতা অনুযায়ী উধৃত করলাম। এখন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যায়ন করে দেখব, এগুলো কতটা সঠিক এবং এগুলোকে হাদীসসমূহের উপর আস্থা স্থাপন না করার এবং সুন্নাতকে দলীল-প্রমাণ হিসাবে না মানার ব্যাপারে যুক্তি হিসাবে কতটা গ্রহণ করা যায়?
জাল হাদীস কি ইসলামী আইনের উৎস পরিণত হয়েছে?
সর্বপ্রথম তার ১নং ও ৭নং দফার উপর আলোকপাত করব। জাল হাদীসসমূহের একটি বিরাট স্তুপ ইসলামী আইনের উৎসের মধ্যে প্রবেশ করার বিষয়টি ইসলামের সকল ফকীহ ঐক্যবদ্ধভাবে মেনে নিয়েছেন-তার দাবী বাস্তব ঘটনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলামের ফকীহগণ নিসন্দেহে একথা স্বীকার করেন যে প্রচুর জাল হাদীস ইসলামী আইনের উৎসে পরিণত হয়েছে, তবে এ ধরনের মাত্র একজন ফকীহ অথবা মুহাদ্দিস অথবা নির্ভরযোগ্য আলেম দীনের নাম আমাদের বলা হোক। ঘটনা এই যে, জাল হাদীস যখন থেকে প্রকাশ পেতে শুরু করে তখন থেকেই মুহাদ্দিসগণ, মুজতাহিদ ইমামগণ এবং ফকীহগণ নিজেদের সার্বিক প্রচেষ্টা এদিক নিয়োজিত করেন যে, এই দুর্গন্ধময় নর্দমা যেন ইসলামী আইনের সূত্রসমূহের মধ্যে প্রবাহিত হতে না পারে। যেসব হাদীসের সাহায্যে শরীআতের কোন বিধান প্রমাণিত হত, সে সব হাদীসের পর্যলোচনা ও তথ্যানুসন্ধানেই বেশীরভাগ তাদের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যয় করা হয়। ইসলামী বিচারালয়ের বিচারকগণও সদা সতর্ক ছিলেন যে, কেবলমাত্র
(রসূলুল্লাহ বলেন)” শুনেই যেন তারা কোন ফৌজদারী অথবা দেওয়ানী মামলার রায় না দেন, বরং তার পূর্ণ যাচাই-বাছাই করতেন, যার আলোকে কোন অপরাধী নিস্কৃতি পেতে পারে অথবা তা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। ইসলামের প্রাথমিক কালের আদালতের হাকীমগণ ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের বিজ্ঞ বিচারপতি এবং তাদের সহকর্মীদের তুলনায় কিছু কম সতর্ক ছিলেন না। শেষ পযর্ন্ত তাদের জন্য এটি কি কের সম্ভব ছিল যে, প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ব্যতীত কোন জিনিসকে অইনগত নির্দেশ মেনে নিয়ে তারা রায় প্রদান করে বসেছেন? আর মামলার পক্ষদ্বয়ই বা কিভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ছাড়াই কোন কাচাপাকা রিওয়ায়াতের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করা হবে? অতএব একথাও বাস্তবিকই সত্য নয় যে, ইসলামী আইনের উৎসের মধ্যে জাল হাদীসের অনুপ্রবশ ঘটেছে এবং ইসলামের ফকীহগণও এই অনুপ্রবেশকে একমত হয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন।
মহানবী (স) এর যুগেই কি জাল হাদীসের প্রচলন শুরু হয়েছিল?
বিজ্ঞ বিচারপতি একথাও চরম বিভ্রান্তিকর যে, জাল হাদীস স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স) এর যুগে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। মূলত এর রহস্য এই যে, জাহিলী যুগে এক ব্যক্তি মদীনাস্থ কোন এক গোত্রের কন্যাকে বিবাহ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু কন্যাপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। হিজরতের পর প্রথমদিকেই ঐ ব্যক্তি একটি জুব্বা পরিধান করে সেই গোত্রে গিয়ে পৌছে এবং কন্যাপক্ষের নিকট গিয়ে বলে যে, রসূলুল্লাহ (স) নিজে আমাকে এই জুব্বা পরিধান করিয়েছেন এবং আমাকে অত্র গোত্রের প্রশাসক নিয়োগ করেছেন। গোত্রের লোকেরা তাকে বাহন থেকে নামিয়ে নিল এবং গোপনে ব্যাপারটি মহানবী (স) কে অবহিত করে। মহানবী (স) বলেন, “মিথ্যা বলেছে আল্লাহর এই দুশমন। ” অতপর তিনি এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন, যাও-তাকে যদি জীবন্ত পাও হত্যা কর, আর যদি মৃত পাও, তার লাশ আগুণে জ্বালিয়ে দাও। এই ব্যক্তি সেখানে পৌছে দেখে যে, তাকে সাপে কামড় দিয়েছে, ফলে সে মারা গেছে। অতএব নির্দেশ অনুযায়ী তার লাশ আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এরপর মহানবী (স) সাধারণ্যে ঘোষণা দিতে থাকেন, যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলে সে দোযখে যাওয়ার জন্য যেন প্রস্তুত হয়ে যায়।১ উপরোক্ত কঠোর সর্ততামূলক কার্যক্রমের ফল এই হয়েছিল যে, প্রায় ৩০-৪০ বছরের মধ্যে মনগড়া হাদীস ছড়ানোর কোন ঘটনা আর ঘটেনি।
হযরত উমার (রা) অধিক হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন কেন?
বিচারপতি সাহেবের একথাও একটি প্রমাণহীন দাবী যে, হযরত উমার (রা) যুগ পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে জাল হাদীসের সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে হযরত উমারকে হাদীস বর্ণনার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হল, বরং তা সম্পুর্ণ বন্ধ করে দিতে হল।
উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে যদি কোন ঐতিহাসিক প্রমান বিদ্যামান থাকে তবে অনুগ্রহপূর্বক তার বরাত উল্লেখ করা হোক। সে যুগে বাস্তবিকই মনগড়া হাদীসের কোন ফেতনাই উত্থিত হয়নি। ইতিহাসে এর কোন প্রকার উল্লেখ নেই। হযরত উমার (রা) যে কারণে অধিক হাদীস বর্ণনা পছন্দ করতেন না তা মূলত এই যে, দক্ষিণ আরবের সমান্য এলাকা ব্যতীত ঐ সময় পর্যন্ত আরব দেশে কুরআন মজীদের ব্যাপক প্রচার হয়নি। আরবের বেশীর ভাগ এলাকা মহানবী (স) এর পবিত্র জিন্দেগীর শেষাংশে ইসলামের প্রভাবাধীনে এসেছিল এবং আরবেই সাধারণ নাগরিকদের শিক্ষার ব্যবস্থা তখানও পূর্ণভাবে শুরু হতে পারেনি। এই অবস্থায় মহানবী (স) এর ইন্তেকাল এবং তারপরে হযরত আবু বাকর (রা) -র খেলাফতকালে ধর্মতক্যাগীদের বিশৃংখলার প্রাদুর্ভাবহওয়ার একাজ এলোমেলো হয়ে যায়। হযরত উমার (রা) যুগেই মুসলমানগণ নিশ্চিন্তে সর্বসধারণের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পান। এসময় গোটা জাতিকে সর্বপ্রথম কুরআনের জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া অধিক জরুরী ছিল এবং কুরআনের সাথে অন্য কোন জিনিসের বিভ্রাট সৃষ্টির আশংকা হওয়ার মত কাজ তখন বন্ধ রাখা দরকার ছিল। যেসব সাহাবী মহানবী (স) এর পক্ষ থেকে লোকদের নিকট কুরআন পৌছিয়ে দিচ্ছিলেন তারাই যদি সাথে সাথে মহানবী (স) এর বর্ণনা করতে থাকতেন তবে বেদুঈনদের এক বিরাট অংশের হাদীসের সাথে কুরআনের আয়াতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মুখস্ত করে নেয়ার আশংকা ছিল। এই সার্বিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কথা হযরত উমার (রা) এক স্থানে নিজেই বর্ণনা করেছেন।
উরওয়া ইবনুয যুবাইর (রহ) বলেন, “হযরত উমার (রা) একবার রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতসমূহ লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ সম্পর্কে তিনি সাহাবীদের পরামর্শ নিলেন। সকলে মত ব্যক্ত করেন যে, একাজ অবশ্যই করা উচিৎ। কিন্তু হযরত উমার (রা) লেখার কাজ শুরু করার ব্যাপারে একমাস পর্যন্ত দ্বিধাদ্বদেন্দ্ব অতিবাহত করেন এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে থাকেন যে, যে জিনিসের মধ্যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে সেদিকে যেন তিনি তাকে পথ প্রদর্শন করেন। অবশেষে একমাস পর তিনি একদিন বলেন, “আমি সুন্নাতসমূহ লিপিবদ্ধ করার সংকল্প করেছিলাম কিন্তু আমার ধারণা হল যে, তোমাদের পূর্বে একদল লোক অতিবাহিত হয়ছে, যারা অন্যান্য গ্রন্থ লিখেছিল কিন্তু আল্লাহর কিতাব ত্যাগ করেছিল। অতএব আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে অন্য জিনিস শামিল হতে দেব না-” (তাদরীবুর –বারী, পৃ. ১৫১, বায়হাকীর আল-মাদখাল-এর বরাতে)।
১.সুপ্রসিদ্ধ মহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনে আদী তার “আল-কামিল ফী মারিফাতিদ- দুআফা ওয়াল- মাতরুকীন” শীর্ষক গ্রন্থে এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (রহ)-এর ছয় লক্ষ হাদীসের কল্পকাহিনী
বিজ্ঞা বিচারপতির আরও একটি বক্তব্য যা মারাত্বক ভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে তা এই যে, “ইমাম বুখারী (রহ) ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্যে নয় হাজার হাদীসকে সহীহ হিসাবে বাছাই করেছেন।”
উপরোক্ত বক্তব্যে কোন ব্যক্তি প্রভাবিত হয়ে বলতে পারে যে, ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্যে তো মাত্র নয় হাজার সহীহ হাদীস ছিল যা ইমাম বুখারী (রহ) গ্রহণ করেছেন এবং অবশিষ্ট ৫,৯১,০০০ জাল হাদিস উম্মাতের মধ্যে ছড়িয়েছিল। অথবা বাস্তব অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায়য় মূলত একটি ঘটনা যদি ধারাবাহিক সনদসূত্রে বর্নিত হয়, তবে তা একটি হাদীস এবং ঐএকটি হাদীস যদি উদহরণস্বরূপ ১০,২০ অথবা ৫০ টি হাদিস বলা হয়। ইমাম বুখারী (রহ) এর যুগ পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে মহানবী (স) এর এক একটি হাদসি এবং তার জীবনের এক একটি ঘটনা অসংখ্য রাবী বহু সনদসূত্রে বর্ণনা করতেন এবং এভাবে কয়েক হাজার হাদীস কয়েক লক্ষ হাদীসের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ইমাম বুখারী (রহ) এর নীতি এই ছিল যে, তিনি কোন ঘটনা যতগুলো সনদসূত্রে জ্ঞাত হতেন- সেগুলোকে যথার্থতা যাচাই করার নিজস্ব শর্তাবলী (অর্থাৎ বর্ণনা সূত্রের যথার্থতা, আসল ঘটনার যথার্থতা নয়) মোতাবেক যাচাই-বাছাই করতেন এবং তার মধ্যে সনদ (বর্ণনা সূত্র) অথবা যেসব সনদ সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মনে করতেন তা বেছে নিতেন। কিন্তু তিনি কখনও এই দাবি করেননি যে, যেসব হাদীস তিনি বেছে নিয়েছেন এ পর্যন্তই সহীহ এবং অবশিষ্ট সমস্ত রিওয়ায়াত সহীহ নয়।১ তার নিজের বক্তব্য এই যে, “আমি আমার গ্রন্থে এমন কোন হদীস স্থান দেইনি যা সহীহ নয়, কিন্তু গ্রন্থের কলেবর বিরাট হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক সহীহ হাদীসও বাদ দিয়েছি ” [তারীখ বাগদাদ , ২খ.পৃ. ৮-৯ তাহযীবুন-নববী, ১খ.পৃ.৭৪ তাবাকাতুস-সুবকী, ২খ, ৭১]। বরং আরও এক স্থানে তিনি এর ব্যাখ্যাদান প্রসংগে বলেন, “আমি যেসব সহীহ হাদীস বাদ দিয়েছি তা সংখ্যায় আমার বেছে নেয়া হাদীসের চেয়ে অধিক”। আরও এই যে, “আমার এক লক্ষ সহীহ হাদীস মুখস্ত আছে-” (শুরূতুল-আইম্মাতিস-সিত্তা, পৃ.৪৯। প্রায় এই একই কথা ইমাম মুসলিম (রহ) ও বলেছেন। তার বক্তব্য এই যে, “আমি আমার গ্রন্থে যেসব হাদীস একত্র করেছি তাকে আমি সঠিক বলে দাবী করি। কিন্তু আমি কখনও একথা বলি না যে, আমি যেসব হাদীস নেইনি তা যঈফ বা দুর্বল”-(তাওজীহুন-নযর,পৃ.৯১)।
জাল হাদীস কেন রচনা করা হয়েছিল?
বিজ্ঞ বিচারপতি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে জোর দিয়ে বলেছেন, হাজার হাজার জাল হাদীস রচনা করা হয়েছিল এবং তিনি একথার উপরও জোর দিয়েছেন যে, তথ্যানুসন্ধানী পর্যালোচকগণ যেন এ সম্পর্কে বিশেষভাবে চিন্তাভাবনা করেন।
কিন্তু আমাদের নিবেদন এই যে, তথ্যানুসন্ধানী পর্যালোচকগণকে সাথে সাথে এই প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীর চিন্তাভাবনা করতে হবে যে, এই হাজার হাজার জাল হাদীস শেষ পর্যন্ত ঐ যুগে কেন রচনা করা হয়েছিল? তা রচনার কারণ তো এটাই ছিল যে, মহানবী (স)-এর কথা ও কাজ হুজ্জাত (দলীল-প্রমাণ) ছিল এবং একটি মনগড়া কথা তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে মিথ্যুক লোকেরা কোন না কোন স্বার্থ সিদ্ধি করতে চেয়েছিল। মহানবী (স)-এর কথা ও কাজ যদি হুজ্জাত না হত এবং কোন ব্যক্তির জন্য নিজের কোন দাবীর পক্ষে কথা রচনার কষ্ট স্বীকার করার কি প্রয়োজন ছিল? দুনিয়াতে কোন জাল বস্তু রচনাকারী তো এমন জাল মুদ্রা তৈরী করে যা বাজারে চালানো যেতে পারে। যে মুদ্রার কোন মর্যাদা ও মূল্যই নাই তার নকল শেষ পর্যন্ত কোন নির্বোধ তৈরী করে? যদি ধরে নেয়া হয় যে, কোন সময় জালিয়াতদের কোন গ্যাং দেশে প্রচলিত মুদ্রার হাজার হাজার নকল তৈরী করে ফেলেছে তবে এর উপর ভিত্তি করে কারো এরূপ যুক্তি প্রদান কি সঠিক হবে যে, দেশে প্রচলিত সমস্ত মুদ্রা তুলে নিয়ে ফেলে দেয়া উচিৎ, কারণ জাল মুদ্রার বর্তমানে কোনো মুদ্রা সম্পর্কেই আস্থা স্থাপন করা যায় না? দেশের প্রত্যেক কল্যাণকামী নাগরিক তো সাথে সাথে এসব জালিয়াতকে গ্রেপ্তার করার এবং দেশের মুদ্রাকে এই বিপদ থেকে রক্ষার চিন্তায় লেগে যাবে।
ইসলামের প্রাথমিক কালে জাল হাদীসের ফেতনার প্রাদুর্ভাব হওয়ার সাথে সাথে ইসলামের কল্যাণকামী লোকেরা ঠিক একই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁরা তৎক্ষনাৎ কর্মতৎপর হন এবং প্রতিটি জাল হাদীস রচনাকারীর সন্ধানপূর্বক তার নাম “আসমাউর রিজাল” শিরোনামের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন, এক একটি জাল হাদীসের অনুসন্ধানপূর্বক –এজাতীয় মাওদ (মনগড়া) হাদীসের সংকলন তৈরী করেছেন, হাদীসসমূহের যথার্থতা ও দোষত্রুটি যাচাইয়ের জন্য অত্যন্ত কঠোর নীতিমালা প্রণয়নপূর্বক লোকদেরকে সহীহ ও জাল হাদীসের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের যোগ্য করে তোলেন এবং কোন সময়েও যেন জাল হাদীস ইসলামী আইনের উৎসে অনুপ্রবেশ না করতে পারে সে পথ রুদ্ধ করে দেন। অবশ্য সেই যুগেও হাদীস অস্বীকারকারীদের চিন্তা পদ্ধতি এইরূপ ছিল যে, আইনের উৎসে গলদ হাদীস অনুপ্রবেশ করার ফলে গোটা হাদীস ভাণ্ডার সন্দেহযুক্ত হয়ে গেছে, অতএব সমস্ত হাদীস তুলে নিয়ে ফেলে দিতে হবে। তারা এতটুকুও গ্রাহ্য করেনি যে, রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতসমূহ পরিত্যাগ করলে ইসলামী আইনের উপর কি পরিমাণ ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে এবং স্বয়ং ইসলামের কাঠামো কত মারাত্মকভাবে বিকৃত হয়ে পড়ে থাকবে।
যুক্তির তিনটি ভ্রান্ত ভিত্তি
এখন আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির ২, ৩ ও ৪ নম্বর পয়েন্টের উপর আলোকপাত করব। উক্ত তিনটি বিষয়ে তার যুক্তির গোটা ভিত্তি তিনটি জিনিসের উপর স্থাপিত যা স্বয়ং ভ্রান্ত অথবা সত্য থেকে অনেক ভিন্নতর। (এক) রসূলুল্লাহ (স) হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছেন। (দুই) মহানবী (স)-এর যুগে এবং তাঁর পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও কুরআন মজীদ সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা তো হয়েছিল, কিন্তু হাদীসসমূহের সংরক্ষণের প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। (তিন) হাদীসসমূহ সাহাবী ও তাবিঈগণের মনমানসে লুক্কায়িত পড়ে থাকে, তারা কখনও কখনও ঘটনাক্রমে তা অন্যদের সামনে উল্লেখ করতেন এবং এসব রিওয়ায়াত একত্র করার কাজ মহানবী (স)-এর কয়েক শত বচর পর করা হয়েছিল।
বাস্তব ঘটনার বিপরীত এই তিনটি ভিত্তির উপর বিজ্ঞ বিচারপতি প্রশ্নের ভংগিতে এই সিদ্ধান্তের দিকে আমাদের পথনির্দেশ করেন যে, হাদীসের সাথে এই আচরণ এজন্য করা হয়েছে যে, তা মূলত সাময়িক গুরুত্বের অধিকারী ছিল, গোটা পৃথিবীবাসীর জন্য অথবা সর্বকালের জন্য তাকে আইনের উৎস বানানোর উদ্দেশ্য ছিল না। যে তিনটি কথার উপর এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে তার মধ্যে সত্যের কতটুকু উপাদান আছে এবং তা থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত স্বয়ং কতটা সঠিক, সম্মুখের আলোচনায় তা আমরা মূল্যায়ন করে দেখব।
হাদীস লিপিবদ্ধ করার প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা ও তার কারণসমূহ
বিজ্ঞ বিচারপতি রসূলুল্লাহ (স)-এর যে দুটি হাদীসের বরাত দিয়েছেন তাতে শুধুমাত্র হাদীস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছিল, তা মৌখিকভাবে বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়নি, বরং এর মধ্যে একটি হাদীসে তো মহানবী (স) পরিস্কার বাক্যে বলেছেনঃ (আরবী**************************)
“আমার বাণী মৌখিকভাবে বর্ণণা কর, এতে কোন আপত্তি নেই”।
কিন্তু শুধুমাত্র এই দুটি হাদীস গ্রহণপূর্বক তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং একই প্রসংগে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী উপেক্ষা করা মূলতই ভ্রান্ত পদ্ধতি। এ প্রসংগে প্রথমে যে কথা অবগত হওয়া জরুরী তা এই যে, মহানবী (স) যে যুগে প্রেরিত হয়েছিলেন তখন গোটা আরব জাতিই ছিল অশিক্ষিত এবং নিজেদের যাবতীয় বিষয় মুখস্ত ও বাচনিকভাবে আঞ্জাম দিত। কুরাইশের মত উন্নত গোত্রের অবস্থা ঐতিহাসিক বালাযুরীর বর্ণনা অনুযায়ী এই ছিল যে, তাদের মধ্যে মাত্র ১৭ ব্যক্তি পড়ালেখা জানত। বালাযুরীরই বক্তব্য অনুসারে মদীনায় ১১ ব্যক্তির অধিক লেখাপড়া জানা লোক ছিল না। লেখার জন্য কাগজ ছিল দুষ্প্রাপ্য। পাতলা চামড়া, হাড় ও খেজুর পাতার উপর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হত। এই অবস্থায় মহানবী (স) যখন প্রেরিত হন তখন তাঁর সামনে সর্বপ্রথম কাজ এই ছিল যে, কুরআন শরীফ এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে এর মধ্যে অন্য কোন জিনিসের সংমিশ্রণ ঘটতে না পারে। লেখক ছিল মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন, তাই তাঁর আশংকা ছিল যে, যেসব লোক ওহীর শব্দভাণ্ডার ও আয়াতসমূহ লিপিবদ্ধ করছে, তারাই যদি আবার তাঁর নিকট থেকে শুনে তাঁর বরাতে অন্য জিনিসও লিখে নেয় তবে কুরআন মিশ্রণ থেকে নিরাপদ থাকবে না। সংমিশ্রণ না ঘটলেও অন্তত সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে যে, একটি বক্তব্য তা কুরআনের আয়াত না মহানবী (স)-এর হাদীস। এ কারণে মহানবী (স) প্রাথমিক যুগে হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন।
হাদীস লিপিবদ্ধ করার সাধারণ অনুমতি
কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। মদীনা তায়্যিবায় পৌঁছার সামান্য কাল পরেই নিজের সাহাবীদের এবং তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করেন এবং যখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক লেখাপড়া শিখে ফেলল তখন তিনি হাদীস লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিলেন। এ প্রসংগে নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াতসমূহ নিম্নে উলেঊলখ করা হল।
১. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সা) –এর নিকট যা কিছু শুনতাম তা লিপিবদ্ধ করে নিতাম। লোকেরা আমাকে নিখতে নিষেধ করল এবং বলল, রসূলুল্লাহ (স) একজন মানুষ, কখনও শান্ত অবস্থায় কথা বলেন, আবার কখনও রাগান্বিত অবস্থায় কথা বলেন। তুমি সবকিছুই লিখে নিচ্ছ? এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মহানবী (স) –এর নিকট জিজ্ঞাসা না করা পর্যন্ত তাঁর কোন কথাই লিখব না। অতপর আমি মহানবী (সা)-এর নিকট জিজ্ঞেস করলে তিনি নিজের ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বলেনঃ (আরবী**********************************************)
২. আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আনসারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আবেদন করেন, “আমি আপনার নিকট অনেক কথাই শুনি, কিন্তু মনে রাখতে পারি না”।
মহানবী (স) বলেনঃ (আরবী****************************)
“তোমার যান হাতের সাহায্য লও”। অতপর তিনি নিজের ডান হাতের ইশারায় বলেন, লিখে নাও –(তিরমিযী)।
৩. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। মহানবী (স) একটি ভাষণ দিলেন। পরে (ইয়ামনের অধিবাসী) আবু শাহ আরজ করেনঃ আমাকে ভাষণটি লিখে দিন। মহানবী (স) নির্দেশ দেনঃ (আরবী****************) আবু শাহকে লিখে দাও –(বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী)। হযরত আবু হুরায়রা (রা)-র অপর বর্ণনায় এই ঘটনা বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (স) একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি মক্কার হেরেম শরীফ ও নরহত্যার ব্যাপারে কতিপয় বিধান বর্ণনা করেন। ইয়ামনের এক ব্যক্তি (আবু শাহ) উঠে দাঁড়িয়ে আবেদন করল, আমাকে ভাষণটি লিখিয়ে দিন। মহানবী (স) নির্দেশ দেনঃ ভাষণটি তাকে লিখে দাও –(বুখারী)।
৪. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবীদের মধ্যে আমার চেয়ে অধিক হাদীস আর কারো কাছে ছিল না। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) এর ব্যতিক্রম ছিলেন। কারণ তিনি হাদীস লিখে রাখতেন, কিন্তু আমি লিখে রাখতাম না –(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ)।
৫. বিভিন্ন ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-কে জিজ্ঞাসা করে এবং একবার তিনি মিম্বরের উপর থাকা অবস্থায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার নিকট কোন জ্ঞান আছে কি যা মহানবী (স) বিশেষভাবে আপনাকে দান করেছেন? তিনি উত্তর দেনঃ না, আমার নিকট শুধু আল্লাহর কিতাব রয়েছে এবং এই কয়েকটি বিধান আছে যা আমি মহানবী (স) –এর নিকট শুনে লিখে নিয়েছি। অতপর তিনি লিখিত বিষয় বের করে দেখান। এর মধ্যে যাকাতের বিধান, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান (আরবী**********) মদীনার হেরেম, এবং অনুরূপ আরো কতিপয় বিষয় সম্পর্কে বিধান লিপিবদ্ধ ছিল –(বুখারী, মুসলিম, আহমাদ ও নাসাঈ এ বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন রিওয়ায়াত বিভিন্ন সনদসূত্রে বর্ণনা করেছেন)।
এছাড়া মহানবী (স) তাঁর প্রশাসকবৃন্দের নিকট বিভিন্ন এলাকায় ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিধান, যাকাত ও মীরাস সম্পর্কিত বিধান বিভিন্ন সময় লিখিতভাবে পাঠাতেন। এসব সম্পর্কে আবু দাউদ, নাসাঈ, দারু কুতনী, দারিমী, তাবাকাতে ইবনে সাদ, আবু উবাদের কিতাবুল আমওয়াল, আবু ইয়ূসুফের কিতাবুল খারাজ এবংইবনে হাযমের আল-মুহাল্লা ইত্যাদি গ্রন্থাবলী দেখা যেতে পারে।
হাদীসসমূহ মৌখিকভাবে বর্ণনা করার প্রতি উৎসাহ প্রদান, বরং গুরুত্ব আরোপ
এ হলো হাদীস লিপিবদ্ধ করার প্রকৃত অবস্থা। কিন্তু আমরা যেমন ইতিপূর্বে বলে এসেছি যে, আরবজাতি হাজারো বছর ধরে নিজেদের কাজ লিখিতভাবে করার পরিবর্তে স্মৃতিশক্তি, ধারাবাহিক বর্ণনা ও মৌখিক কথনের মাধ্যমে পারিচালিত করতে অভ্যস্ত ছিল এবং ইসলামের প্রাথমিক কালেও কয়েক বছর পর্যন্ত তাদের এই অভ্যাস অপরিবর্তিত থাকে। এই অবস্থায় কুরআন মজীদ সংরক্ষণের জন্য তো লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা হয়েছিল, কারণ তার প্রতিটি শব্দ, আয়াত ও সূরা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সংরক্ষণ করা উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু হাদীসের ব্যাপারে এ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়নি। কারণ তাতে সুনির্দিষ্ট শব্দাবী এবং তার বিশেষ ধারাবাহিক ওহী হওয়ার দাবী ছিল না এবং এরূপ ধারণাও ছিল না, বরং শুধুমাত্র তাতে উল্লেখিত বিধান, শিক্ষা ও হেদায়াতসমূহ স্মরণ রাখা ও অন্যদের নিকট পৌছে দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য যা সাহাবীগণ মহানবী (স)-এর নিকট থেকে লাভ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে বর্ণনা করার শুধু খোলা অনুমতিই ছিল না, বরং অসংখ্য হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (স) লোকদেরকে তা মৌখিকভাবে বর্ণনা করার পুনপুন এবং অসংখ্য বার তাকিদ দিয়েছেণ। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
১. যায়েদ ইবনে সাবেত, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জুবাইর ইবনে মুতঈম এবং আবুদ-দারদা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) মহানবী (স)-এর নিন্মোক্ত বাণী উদ্ধৃত করেছেনঃ
(আরবি**********************)
“আল্লাহ সেই ব্যাক্তকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন- যে আমার কোন হাদীস শুনেছে এবং অন্যদের নিকট পৌছে দিয়েছে। কখনও এমনও হয়ে থাকে যে, কোন ব্যক্তি জ্ঞানের কথা এমন কোন ব্যক্তির নিকট পোছিয়ে দেয়-যে তার চেয়ে অধিক জ্ঞানবান। আর কখনও হয় যে, কোন ব্যক্তি স্বয়ং ফকীহ না হলেও ফকহ বহনকারী হয়ে থাকে, অথবা জ্ঞানী না হলেও জ্ঞানের বাহক হয়ে থাকে”- ( আবু দাউদ, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজা দারিমী)
২. আবু বাকরাহ (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবি*******************************************)
“উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিত লোকদের পযর্ন্ত পৌছিয়ে দেয়। হয়ত সে এমন কোন ব্যক্তির নিকট পৌছে দেয়, যে তার চেয়ে অধিক স্মরণ রাখতে পারে”-( বুখারী, মুসলিম)
৩. আবু শুরায়হ (রা) বলেন, মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয় দিন মহনবী (স) ভাষণ দেন যা আমি নিজ কানে শুনেছি ও উত্তরমরূপে স্মরণ রেখেছি এবং সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে বন্দী হয়ে আছে। ভাষণ শেষে মহানবী (স) বলেনঃ
(আরবি***************************)
“উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌছে দেয়” (বুখারী)।
৪. বিদায় হজ্জের সময়ও মহানবী (স) ভাষণ প্রায় উত্তমরূপে কথা বলেছেন যা উপরের দুটি হাদীসে উল্লেখ হয়েছে-(বুখারী)।
৫. আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিদল বাহরাইন থেকে এস মহানবী (স)-এর সাথে সাক্ষাত করে। তারা বিদায়ের প্রক্কালে আবেদন করেনঃ আমরা অনেক দূরের অধিবাসী, আমাদেরও আপনার মাঝখানে কাফেদের বসতি রয়েছি। আমরা কেবল হারাম মাসসমূহেই আপনাদের নিকট আসার সুযোগ পাই। অতএব আপনি আমাদের এমন কিছু উপদেশ দান করুন যা আমরা প্রত্যাবর্তন করে নিজেদের গোত্রের লোকদের পৌছিয়ে দেব এবং জান্নাতের হকদার হতে পাবে। মহানবী (স) তাদেরকে দীন ইসলামের কতিপয় বিধান শিখিয়ে দিয়ে বলেনঃ
(আরবি***************************)
‘এগুলো স্মরণ রাখ এবং তোমাদের ওখানকার লোকদের পযর্ন্ত পৌছে দাও”-(বুখারী মুসলিম)।
উপরের এসব নির্দেশবাণী এবং তাকিদ থেকে কি একথা প্রমাণ হয়ে যে, মহানবী (স) হাদীস বর্ণনা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে চাইতেন না? অথবা তিনি এগুলোকে সাময়িক বিধান মনে করতেন এবং চাইতেন না যে, তা লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক এবং সাধারণ অবস্থার উপর তার প্রয়োগ হতে থাকুক?
জাল হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী
কথা শুধু এতটুকুই নয় যে, মহানবী (স) তাঁর হাদীসের প্রচার ও প্রসারের জন্য তাকিদ দিতেন, বরং সাথে সাথে তিনি এসব হাদীসের পূর্ণ সংরক্ষণের জন্য এবং তার সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ থেকে দূরে থাকার কঠোর তাকিদ দেন। এই প্রসংগে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
আবদুল্লাহ ইবনে আমর, আবু হুরায়রা, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম ও আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
“যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার নামে মিথ্যা কথা রচনা করে সে যেন নিজের বাসস্থান জাহান্নামে বানিয়ে নিল”-(বুখারী, তিরমিযী)।
আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা) বর্ণনা করেন যে, মহানবী (স) বলেনঃ
(আরবী***********************************************************)
“আমার হাদীস বর্ণনা কর তাতে কোন আপত্তি নাই। কিন্তু যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকবাবে আমার নামে মিথ্যা কথা রচনা করে সে যেন জাহান্নামে নিজের আবাস বানিয়ে নিল”-(মুসলিম)।
ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ ও জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
“আমার পক্ষ থেকে কোন কোন কথা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাক –যতক্ষণ না জানতে পার যে, তা আমি বলেছি। কারণ যে ব্যক্তি কোন মিথ্যা কথা আমার সাথে সংশ্লিষ্ট করে যে যেন জাহান্নামকে তার বাসস্থান বানিয়ে নিল” (তিরমিযী, ইবনে মাজা)।
হযরত আলী (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
”আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বল না। কারণ যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলবে সে দোযখে প্রবেশ করবে” –(বুখারী)।
হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া (রা) বলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
“আমি মহানবী (সা) –কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে এমন কথা বলে যা আমি বলিনি, সে জাহান্নামে নিজের বাসস্থান করে নিল”-(বুখারী)।
বারংবার এই ভীতি প্রদর্শন থেকে কি প্রমাণিত হয় যে, দীন ইসলামে মহানবী (স)-এর বাণীসমূহের কোনই গুরুত্ব ছিল না? দীন ইসলামে যদি তাঁর বাণীসমূহের কোন আইনগত মর্যাদা না থাকত এবং তার দ্বারা দীনের বিধানসমূহ প্রভাবিত হওয়ার আশংকা না থাকত তবে জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে লোকদের মিথ্যা হাদীস রচনা থেকে বিরত রাখার কি প্রয়োজন ছিল? রাজা-বাদশাহ ও নেতাদের সাথে ইতিহাসে অনেক ভ্রান্ত কথা যুক্ত হয়ে যায়। তার দ্বারা অবশেষে দীনের উপর কি প্রভাব পড়ে। মহানবী (স)-এর সুন্নাতেরও যদি এইরূপ মর্যাদা হয়ে থাকে তবে তাঁর ইতিহাস বিকৃত করার অপরাধে কোন ব্যক্তির দোযখের শাস্তি কেন হবে?
মহানবী (স) –এর সুন্নাত আইনের উৎস হওয়ার অকাট্য প্রমাণ
এ প্রসংগে সবচেয়ে বড় কথা হলঃ কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সুস্পষ্ট বক্তব্য বর্তমান থাকলে সে সম্পর্কে অপ্রাসংগিক জিনিসসমূহ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনই অবশিষ্ট থাকে না। আল্লাহ তাআলা পরিস্কার বাক্যে তাঁর রসূলকে আল্লাহর কিতাবের ভাষ্যকারের এখতিয়ারও প্রদান করেছেন এবং আইন প্রণয়নের এখতিয়ারও প্রদান করেছেন। ইতিপূর্বে উল্লেখিত সূরা নাহল-এর ৪৪ নং আয়াত, সূরা আরাফের ১৫৭ নং আয়াত এবং সূরা হাশর –এর ৭ নং আয়াত এ প্রসংগে সম্পূর্ণ পরিস্কার বক্তব্য প্রদান করেছে। তাছাড়া মহানবী (স) –ও স্পষ্ট বাক্যে নিজের এসব এখতিয়ারের বর্ণনা দিয়েছেন। আবু রাফে (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
”না, আমি অবশ্যই তোমাদের মধ্যে এমন লোক পাব যে নিজের আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে থাকবে এবং তার নিকট আমার নির্দেশাবলীর মধ্যে কোন নির্দেশ পৌঁছানো হবে, যার মাধ্যমে আমি কোন কাজ করার বা না করার নির্দেশ দিয়েছি, আর সে তা শুনে বলবে, আমি জানি না; যা কিছু আল্লাহর কিতাবে পাব কেবল তার অনুসরণ করব” –(মুসনাদে আহমাদ, শাফিঈ, তিরমিযী, আবু দাঊদ, ইবনে মাজা, বায়হাকীর দালাইলুন-নুবূওয়াহ)।
মিকদাম ইবনে মাদীকারাব (রা) থেকে বর্ণিত। মহানবী (স) বলেনঃ
(আরবী**************************************************************)
”সাবধান! আমাকে কুরআন দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে এর অনুরূপ আরও একটি জিনিস। সাবধান! এমন যেন না হয় যে, প্রাচুর্যের গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসমান কোন ব্যক্তি নিজের আরাম কেদারায় বসে বলবে যে, তোমরা কেবল কুরআনের অনুসরণ কর, তাতে যা কিছু হালাল পাবে তা হালাল মানবে এবং যা কিছু হারাম পাবে তা হারাম মানবে। অথচ আল্লাহর রসূল যা কিছু হারাম সাব্যস্ত করেছেন তা মূলত আল্লাহর হারামকৃত বস্তুর সমান। সাবধান! তোমাদের জন্য গৃহপালিত গাধা হালাল হয় এবং নখরযুক্ত হিংস্র জন্তুও তোমাদের ন্য হালাল নয়-[এই শেষের বাক্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কতিপয় লোক গাধা, কুকুর ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণী এই যুক্তিতে হালাল প্রমাণের চেষ্টা করে থাকবে যে, কুরআনে এগুলো হারাম হওয়ার কোন বিধানের উল্লেখ নাই। এই কারণে মহানবী (স) উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করে থাকবেন।] –(আবু দাউদ, ইবনে মাজা, দারিমী, হাকেম)।
ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (স) ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বলেনঃ
(আরবী************************************************************)
“তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি কি নিজের আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে একথা মনে করে বসেছে নাকি যে, কুরআনে যা কিছু হারাম করা হয়েছে তা ছাড়া আল্লাহ অন্য কোন জিনিস হারাম করেননি? সাবধান! আল্লাহর শপথ! আমি যেসব নির্দেশ দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি এবং যা কিছু করতে নিষেধ করেছি তাও কুরআনেরই অনুরূপ, অথবা তার অধিক। আহলে কিতাবদের বাড়িতে তাদের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ, তাদের স্ত্রীলোকদের মারধর করা এবং তারা তাদের উপর আরোপিত কর আদায় করার পরও তাদের গাছের ফল খাওয়া আল্লাহ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন-[হাদীসের এই শেষাংশ পরিস্কার বলে দিচ্ছে যে ,কতিপয় মোনাফিক যিম্মীদের উপর হস্তক্ষেপ করে থাকবে এবং কুরআনের আশ্রয় নিয়ে বলে থাকবে যে ,দেখাও তো কুরআনের কোথাও লেখা আছে যে, আহলে কিতাবদের বাড়িতে প্রবেশ করতে হলে অনুমতির প্রয়োজন আছে? আর কুরআনের কোথায় তাদের নারীদের নির্যাতন করা এবং তাদের বাগানের ফল খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে? এই প্রেক্ষিতে মহানবী (স) উপরোক্ত ভাষণ দিয়ে থাকবেন।] –(আবু দাউদ)।
(আরবী*******************************************************************************)
“যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে, আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই”-(বুখারী, মুসলিম)।
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের এরূপ সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর অবশেষে এই যুক্তির কি ওজন অবশিষ্ট থাকতে পারে যে, হাদীসসমূহ যেহেতু লিপিবদ্ধ করানো হয়নি তা ই তা সাধারণ প্রয়োগের জন্য ছিল না?
লিপিবদ্ধ জিনিসই কি শুধু নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে?
বিজ্ঞ বিচারপটতি বারবার লেখার বিষয়টির উপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরোপ করছেন। মনে হয় যেন তার মতে লিপিবদ্ধ করা ও সংরক্ষণ করা সমার্থবোধক নয়। তার যুক্তির সবচেয়ে বড় ভিত্তি এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, কুরআন লিপিবদ্ধ করে নেয়ার কারণেই তা নির্ভরযোগ্য এবং প্রমাণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য, আর হাদীসসমূহ মহানবী (স)-এর যুগে এবং খেলাফতে রাশেদার যুগে লিপিবদ্ধ না করার কারণে অনির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ হিসাবে গ্রহণের অযোগ্য।
এ প্রসংগে প্রথমত একথা বুঝে নেয়া দরকার যে, কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করিয়ে নেয়ার কারণ এই ছিল যে, তার শব্দভাণ্ডার এবং অর্থ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল। তার শব্দসমষ্টির ক্রমবিন্যাসই নয়, এর আয়াতসমূহের ক্রমবিন্যাস এবং সূরাগুলোর ক্রমবিন্যাসও ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে। তার কোন শব্দ অন্য কোন শব্দের দ্বারা পরিবর্তন করাও জায়েয ছিল না। আর তা এজন্য নাযিল হয়েছিল যে, লোকেরা নাযিলকৃত শব্দযোগে তার ক্রমবিন্যাস রক্ষা করে তা তিলাওয়াত করবে।
পক্ষান্তরে সুন্নাতের ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তা শুধু আক্ষরিক ছিল না, বরং ব্যবহারিকও ছিল। এর শব্দসমষ্টি কুরআনের শব্দসমষ্টির ন্যায় ওহীর মাধ্যমে নাযিল হয়নি, বরং মহানবী (স) তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন। তাছাড়া এর এক বিরাট অংশ এমন ছিল যা মহানবী (স) –এর সমসাময়িক কালের লোকেরা নিজেদের ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন। যেমন, মহানবী (স) –এর চরিত্র-নৈতিকতা এরূপ ছিল, তাঁর জীবন যাপন পদ্ধতি এরূপ ছিল এবং অমুক স্থানে তিনি অমুক কাজ করেছেন ইত্যাদি। রসূলুল্লাহ (স) –এর বাণী ও বক্তুতামালা নকল করার ক্ষেত্রেও এমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না যে, শ্রোতাগণকে তা অক্ষরে অক্ষরে নকল করতে হবে। বরং একই ভাষাভাষী শ্রোতাদের জন্য তাঁর কোন কথা শুনে তার অর্থের পরিবর্তন না করে নিজেদের ভাষায় তা ব্যক্ত করার অনুমতি ছিল এবং এ ব্যাপারে তারা সক্ষমও ছিল। মহানবী (স) –এর বাণীর তিলাওয়াত উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং তাঁর দেয়া শিক্ষার অনুসরণই ছিল উদ্দেশ্য। কুরআনের আয়াতসমূহ ও সূরাসমূহের ক্রমবিন্যাসের মত কোন হাদীস আগে এবং কোন হাদীস পরে হবে এরূপ সংরক্ষণও অত্যাবশ্যকীয় ছিল না। এ কারণে হাদীসসমূহের ক্ষেত্রে এতটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, লোকেরা তা স্মরণ রাখতবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে অন্যদের নিকট পৌঁছিয়ে দেবে। এ ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করার গুরুত্ব ততটা ছিল না –যতটা কুরআনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
দ্বিতীয় কথা যা খুব ভাল করে বুঝে নেয়া প্রয়োজন তা এই যে, কোন জিনিসের দলীল-প্রমাণ হওয়ার জন্য তার লিপিবদ্ধ হওয়াটা একান্তই জরুরী নয়। বিশ্বস্ততার মূল ভিত্তি হচ্ছে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের “নির্ভরযোগ্য হওয়া” যার বা যাদের মাধ্যমে কোন কথা অন্যের নিকট পৌঁছে থাকে –চাই তা লিপিবদ্ধ হোক অথবা অলিখিত আকারে পাঠাননি, বরং মহানবী (স) –এর জবানীতে তা বান্দাদের নিকট পৌঁছিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সমপূর্ণরূপে একথার উপর নির্ভর করেছেন যে, যে ব্যক্তি তাঁর নবীকে সত্য বলে মেনে নিবে সে তাঁর নবীর বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে কুরআনকেও আমার বাণী হিসাবে মেনে নিবে। মহানবী (স)-ও কুরআনের যাবতীয় প্রচার ও প্রসার মৌখিকভাবেই করেছেন। তাঁর যেসব সাহাবী বিভিন্ন জনপদে গিয়ে দীনের প্রচার করতেন তাঁরাও কুরআনের সূরাসমূহ লিখে নিয়ে যেতেন না। লিপিবদ্ধ আয়াত ও সূরাসমূহ তো সেই থলের ভেতর পড়ে থাকত যার মধ্যে তিনি ওহী লেখক সাহাবীদের মাধ্যমে তা লিপিবদ্ধ করে ঢেলে দিতেন। অবশিষ্ট তাবলীগ ও প্রচারের কাজ মৌখিকভাবে করা হত এবং ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তি ঐ এক সাহাবীর বিশ্বস্ততার উপর নির্ভর করে একতা মেনে নিত যে, সে যা কিছু শুনছে তা আল্লাহর কালাম, অথবা সাহাবী রসূলুল্লাহ (স) –এর যে নির্দেশ পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন তা তাঁরই নির্দেশ।
এ প্রসংগে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে –লিপিবদ্ধ জিনিস স্বয়ং নির্ভরযোগ্য হতে পারে না যতক্ষন না জীবিত ও বিশ্বস্ত লোকেরা তার সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। শুধু লিপিবদ্ধ কোন জিনিস যদি আমাদের হস্তগত হয় এবং আমরা মূল লেখকের হাতের লেখার সাথে পরিচিত না হয়ে থাকি অথবা লিপিবদ্ধকারী নিজে না বলে যে, তা তারই হাতের লেখা, অথবা এমন কোন সাক্ষী না পাওয়া যায়, যে এটাকে ঐ ব্যক্তির হাতের লেখা বলে সাক্ষ্য দেবে, তবে ঐ লিপিবদ্ধ জিনিস আমাদের জন্য নিশ্চিত প্রমান হওয়া তো দূরের কথা, অনুমানসর্বস্ব প্রমাণও হতে পারে না। এটা এমন এক নীতিগত সত্য যার প্রতি বর্তমান কালের সাক্ষ্য আইনেরও সমর্থন রয়েছে এবং বিজ্ঞ বিচারপতি নিজেও আদালতে এই নীতি অনুযায়ী কাজ করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কুরআন মজীদ সংরক্ষিত হওয়ার বিষয়ে আমাদের যে নিশ্চিত বিশ্বাস রয়েছে তার ভিত্তি কি এই যে, তা লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল? ওহী লেখকদের স্বহস্তে লিখিত কুরআন যার বক্তব্য মহানবী (স) তাদের বলে দিতেন, আজ দুনিয়ার কোথাও বিদ্যমান নাই। তা যদি বিদ্যমান থাকতও তবে আজ কে তার সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য দিত যে, এটা কুরআনের সেই পাণ্ডুলিপি যা মহানবী (স) স্বয়ং লিপিবদ্ধ করিয়েছেন এবং স্বয়ং একথাও যে, মহানবী (স) ওহী নাযিল হওয়ার পরপরই এই কুরআন লিপিবদ্ধ করাতেন? একথা আমরা কেবল মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমেই জানতে পারি, অন্যথায় এ সম্পর্কে জানার দ্বিতীয় কোন মাধ্যম ছিল না।
অতএব কুরআনের সুসংরক্ষিত হওয়ার উপর আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাসের আসল কারণ তার লিপিবদ্ধ হওয়া নয়, বরং এর আসল কারণ হচ্ছে –জীবিত লোকেরা অব্যাহতভাবে জীবিত লেকাদের নিকট তা শুনে আসছে এবং এরা তাদের পরবর্তীদের নিকট তা হুবহু পৌঁছে দিয়ে আসছে। অতএব কোন জিনিসের সংরক্ষিত হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে তাঁর লিপিবদ্ধ আকারে অবশিষ্ট থাকা, এই ভ্রান্ত ধারণা মনমগজ থেকে বের করে দিতে হবে।
এসব বিষয়ের উপর যদি সম্মানিত বিচারক ও তার মত চিন্তাভাবনাকারী লোকেরা গভীরভাবে চিন্তা করেন তবে তাদের একতা স্বীকার করতে ইনশাআল্লাহ কোন কষ্টই অনুভূত হবে না যে, কোন জিনিস যদি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমসমূহের সাহায্যে প্রাপ্ত হওয়া যায় তবে তা দলীল-প্রমাণ হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা রাখে, তা লিপিবদ্ধ আকারে না রাখা হলেও।
হাদীসসমূহ কি আড়াইশো বছর ধরে অজ্ঞাত প্রকোষ্ঠে পড়ে রয়েছিল?
পুনরায় চার নম্বর দফার শেষদিকে সম্মানিত বিচারপতির বক্তব্য যে, “হাদীসসমূহ না মুখস্ত করা হয়েছিল আর না সংরক্ষণ করা হয়েছিল, বরং তা এমন সব লোকের মনমস্তিষ্কে লুক্কায়িত অবস্থায় ছিল যারা ঘটনাক্রমে কখনও অন্যদের নিকট তা বর্ণনা করে মারা যায়। এমনকি তাদের মৃত্যুর কয়েক শত বছর পর তা সংগ্রহ ও সংকলনাবদ্ধ করা হয়”-এটা শুধু বাস্তব ঘটনারই পরিপন্থী নয়, বরং এটা মূলত মহানবী (স)-এর ব্যক্তিত্বের এবং তাঁর প্রতি প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের বিশ্বাসের চরম অবমূল্যায়ন। বাস্তব ঘটনা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েও কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি প্রয়োগ করেও যদি সঠিক অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা করে তবে সে কখনও বিশ্বাস করতে পারে না যে, যে সুমহান ব্যক্তিত্ব আরব জাতির লোকদেরকে চরিত্র-নৈতিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যকলাপের চরম পশ্চাৎপদতা থেকে তুলে নিয়ে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্য ও কাজকর্মকে সেই লোকেরা এতটা দৃষ্টি দানের অনুপযুক্ত মনে করবে যে, তারা তাঁর কোন কথা স্মরণ রাখার চেষ্টা করেনি, অন্যদের কাছে ঘটনাক্রমে বর্ণনা করা ছাড়া আরেকটু অগ্রসর হয়ে তার চর্চা করেনি এবং পরবর্তী কালের লোকেরাও তাঁর সাক্ষাত লাভকারী লোকদের নিকট তাঁর বিষয়ে জানার জন্য সামান্য চেষ্টাও করেনি। কোন একজন সাধারণ নেতার সাথেও যদি কেউ ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভে সক্ষম হয় তবে সে তার সাথে নিজের সাক্ষাত লাভের প্রতিটি ঘটনা স্মরণ রাখে এবং অন্যদের নিকট গিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধররা তার অবদান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার চেষ্টা করে। বিচারপতি মুহাম্মাদ শফী সাহেব শেষ পর্যন্ত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-কে কোন পর্যায়ের লোক মনে করে নিয়েছেন যে, তাঁর সমসাময়িক কালের এবং এর পরের যুগের লোকেরা তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করার যোগ্যও তাঁকে মনে করেননি?
এখন প্রকৃত অবস্থা কিছুটা খতিয়ে দেখা যাক। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামদের জন্য এমন এক মহান নেতা ছিলেন যাঁর নিকট তাঁরা প্রতিটি মুহুর্তে আকীদা-বিশ্বাস, ঈমান-আমল, ইবাদত-বন্দেগী, নীতি-নৈতিকতা, তাহযীব-তমদ্দুন, আচার-ব্যবহার এবং ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তাঁর জীবনের এক একটি দিকের অনুসরণ করে তাঁরা নিষ্কলুষ লোকদের মত জীবন যাপনের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তাঁরা জ্ঞান ছিলেন যে, তাঁর নবী হয়ে আগমনের পূর্বে তাঁরা কি ছিলেন এবং তিনি তাদের কোন পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। তাদের সামনে আগত প্রতিটি বিষয়ে ফতোয়া দানকারী ছিলেন তিনি ই এবং বিচারপতিও ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই তাঁরা যুদ্ধ করতেন এবং সন্ধিও করতেন। তাদের অভিজ্ঞতা ছিল যে, তাঁর নেতৃত্বের অনুসরণ করে তাঁরা কোথা থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছেছেন। এ কারণে তাঁরা তাঁর প্রতিটি কথা স্মরণ রাখতেন। যাঁরা তাঁর নিকটে থাকতেন তাঁরা অপরিহার্যরূপে তাঁর সাহচর্যে বসে থাকতেন। যাঁদেরকে কখনও তাঁর দরবার থেকে অনুপস্থিত থাকতে হত তাঁরা অন্যদের নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতেন যে আজ তিনি কি কি কাজ করেছেন এবং কি কথা বলেছেন?
দূরদূরান্ত থেকে আগত লোকেরা মহানবী (স)-এর সাহচর্যে যতটুকু সময় অতিবাহিত করার সুযোগ পেতেন তাকে তারা নিজেদের গোটা জীবনের মূলধন করে করতেন এবং জীবনভর তা স্মরণ করতেন। তাঁর সাহচর্যে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ যাদের হত না তারা এমন প্রত্যেক ব্যক্তির চারপাশে সমবেত হত যিনি তাঁর সাহচর্য লাভ করে আসতেন এবং তন্নতন্ন করে প্রতিটি কথা তার কাছ থেকে জেনে নিতেন। যারা তাঁকে কখনও দূর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন অথবা কোন বৃহৎ জনসমাবেশে শুধু তাঁর বক্তৃতা শুনেছিলেন সেই স্মৃতি জীবন ভর ভুলতেন না এবং গৌরবের সাথে নিজের এই সৌভাগ্যের কথা বর্ণনা করতেন যে, আমাদের এই চোখ মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) –এর দর্শন লাভ করেছে এবং আমাদের কান তাঁর ভাষণ শুনেছে। অতপর রসূলুল্লাহ (স)-এর পরবর্তী যুগে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের জন্য দুনিয়াতে যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে থাকত তবে তা ছিল মহানবী (স)-এর ‘সীরাত’ যাঁর নেতৃত্বের মুজিযাসুলভ কৃতিত্ব আরবের উটচালকদের জাগরিত করে সিন্ধু থেকে স্পেন পর্যন্ত ভূখন্ডের শাসকের মর্যাদায় উন্নীত করেছিল। তারা এমন এক একজনের নিকট পৌঁছে যেত যিনি মহানবী (স) –এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন, অথবা কখনও তাঁকে দেখেছিলেন, অথবা তাঁর কোন ভাষণ শুনেছিলেন। সাহাবীগণের একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সাথে সাথে তাদের সাহচর্য লাভেল আকাংখাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমনকি তাবিঈগণ সাহাবাদের নিকট থেকে সীরাতে পাক সম্পর্কে যে জ্ঞানেরই সন্ধান পেতেন তা-ই নিংড়ে নিতেন।
সাহাবীদের হাদীস বর্ণনা
বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষ্য দেয় যে, অবশ্যই এরূপ হয়ে থাকবে এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাস্তবিকই এরূপ হয়েছিল। আজ পৃথিবীতে হাদীসের যে জ্ঞানভাণ্ডার বর্তমান রয়েছে তা প্রায় দশ হাজার সাহাবীদের সূত্রে লাভ করা গেছে। তাবিঈগণ কেবলমাত্র তাঁদের বর্ণিত হাদীসই গ্রহণ করেননি, বরং এসব সাহাবীর জীবনীও লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁরা এও বর্ণনা করেছেন যে, কোন সাহাবী কত কাল মহানবী (স)-এর সাহচর্য লাভ করেছেন অথবা কোথায় এবং কখন তাঁকে দেখেছেন এবং কোন কোন স্থানে তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। বিজ্ঞ বিচারক তো বলেছিলেন যে, হাদীসসমূহ প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মনমগজে সমাহিত অবস্থায় পড়েছিল এবং দুইমো আড়াইশো বছর পরে ইমাম বুখারী (রহ) ও তাঁর সমসাময়িক মনীষীগণ এসব হাদীস খননকার্য চালিয়ে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ইতিহাস আমাদের সামনে যে চিত্র তুলে ধরে তা তার বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মধ্যে যাঁরা সর্বাধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের নাম ও তাদের বর্ণিত হাদীসসমূহের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হল।
আবু হুরায়রা (রা) (মৃ. ৫৭ হি.), বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫,৩৭৪ (এবং তাঁর ছাত্রবৃন্দের সংখ্যা ৮০০-এর অধিক। তাঁর অধিকাংশ ছাত্র তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করে নিয়েছিলেন)।
আবু সাঈদ আল-খুদরী (মৃ. ৪৬ হি.), হাদীসের সংখ্যা ১১৭০।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (মৃ. ৭৪ হি.), হাদীস ১,৫৪০।
আনাস ইবনে মালেক (মৃ. ৯৩ হি.), হাদীস ১,২৮৬।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা (মৃ. ৫৯ হি.), হাদীস ২,২১০।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ. ৬৭ হি.), হাদীস ১,৬৬০।
আবদুল্লাহ ইবনে উমার (মৃ. ৭০ হি.), হাদীস ১,৬৩০।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (মৃ. ৬৩ হি.), হাদীস ৭০০।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (মৃ. ৩২ হি.), হাদীস ৮৪৮।
উপরোক্ত তথ্য কি একথা প্রমাণ করে যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) মহানবী (স)-এর সার্বিক অবস্থায় বর্ণনাসমূহ নিজেদের বক্ষ পিঞ্জরে সমাহিত করে তা এভাবে পৃথিবী থেকে পরজগতে নিয়ে চলে গেছেন?
সাহাবীদের যুগ থেকে ইমাম বুখারীর যুগ পর্যন্ত ইলমে হাদীসের ধারাবাহিক ইতিহাস
এরপর সেইসব তাবিঈগণের দিকে লক্ষ্য করুন যাঁরা সাহাবায়ে কিরামগণের নিকট মহানবী (স) –এর জীবনাচার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং পরবর্তী বংশধরগণ পর্যন্ত তা পৌঁছিয়েছেন। কেবল ইবনে তাবাকাত গ্রন্থে কয়েকটি কেন্দ্রীয় শহরের তাবিঈনের যে জীবনী দেয়া হয়েছে, তা থেকে তাদের সংখ্যা অনুমান করা যেতে পারে। যেমন –মদীনায় ৪৮৪ জন, মক্কায় ১৩১ জন, কূফায় ৪১৩ জন, বসরায় ১৬৪ জন।
তাদের মধ্যে যেসব প্রবীণ সাহাবী হাদীসের জ্ঞান অর্জনে, তা সংরক্ষণ করতে এবং পরবর্তীদের নিকট তা পৌঁছে দিতে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন তাদের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হল।
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (জন্ম ৪১ জি. মৃত্যু ৯৩ হি.), হাসান বসরী (২১-১১০), ইবনে সীরীন (৩৩-১১০), উরওয়া ইবনুয যুবাইর (২২-৯৪), ইনি সর্বপ্রথম মহানবী (স)-এর জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন, আলী ইবনুল হুসাইন (ইমাম যয়নুল আবেদীন ৩৮-৯৪), মুজাহিদ (২১-১০৪), কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বাকর (৩৭-১০৬), শুরায়হ যিনি মুহাম্মদ উমার (রা)-এর খিলাফতকালে বিচারপতি ছিলেন (মৃ. ৭৮ হি.), মাসরূক যিনি হযরত আবু বাকর (রা)-র যুগে মদীনায় আসেন (মৃ. ৬৩ হি.), আসওয়াদ ইবনে হায়ওয়াত (মৃ. ৭৫ হি.) মাকহুল (মৃ. ৬৩ হি.), রাজাআ ইবনে হায়ওয়াত (মৃ. ১০৩ হি.) হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ (৪০-১৩১), তিনি হাদীসের একটি সংকলন প্রণয়ন করেছিলেন যা সাহীফায়ৈ ইবনে হাম্মাম নামে বর্তমান কালেও বিদ্যমান আছে এবং প্রকাশিত হয়েছে। সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার (মৃ. ১০৬ হি.) নাফে মাওলা ইবনে উমার (মৃ. ১১৭ হি.), সাঈদ ইবনে জুবাইর (৪৫-৯৫), সুলাইমান আল-আমাশ (৬১-১৪৮), আইউব আস-সুখতিয়ানী (৬৬-১৩১), মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির (৫৪-১৩০), ইবনে শিহাব আয-যুহরী (৫৮-১২৪), তিনি লিখিত আকারে হাদীসের বিরাট পাণ্ডুলিপি রেখে যান, সুলাইমান ইবনে ইয়াসার (৩৪-১০৭), ইকরামা ইবনে আব্বাস (রা)-র মুক্তদাস (২২-১০৫), আতা ইবনে আবী রাবাহ (২৭-১১৫), কাতাদা ইবনে দিআমা (৬১-১১৭), আমের আশ-শাবী (১৭-১০৪), আলকামা (মৃ. ৬২ হি.), তিনি রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগে যুবক ছিলেন, কিন্তু তাঁর সাক্ষাত লাভ করতে পারেননি। ইবরাহীম নাখঈ (৪৬-৯৬), ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব (৫৩-১২৮)।
এসকল মহামনীষীর জন্ম ও মৃত্যু তারিখের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই জানা যায় যে, তাঁরা সাহাবীগণের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সাহাবীদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মহিলা সাহাবীগণের কোলে লালিত-পালিত হন। আর তাদের কতেক তো কোন না কোন সাহাবীর সাহচর্যে গোটা জীবন কাটিয়ে দেন। তাদের জীবনেতিহাস পাঠে জানা যায় যে, তাদের প্রত্যেকে অসংখ্য সাহাবীর সাথে সাক্ষাত লাভ করে মহানবী (সা)-এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং তাঁর বাণীসমূহ ও সিদ্ধান্তসমূহ সম্পর্কে যুগপৎভাবে হাদীসসমূহ তাদের পরবর্তীদের নিকট পৌঁছে যায়। যদি না কোন ব্যক্তি মনে করে বসে যে, ১ম হিজরী শতকের সকল ব্যক্তি নিজেদের বাড়িতে বসে মনগড়াভাবে হাদীস রচনা করে থাকবেন এবং এরপরও গোটা উম্মাত তাদেরকে নিজেদের শিরোমনি বানিয়ে নিয়ে থাকবে এবং তাদেরকে নিজেদের প্রবীণ আলেমগণের মধ্যে গণ্য করে থাকবেন।
এরপর আমাদের সামনে আসে, বয়সে যুবক তাবিঈ ও তাবউ তাবিঈনের ইতহাস, যাঁরা ছিলেন সংখ্যায় হাজার হাজার এবং গোটা জাহানে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা ব্যাপকভাবে তাবিঈগণের নিকট থেকে হাদীসের শিক্ষা লাভ করে এবং দূরদূরান্ত পর্যন্ত সফর করে এক এক এলাকায় সাহাবা ও তাবিঈদের জ্ঞানভাণ্ডার একত্রিক করেন। তাদের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল।
জাফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী (জন্ম ৮০ হিজরী, মৃত্যু ১৪৮ হিজরী), তিনি ইমাম জাফর সাদেক নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। ইমাম আজম আবু হানীফা আন-নোমান (৮০-১৫০), শোবা ইবনুল হাজ্জাজ (৮৩-১৬০), লাইস (রহ)-এর উসতাদ ছিলেন। সাঈদ ইবনে আরূবা (মৃ. ১৫৬), মিসআর ইবনে কিদাম (মৃ. ১৫২), আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বাকর (মৃ. ১২৬), সুফিয়ান আস-সাওরী (৯৭-১৬১), হাম্মাদ ইবনে যায়েদ (৯৭-১৭৯)।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের হাদীস সংকলকবৃন্দ
এ যুগেই হাদীসের সংকলন প্রণয়নের কাজ যথারীতি শুরু হয়। এ যুগে যেসব মহান মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করেন তাদের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল।
রবী ইবনে সাবীহ (মৃ. ১৬০ হি.), তিনি প্রতিটি ফিকহী বিষয়ের উপর পৃথক পৃথক পুস্তিকা প্রণয়ন করেন। সাঈদ ইবনে আরূবা (মৃ. ১৫৬ হি.), তিনিও প্রতিটি ফিকহী বিষয়েল উপর স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেন। মূসা ইবনে উকবা (মৃ. ১৪১ হি.), তিনি মহানবী (স) –এর যুদ্ধসমূহের ইতিহাস সংকলন করেন। ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯), তিনি ইসলামী শরীআতের বিধিবিধান সম্পর্কিত হাদীস ও আছারসমূহ সংগ্রহ করেন। ইবনে জুরাইজ (৮০-১৫০), ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৮৯), সুফিয়ান সাওরী (৯৭-১৬১), হাম্মাদ ইবনে সালামা ইবনে দীনার (৯৭-১৭৬), ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২), ইমাম মুহাম্মাদ (১৩১-১৮৯), এঁরা সকলেই ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২), ইমাম মুহাম্মাদ (১৩১-১৮৯), এঁরা সকলেই ইমাম মালেক (রহ)-এর অনুরূপ কাজ করেন। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৮১ হি.), তিনি রসূলুল্লাহ (স) –এর জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন। ইবনে সাদ (১৬৮-২২০), তিনি মহানবী (স) –এর সীরাত এবং সাহাবা ও তাবিঈদের জীবনী সংক্রান্ত বর্ণনা একত্র করেন। উবায়দুল্লাহ ইবনে মূসা আল-আবসী (মৃ. ২১৩ হি.), মুসাদ্দাদ ইবনে মুসারহাদ আল বসরী (মৃ. ২১৮ হি.) আসাদ ইবনে মূসা (মৃঃ ২১২ হি.), মুসাদ্দাদ ইবনে মুসারহাদ আল-বসরী (মৃ. ২১৮ হি.) আসাদ ইবনে মূসা (মৃঃ ২১২), নুআইম ইবনে মুহাম্মাদ আল-খুযাঈ (মৃ. ২২৮), ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (১৬৮-২৪১), ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ (১৬১-২৩৮), উসমান ইবনে আবু শাইবা (১৫৬-২৩৯), এঁরা সকলে প্রত্যেক সাহাবীর বর্ণিত হাদীসসমূহ স্বতন্ত্রভাবে সংকলন করেন। আবু বাকর ইবনে আবু শাইবা (১৫৯-২৩৫), তিনি ফিকহ-এর অনুচ্ছেদসমূহের ক্রমানুসারে এবং সাহাবীদের প্রত্যেকের রিওয়ায়াতসমূহ উভয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে হাদীস সংকলন করেন।
তাদের মধ্যে ইমাম মালেক, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক, ইবনে সাদ, ইমান আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং আবু বাকর ইবনে আবু শাইবার গ্রন্থাবলী বর্তমান কাল পর্যন্ত বিদ্যমান আছে এবং তা প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া মূসা ইবনে উকবার আল-মাগাযী গ্রন্থের একটি অংশও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া যাদেঁর গ্রন্থাবলীর পাণ্ডুলিপি বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না তাও মূলত বিলীন হয়ে যায়নি, বরং সেগুলোর পরবর্তীগণ নিজ নিজ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। এজন্য লোকেরা এসব দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপির এখন আর মুখাপেক্ষী নয়।
ইমাম বুখারী (রহ)-এর যুগ পর্যন্ত ইলমে হাদীসের ধারাবাহিক ইতিহাস অধ্যয়নের পর কোন ব্যক্তি বিজ্ঞ বিচারকের নিম্নোক্ত কথার কোনো মূল্য দিতে পারে কিঃ “হাদীসসমূহ মুখস্তও করা হয়নি, সংরক্ষণও করা হয়নি, বরং সেইসব লোকের মনমগজে তা লুক্কায়িত ছিল যারা ঘটনাক্রমে তা অন্যদের সামনে উল্লেখ করার পর মরে গেছে, অতপর তাদের মৃত্যুর কয়েক শত বছর পর তা সংগ্রহ ও সংকলন করা হয়েছিল”? এবং তার এ কথা “পরে প্রথম বারের মত রসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রায় একশত বছর পর হাদীসসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছিল, কিন্তু তার দস্তাবেজ সংরক্ষিত নেই”? এ স্থানে আমরা এই নিবেদন বিচারকগণের ইসলাম তথা কুরআন-সুন্নাত ভিত্তিক বিষয়সমূহ সম্পর্কিত মত প্রকাশের জন্য এর চেয়েও অধিক সতর্ক ও সুগভীর পাণ্ডিত্বের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন।
হাদীসসমূহের মধ্যে মতপার্থক্যের তাৎপর্য
সামনে অগ্রসর হয়ে সম্মানিত বিচারপতি তার ষষ্ঠ দফায় হাদীসসমূহের “চরম সংশয়পূর্ণ” ও “অনির্ভরযোগ্য” হওয়ার একটি কারণ এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “এমন হাদীস খুব কমই আছে যে সম্পর্কে হাদীস সংগ্রহকারীগণ একমত হতে পেরেছেন”।
এটা এমন একটি দাবী যা কয়েকটি বিরোধপূর্ণ হাদীসের উপর ভাসাভাসা দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে করা যেতে পারে বটে, কিন্তু বিস্তারিতভাবে হাদীসের গ্রন্থাবলীল তুলনামূলক অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, সেই হাদীসগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যই বেশী এবং মতভেদ সামান্যই আছে। অতপর যেসব ক্ষেত্রে মতভেদ পাওয়া যায় তার মূল্যায়ন করা হলে অধিকতর মতভেদ নিম্নোক্ত চার ধরনের যে কোন এক ধরনের আওতায় পড়বেঃ
(এক) বিভিন্ন রাবী একই কথা বা একই ঘটনা শাব্দিক পার্থক্য সহকারে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এর অর্তের মধ্যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নেই, অথবা বিভিন্ন রাবী একই ঘটনা অথবা ভাষণের এক একটি অংশ বর্ণনা করেছেন।
(দুই) স্বয়ং মহানবী (স) একই বিষয় বিভিন্ন শব্দে বর্ণনা করেছেন।
(তিন) মহানবী (স) বিভিন্ন অবস্থায়, পরিবেশে বা স্থানে বিভিন্ন পন্থায় আমল (কাজ) করেছেন।
(চার) একটি হাদীস পূর্বের ও অপর হাদীস পরের এবং শেষোক্ত হাদীস পূর্বোক্ত হাদীসকে রহিত (মানসূখ) করে দিয়েছে।
এই চার শ্রেণীর আওতাভুক্ত হাদীস ব্যতীত যেসব হাদীসের বর্ণনাকারী পারস্পরিক বৈপরিত্য দূর করা বাস্তবিকই কষ্টসাধ্য গোটা হাদীস শাস্ত্রে এরূপ হাদীসের সংখ্যা শতকরা একটিরও অনেক কম। কয়েকটি মাত্র হাদীসের মধ্যে এরূপ ত্রুটি বিদ্যমান থাকার কারণে গোটা হাদীস ভাণ্ডারকে সংশয়পূর্ণ ও অনির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করার মত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য যথেষ্ট কি? রিওয়ায়াত (বা হাদীস) শ্রেণীবিভাগের অযোগ্য কোন অখণ্ড একক-এর নাম নয় যার কোন অংশ অকেজ বা বর্জিত হওয়ার কারণে সর্ম্পূর্ণটাই বর্জিত হতে পারে। প্রতিটি রিওয়ায়াত (হাদীস) নিজস্বভাবে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং নিজের স্বতন্ত্র সনদ সহকারে বর্ণিত হয়ে থাকে। এর ভিত্তিতে একটি-দুইটি নয়, দুই-চারশত রিওয়ায়াত বর্জিত হলেও অবশিষ্ট রিওয়ায়াতসমূহের বর্জিত হওয়া অপরিহার্য হতে পারে না। ইলমী (বুদ্ধি ও যুক্তিগ্রাহ্য) সমালোচার মানদণ্ডে যে রিওয়ায়াতই পূর্ণরূপে উতরে যাবে তা অবশ্যই মেনে নিতে হবে।
মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্যের আরেকটি দিক এই যে, কোন রিওয়ায়াতের সনদকে একজন মুহাদ্দিস নিজস্ব সমালোচনার নিরিখে সঠিক মনে করেন এবং অপরজন তাকে দুর্বল সাব্যস্ত করেন। এটা রায় ও তথ্যানুসন্ধানের পার্থক্য, যার ফলে অস্থির ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। বিচারালয়সমূহে কি কোন সাক্ষ্য গ্রহণ ও কোন সাক্ষ্য বর্জন করার ব্যাপারে কখনও মতপার্থক্য হয় না?
স্মৃতিশক্তি থেকে নকলকৃত রিওয়ায়াত কি অনির্ভরযোগ্য?
এখন আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির সর্বশেষ দফা দুটির উপর আলোকপাত করব। তিনি বলেন, “বর্তমান কালের আবরদের স্মৃতিশক্তি যতটা শক্তিশালী প্রথম হিজরী শতকের আরবদের স্মরণশক্তি ততটাই শক্তিশালী যতটা শক্তিশালী হয়ে থাকবে। তথাপি এটাকে যতই শক্তিশালী বলে স্বীকার করে নেয়া হোক, শুধুমাত্র স্মৃতিশক্তি থেকে নকলকৃত বক্তব্যকে কি নির্ভরযোগ্য মনে করা যেতে পারে? তিনি আরও বলেন, “একজনের স্মৃতিশক্তি থেকে অপরের স্মৃতিশক্তিতে কোন বক্তব্য স্থানান্তরিত হতে হতে তার মধ্যে কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে থাকে এবং প্রত্যেকটি স্মৃতিশক্তির নিজস্ব ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভংগী তাকে দুমড়াতে মোচড়াতে থাকে”।
এই দুটি অতিরিক্ত কারণের ভিত্তিতে তিনি হাদীসসমূহকে নির্ভরযোগ্য ও দলীল-প্রমাণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না।
তার প্রথমোক্ত কথা সম্পর্কে বলা যায় যে, তা অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের পরিপন্থী। অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মানুষ তার যে শক্তির সাহায্যে অধিক কাজ করে তা উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করতে থাকে এবং যে শক্তির সাহায্যে কম পরিমাণে গ্রহণ করে তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায়। একথা যেমন সমস্ত মানবীয় শক্তির ব্যাপারে সত্য তেমন স্মৃতিশক্তির বেলায়ও সত্য। আরব জাতি মহানবী (স) এর পূর্বে হাজারো বছর ধরে নিজেদের কাজ লেখনির পরিবর্তে স্মৃতিশক্তির সাহায্যে চালাতে অভ্যস্ত ছিল। তাদের ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ দীনারের আদান প্রদান করত এবং কোন লেখাপড়া জানত না। কড়ায় গন্ডায় হিসাব এবং অগণিত ক্রেতার হিসাব তারা মুখে মুখে রাখত। তাদের গোত্রীয় জীবনে বংশীয় ও রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিল অতীব গুরূত্বপূর্ণ। এসবক কিছুও স্মৃতিশক্তিতে সংরক্ষিত থাকত এবং মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমে এক বংশধর থেকে পরবর্তী বংশধরদের নিকট পৌছানো হত। তাদের সমস্ত সাহিত্য সম্পদ কাগজে নয়, বরং অন্তরের পর্দায় মুদ্রিত থাকত। তাদের এই অভ্যাস লেখার প্রচলন হওয়ার পরও প্রায় একশত বছর পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়ে যায়। কারণ জাতীয় অভ্যাসসমূহ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তারা কাগজে লিপিবদ্ধ করে রাখার পরিবর্তে নিজেদের স্মৃতিশক্তির উপরই অধিক নির্ভর করত। এটা ছিল তিাদের গৌরবের বিষয়। কোন ব্যক্তির নিকট কোন কথা জিজ্ঞেস করা হলে সে যদি তা স্মৃতিশক্তি থেকে না বলে বাড়িতে গিয়ে লিখিত পুস্তক এনে তার জবাব দিত তবে সে তাদের দৃষ্টি থেকে পরিত্যক্ত হয়ে যেত। দীর্ঘকাল যাবত তারা লিপিবদ্ধ করে রাখ সত্ত্বেও মুখস্ত করে রাখত এবং লিখিত বিবরণ পড়ে শুনানোর পরিবর্তে মুখস্ত শুনিয়ে দেয়া কেবল সম্মানের বিষয়ই মনে করত না, বরং তাদের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তির বিদ্যাবত্তার উপর নির্ভরতা এ পন্থায়ই কায়েম হত।
আজকের আরবদের মধ্যে স্মতিশক্তির এই অবস্থা অটুট থাকার কোন কারণ নেই। শত শত বছর ধরে লেখনিশক্তির উপর নির্ভর করা এবং স্মৃতিশক্তিকে কম কাজে লাগানোর কারণে এখন তাদের স্মৃতিশক্তি প্রাচীন আরবদের মতই প্রখর থাকা কোন প্রকারেই সম্ভব নয়। কিন্তু আরব ও অনারব সকলের মধ্যে আজও পর্যবেক্ষণ শিক্ষিত ও চক্ষুষ্মান লোকদের তুলনায় অধিক প্রখর। মূর্খ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন অসংখ্য লোক পাওয়া যায়, যারা নিজেদের ক্রেতাদের সাথে সম্পদিত হজার হাজার টাকার লেনদরে পূর্ণাংগরূপে ও বিস্তারিতভাবে মনে রাখতে পারে। এমন অসংখ্য অন্ধ মানুষ আছে যাদের স্মৃতিশক্তি মানুষকে হতবাক করে দেয়। একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, লেখনির উপর নির্ভর করার পর কোন জাতির স্মৃতিশক্তির সেই অবস্থা অবশিস্ট থাকতে পারে না যা মূর্খতার যুগে তাদের মধ্যে ছিল।
হাদীসসমূহের সুরক্ষিত থাকার আসল কারণ
এটা হল উল্লেখিত বিষয়ের একটি দিক। দ্বিতীয় দিকটি এই যে, সাহাবায়ে কিরামদের জন্য বিশেষভাবে রসূলুল্লাহ (স) এর হাদীসসমূহ স্মরণ রাখা এবং সঠিকভাবে বর্ণনা করার পেছনে আরও কাতিপয় জিনিসও ক্রিয়াশীল ছিল যা কিছুতেই উপেক্ষা করা যেতে পারে না।
প্রথমতঃ তারা সর্বান্তকরণে মহানবী (স) কে আল্লাহর রসূল এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মনে করতনে।তাদের অন্তরের মধ্যে তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্বের গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল।তাদের নিকট মহানবী (স) এর বক্তব্য এবং তার জীবনের ঘটনাবলী ও অবস্থার মর্যাদা সাধারণ মানবীয় ঘটনাবলীর মত ছিল না যে, তা নিজেদের স্মরণশক্তির হাওয়ালা করে দিয়েই ক্ষান্ত হতেন। তাঁরা মহানবী (স) এর সাহচর্যে যে সময় অতিবাহিত করেন তার প্রতিটি মুহূর্তে ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস এবং তাকে নিজেদের স্মৃতিতে ধরে রাখাকে তাঁরা নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মূলধন মনে করতেন।
দ্বিতীয়তঃ তাঁরা রসূলুল্লাহ (স) এর প্রতিটি ভাষণ, প্রতিটি বক্তব্য এবং তার জীবনের প্রতিটি কার্যক্রম তেকে এমন শিক্ষা লাভ করতেন যে, তারা ইতিপূর্বে কখনও লাভ করতে সক্ষম হননি। তারা নিজেরাও জানতেন যে, তাঁরা ইতিপূর্বে চরম অজ্ঞ, মূর্খ ও পথভ্রষ্ট ছিলো এবং এই পরিবত্রতম মানুষটি তাদেরকে এখন সঠিক জ্ঞান দান করছেন এবং সুসভ্য মানুষের মত জীবন যাপন করতে শিখিয়েছেন। তাই তারা তাঁর প্রতিটি কথা পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করতেন। কারণ তাদেরকে নিজেদের বাস্তব জীবন তদনুযায়ী গঠন করতে হত,তারই হুবহু অনুস্মরণ করতে হত এবং তারই নির্দেশনারয় কাজ করতে হত। প্রকাশ থাকে যে, এই চেতনা ও অনুভূতি সহকারে মানুষ যা কিছু দেখে ও শুনে থাকে তা স্মরণ রাখার ব্যাপারে তাঁরা এতটা সহজ হতে পারে না যতটা তার কোন মেলায় অথবা কোন বাজারে শ্রুত ও দৃষ্ট কথা স্মরণ রাখার ব্যাপারটি সাধারণ মনে করতে পারে।
তৃতীয়তঃ তাঁরা কুরআনের আলোকেও জানতেন এবং মহানবী (স) বারবার তাকিদ দেয়ার কারণেও তাদের প্রবল অনুভুতি ছিল যে, আল্লাহর নবীর উপর মিথ্যা আরোপ অতীব মারাত্বক অপরাধ, যার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া। এ কারণে তারা মহানবী (স) এর সাথে কোন কথা সংযুক্ত করে বর্ণনা করার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে এমন একটি উদাহরণও পাওয়া যায় না যে, কোন একজন সহাবীও নিজের কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে অথবা নিজের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মহানবী (স) এর নাম অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন। এমনকি তাদের মধ্যে যখন মতবিরোধের সূচনা হয় এবং দুটি রক্তক্ষায়ী মনগড়াভাবে কোন হাদীস রচনা করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেননি। পরবর্তী কালের অসৎ ও আল্লাহর প্রতি ভয়হীন লোকেরা অবশ্যই এ ধরনের জাল হাদসি রচনা করেছে, কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের ঘটনাবলীর মধ্যে এর একটি দৃষ্টান্তও খজে পাওয়া যাবে না।
চতুর্থতঃ পরবর্তী বংশধরদের নিকট মহানবী (স) এর জীবনারচার এবং তার হেদায়াত ও শিক্ষা সম্পূর্ণ যথার্থ আকারে পৌছে দেয়া এবং তার মধ্যে কোন প্রকার বাড়াবাড়ি অথবা মিশ্রণ না ঘটানোকে সাহাবায়ে কিরাম নিজেরদ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করতেন। কারণ তাদের নিকট এটাই ছিল (আল্লাহর) দীন এবং তার মধ্যে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তন সাধন করাটা কোন সমান্য অপরাধ নয়, বরং তা ছিল এক মারাত্মক প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা। তাই সাহাবাদের জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যে, তারা হাদীস বর্ণনা করার সময় থরথর করে কেপেঁ যেতেন। তাদের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যেত। যেখানে সামন্যতম সন্দেহ হত যে, হয়ত রসূলুল্লাহ (স) এর ব্যবহৃত শব্দ অন্য কিছু সেখানে বক্তব্য নকল করার সাথে সাথে “আও কামা কালা” (অথবা তিনি অনুরূপ বলেছেন) ব্যাক্যাংশ বলে দিতেন, যাতে শ্রোতামন্ডলী তাদের ব্যবহৃত শব্দাবলীকে হুবহু মহানবী (স) এর ব্যবহৃত শব্দ মনে না করে বসে।
পঞ্চমতঃ প্রবীণ সাহাবীগণ বিশেষভাবে সাধারণ সাহাবীদের হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সৎর্কতা অবলম্বনের উপদেশ দিতে থাকতেন। এ ব্যাপারে সামান্য অবহেলা প্রদর্শনকেও তারা কঠোরভাবে প্রতিহত করতেন এবং কখনও কখনও তাদের নিকট মহানবী (স) এর কোন হাদীস শুনলে তার সপক্ষে সাক্ষ্য তলব করতেন, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অন্যরাও সংশ্লিষ্ট হাদীস শুনেছে। এই নিশ্চয়তা লাভের জন্য সাহাবীগণ একে অপরের স্মরণশক্তি পরীক্ষাও নিতেন। যেমন, একবার হজ্জের মৌসুমে হযরত আয়েশা (রা) এর নিকট হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনূল আস (রা) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস পৌছে। পরের বছর হজ্জের সময় উম্মুল মুমিনীন (আয়েশা) পুনরায় একই হাদীস সম্পর্কে জানার জন্য তার নিকট লোক পাঠান। মাঝখানে এক বছরের ব্যবধানের পরও হযরত আবদুল্লাহ (রা) এর দুই বারের বর্ণনার মধ্যে একটি শব্দেরও পার্থক্য ছিল না। এর উপর হযরত আয়েশা (রা) মন্তব্য করেন, বাস্তবিকই আবদুল্লাহর সঠিক কথা স্মরণ আছে (বুখারী, মুসলিম)।
ষষ্ঠতঃ মহানবী (স) এর শিক্ষা ও হেদায়াতের এক উল্লেখযোগ্য বিরাট অংশ যা শুধু মৌখিক বর্ণনাই ছিল না, বরং সাহাবাদের সমাজে, তাদের ব্যক্তিগত জীবনে, তাদের পরিবারে, তাদের অর্থনীতি, সরকারী প্রশাসন ও বিচারালয়সমূহে পরিপূণরূপে কার্যকর ছিল যার প্রভাব ও প্রকাশ লোকেরা দৈনন্দিন জীবনে সর্বত্র দেখতে পেত। এমন এক জিনিস সম্পর্কে কোন ব্যক্তি স্মৃতিশক্তির ভ্রান্তি অথবা নিজের ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা ও ঝোক-প্রবণতার ভিত্তিতে কোন বিচ্ছিন্ন কথা নিয়ে এসে পেশ করলে তা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারত? অতএব কখনও কোন অপরিচিত ও বিচ্ছিন্ন হাদীস সামনে এসে পড়লেও তার বর্ণনাকারীকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণ বলে দিয়েছেন যে, ঐ বিশেষ বর্ণনাকারী ছাড়া এই কথা আর কেউ বর্ণনা করেননি অথবা তদনুযায়ী আমল করার কোন নযীর বর্তমান নাই।
হাদীসসমূহের যথার্থতার একটি প্রমাণ
এসব ছাড়াও অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ আরও একটি কথা আছে-যা সেইসব লোকেরাই বুঝতে পারেন যারা আরবী ভাষা জানেন এবং যারা ভাসাভাসাভাবে কখনও কখনও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হাদীস অধ্যয়ন করেননি, বরং গভীর দৃষ্টিতে হাদীসসের সব গ্রন্থাবলীর অথবা অন্ততপক্ষে কোন একটি গ্রন্থে যেমন বুখারী, অথবা মুসলিম) আদ্যপান্ত পাঠ করেছেন। তাদের নিকট একথা গোপন নয় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিজস্ব একটি ভাষা এবং তার নিজস্ব একটি বিশেষ প্রকাশভংগী ও বাচনভংগী রয়েছে যা সমস্ত সহীহ হাদীসসমূহে সম্পূর্ণ একরূপ এবং এক রং-এর দৃষ্টিগোচর হয়। কুরআনের মত তার সাহিত্য ও স্টাইলে এতটা স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান রয়েছে যে, তার অনুকরণ অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এর মধ্যে তার ব্যক্তিত্যই সবাক অনুভূত হয়। তাতে তাঁর উন্নত মর্যাদা ও অবস্থান অত্যুজ্জ্বল দৃষ্ঠিগোচর হয়। তা পড়তে পড়তে মানুষের অন্তর সাক্ষ্য দিতে থাকে যে, একথা মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তি বলতে পারে না। যেসব লোক অধিক পরিমাণে হাদীসমূহ পাঠ করে এবং মহানবী (স) এর ভাষা ও বচনভংগী উত্তমরূপে অনুধাবন করতে পেরেছে তারা হদীসের সনদসূহের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে শুধু মুল বক্তব্য পাঠ করে বলে দিতে পারে যে, হাদসিটি সহীহ অথবা মনগড়া কি না? মনগড়া হাদীসের ভাষাই বলে দেয় যে, তা রসুলুল্লাহ (স) এর ভাষা নয়। এমনকি সহীহ হাদীসের মধ্যে পর্যন্ত শব্দগত বর্ণনা ও অর্থগত বর্ণনারমধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য অনুভব করা যায়। কারণ বর্ণনাকরী যেখানে মহনবী (স) এর বক্তব্য নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন সেখানে তাঁর ভাষা ও স্টাইল সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারে যে, এই চিন্তধারা ও বর্ণনা তো মহানবীরই (স),কিন্তু ভাষার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হাদীসমূহের মধ্যে কখনও পাওয়া যেত না, যদি অসংখ্য দুর্বল হাফেজগণ এগুলোকে নিজ নিজ ধ্যানধারণা ও ঝোক প্রবণতা অনুযায়ী চুরমার করে থাকত। একথা কি বুদ্ধিতে কুলায় যে, অসংখ্য মস্তিষ্ক একত্র হয়ে একটি একই রূপ বৈশিষ্ট্যের সাহিত্য এবং একটি একক রীতির (Style) সৃষ্টি করতে পারে?
এ ব্যপারটি শুধু ভাষা ও সাহিত্যের গন্ডি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। আরো সামনে অগ্রসর হয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, দেহ ও পোশাকের পরিবত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা থেকে সন্ধি ও যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী পর্যন্ত জীবনের সার্বিক দিক ও বিভাগসমূহে এবং ঈমান-আকীদা ও নীতি-নৈতিকাতা থেকে কিয়ামতের নির্দশনসমূহ সম্পর্কে সহীহ হাদীসসমূহ এমন এক চিন্তা ও কার্যপদ্ধতি পেশ করে যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব একক গঠন প্রকৃতির অধিকারী এবং যার সমস্ত অংশ ও শাখার মধ্যে পুরাপুরিভাবে যুক্তিসংগত মিল রয়েছে। এতটা সুবিন্যস্ত সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা এবং এতটা পূর্ণাঙ্গ ও অখন্ড ব্যবস্থা অপরিহার্যরূপে একই চিন্তাধারা থেকে গড়ে উঠতে পারে, বিভিন্ন চিন্তার অধিকারী মস্তিষ্ক একতাবদ্ধ হয়ে এরূপ ব্যবস্থা গঠন করতে পারে না। এটা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় যার সাহায্যে শুধু মনগড়া জাল হাদীসইনয়, বরং সন্দেহযুক্ত হাদীস পর্যন্ত চিহ্নিত করা সম্ভব। সনদসূত্র দেখার পূর্বেই গভীর দৃষ্টির অধিকারী কোন মুহাদ্দিস এই প্রকারে কোন হাদীসসমূহ ও কুরআন মজীদ একই হয়ে ইসলামের যে চিন্তাপদ্ধতি ও জীবন ব্যবস্থা গঠন করেছে তার মধ্যে এই বিষয়বস্তু কোন প্রকারেই ঠিকভাবে খাপ খায় না। কারণ এর মেজাজ-প্রকৃতি পুরা জীবন ব্যবস্থার বিপরীত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
উপর্ক্তো তথ্য ও আলোচনার আলোকে সম্মানিত বিচারপতির এই রায় নিতান্তই ভাসাভাসা অধ্যায়ন এবং নেহায়েত চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনার ফলশ্রুতি বলেই দৃষ্টিগোচর হয় যে, হাফেজদের ভুলভ্রান্তি এবং বিভিন্নধর্মী মস্তিষ্কের তৎপরতা হাদীসকে বিকৃত করে দিয়েছে। অর্বাচীনের মুখ দিয়েই কেবল হাদীস সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য বের হতে পারে।
কতিপয় হাদীস সম্পর্কে বিজ্ঞ বিচারকের আপত্তি
সামনে অগ্রসর হয়ে সম্মানিত বিচারপতি বলেন যে, হাদীসের ভান্ডারে এমন সব হাদীস বর্তমান আছে যাকে ‘সঠিক মেনে নেয়া খুবই কঠিন। এর সপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ তিনি মিশকাতুল-মাসাবীহ-এর আলহাজ্জ মৌলভী ফজলুল করিম সাহেব এম.এ. বি. এল. কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে ১৩ টি হাদীস নকল করেছেন। এই অনুবাদ কলিকাতা থেকে ১৯৩৮ খৃ. প্রকাশিত হয়। এসব হাদীসের উপর সম্মানিত বিচারপতির অভিযোগসমূহ সম্পর্কে কিছু নিবেদন করার পূর্বে অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমাদের বলতে হচ্ছে যে, মিশকাত শরীফের এই অনুবাদে অনুবাদক সাহেব এত সাংঘাতিক ভুল করেছেন যা শুধু হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কেই নয় আরবী ভাষা সম্পর্কেও তার অজ্ঞতার প্রমান বহন করে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্মানিত বিচারক সাহেব এই সমস্ত ভুলভ্রান্তিসহ তার মূল পাঠ নকল করে দিয়েছেন। যদিও আলোচ্য বিষয়ের সাথে অনুবাদকের এই ভ্রান্তির কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু আমরা এখানে কেবলমাত্র এই কথার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য উক্ত বিষয়টির উল্লেখ্য করছি যে, বর্তমানে পাকিস্তান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট, তার উচ্চ আদালতের একটি রায়ে হাদীসের আইনগত মর্যাদার উপরা এতটা সুদূরপ্রসারী আলোচনা ও বিতর্ক তোলা হবে এবং হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে এতটা ভাসাভাসা বরং চরম ক্রটিপূর্ণ অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট প্রমাণ যুগপৎভাবে উপস্থিত করা হবে, সত্যিই এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর ব্যাপার। এই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার জ্ঞানবান লোকদের উপর কি প্রভাব বিস্তার করবে এবং আমদের বিচারালয়সমুহের সম্মান ও মর্যাদা কতটুকু বৃদ্ধি করবে?
“উদাহরণস্বরূপ তার উধৃত প্রথম হাদীসের দুটি বাক্যাংশ দেখা যাক। …………….. এর অনুবাদ করা হয়েছে “এবং এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যজনক কথা আর কি হতে পারে।:” অথচ তার সঠিক অনুবাদ হবেঃ “তার কোন কথাটি আশ্চর্যজনক ছিল না!” …………………. কে ……………….. অনুবাদক পড়েছেন এবং এর অনুবাদ করেছেনঃ “আমাকে ছেড়ে দাও। তুমি কি আমার প্রতিপালকেরে ইবাদত করবে?” অথচ এই অনুবাদই শুধু অস্পষ্ট ও অর্থহীনই নয়, বরং মূল পাঠ পড়তে গিয়ে অনুবাদক এমন ভুল করেছেন যা আরবী ব্যাকরণ সম্পর্কে প্রাথামিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিও করতে পারে না। (তাবুদু) হল পুং লিংগের ক্রিয়াপদ, আর বাক্যের পারস্পর্য বলে দিচ্ছে যে, সম্বোধিত ব্যক্তি হচ্ছেন মহিলা। মহিলাকে সম্বোধন করতে হলে … (তাবদীনা) বলতে হয়, (তাবুদু) নয়। উপরোক্ত বাক্যাংশের সঠিক অনুবাদ হলঃ “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আমার প্রতি পালকের ইবাদত করব।” এই প্রকারের ভুলভ্রান্তি দেখে শেষ পর্যন্ত কোন জ্ঞানবান ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে, সম্মানিত বিচারপতির হাদীস শাস্ত্রের উপর অন্তত এতটা বোধশক্তি আছে যতটা কোন বিষয়ের উপর বিজ্ঞতা সুলভ রায় দেয়ার জন্য অত্যাবশ্যক?
কোন কোন হাদীসে অশালীন বিষয়বস্তু আছে কেন?
এখন আমরা মূল আলোচনার দিকে ফিরে যাব। ২৬ নং প্যারায় বিজ্ঞ বিচারপতি একের পর এক ৯টি হাদীস নকল করেছেন এবং কোথাও তিনি বলেননি যে, কোন হাদীসের বিষয়বস্তুর উপর তার কি আপত্তি আছে। অবশ্য ২৭ নং প্যারায় তিনি সংক্ষিপ্ত আকারে মত প্রকাশ করেন যে, উক্ত হাদীসসমূহে যে “উলংগপনা” লক্ষ্য করা যায় তার ভিত্তিতে একথা বিশ্বাস করা যায় না যে, বাস্তবিকই এসব সঠিক হতে পারে। খুব সম্ভব তার ধারণা এই যে, মহানবী (স) ও মহিলাদের মধ্যে এবং মহানবী (স) এর পবিত্র স্ত্রীগণ ও তাদের ছাত্রবৃন্দের মধ্যে এ ধরনের খোলামেলা কথোপকথন শেষ পর্যন্ত কিভাবে সম্ভব ছিল?. এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞ বিচারপতি পেশকৃত হাদীসসমূহ সম্পর্কে পৃথকভাবে আলৈাচনা করার পূর্বে কয়েকটি মৌলিক কথা বলে দেয়া প্রয়োজন। কারণ বর্তমান কালের “শিক্ষিত ব্যক্তিগণ” সাধারণত এসব কথা না বুঝার কারণে উল্লেখিত প্রকারের হাদীসসমূহের সম্পর্কে সংশয় ও জটিলতায় পতিত হয়ে থাকে।
(এক) মানুষের একান্ত (Confidential) ব্যক্তিগত (Privet) জীবনের এমন কতিপয় দিক রয়েছে যে সম্পর্কে তার প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং পথনির্দেশ ও উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে লজ্জা শরমের অনর্থক অনুভুতি অধিকাংশ সময় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে এবং এর কারণে উন্নত দেশসমূহের লোকেরা পর্যন্ত এ সম্পর্কে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা প্রাথমিক নীতিমালা সম্পর্কে পর্যন্ত অনবহিত রয়েগেছে। এটা আল্লাহর দেয়া শরীআতেরই কৃপা যে, তা এসব দিক সম্পর্কেও আমাদের পথনির্দেশ দান করেছে এবং এসব আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা বলে দিয়ে আমাদের ভুলভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছে। বিজাতির চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান লোকেরা এসব জিনিসের মূল্য ও মর্যাদা দিয়ে থাকে, কারণ তাদের জাতির লোকেরা জীবনের এই বিশেষ শাখার শিক্ষা-প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। কিন্তু মুসলমান যারা ঘরে বসেই এসব নীতিমালা পেয়ে গেছে, আজ তারা এই শিক্ষর অবমূল্যায়ন করছে এবং আশ্চর্যজনক মজার ব্যাপার এই যে, এই অবমূল্যায়নের প্রকাশের ক্ষেত্রে সেইসব লোকেরাও অংশগ্রহণ করেছে যারা পাশ্চাত্য জাতির অনুকরণে যৌন বিজ্ঞানকে (Sex Education) পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে চালু করার পক্ষপাতী।
(দুই) আল্লাহ তাআলা আমাদের শিক্ষার জন্য যে কোন নবীকে প্রেরণ করেছিলেন তার উপর জীবনের এই প্রাইভেট শাখা সম্পর্কেও শিক্ষা- প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্বও ন্যস্ত ছিল। আরব জাতি এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক নিয়ম- কানুন সম্পর্কে পর্যন্ত অনবহিত ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে তাদের পুরুষদের ও এবং মহিলাদেরও পবিত্রতা, পায়খানা- পেশাব, গোসল ইত্যাদি নিয়ম-কানুন, অনন্তর এ জাতীয় অন্যান্য নিয়ম কানুনও কিবলমাত্র মৌখিকভাবেই বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হনানি, বরং নিজের স্ত্রীগণকেও অনুমতি দেন যে, তারা যেন মহানবী (স) এর একান্ত পরিবারিক জীবনের এসব দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সাধারণ লোকদের সামনে তুলে ধরেন যে, তিনি স্বয়ং কোন নীতিমালার উপর আমল করতেন।
(তিন) আল্লাহ তাআলা এই প্রয়োজনে মহানবী (স) এর পরিবত্র স্ত্রীগণকে মুমিন মুসলমানদের মাতৃস্থানীয় মর্যাদা দান করেছিলেন, যাতে মুসলমানগণ তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে জীবনের এই দিক ও বিভাগ সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভ করতে পারে এবং উভয় পক্ষের মধ্যে এই প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় কোন প্রকারের নাপাক আবেগের বহিপ্রকাশের আশংকা না থাকে। এ কারণে হাদীসের গোটা ভান্ডারে এমন কোন একটি নযীর পাওয়া যাবে না যে, মুমিন মুসলমানদের মাতৃস্থানীয় উম্মাহাতুল মুমিনীনের নিকট যে কথা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তা খোলাফায়ে রাশেদীনের বা অপরাপর সাহাবীদের স্ত্রীদের নিকটও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে এবং তারা পুরুষদের সাথে এই ধরনের কথোপকথন করে থাকবেন।
(চার) লোকেরা নিজেরদের ধারণায়, অথবা ইহুদী খৃষ্টানদের প্রভাবে যেসব জিনিস হারাম অথবা মাকরুহ বা অপছন্দণীয় মনে করে নিয়েছিল সেসব বিষয় শরীআত তাদের জন্য বৈধ করেছে শুধু এতটুকু শুনেই তারা আশ্বস্ত হতে পারত না। বৈধতার নির্দেশ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাদের অন্তত মাকরূহ থেকে মুক্ত নয়-তাই তারা নিজদের মনের প্রশান্তি লাভের উদ্দেশ্যে এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) এর নিজস্ব কার্যক্রম কি ছিল তা অবহিত হওয়া প্রয়োজন মনে করত। তারা যখন জানতে পারত যে, মহানবী (স) স্বয়ং অমুক কাজ করেছেন তখন তাদের মন থেকে সংশ্লিষ্ট কাজটির অন্তত অপছন্দীয় হওয়ার ধারণা দূর হয়ে যেত। কারণ তারা মহানবী (স) কে অনুসরণীয় আদর্শ মনে করত এবং তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, তিনি যে কাজ করেছেন তা মাকরুহ অথবা পবিত্রতার স্তরে থেকে নিচু হতে পারে না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যার ভিত্তিতে মহানবী (স) এর পবিত্র স্ত্রীগণকে দাম্পত্য ও পরিবারিক জীবনের এমন কাতিপয় বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে হয়েছে যা অন্য কোন মহিলা বর্ণনা করতে পারত না এবং বর্ণনা করতেও চাইত না।
(পাঁচ) হাদীসসমূহের এই অংশ মূলত মুহাম্মদ (স) এর মহানত্ব এবং তাঁর নবুয়াতের সপক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত করার যোগ্য। মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) ব্যতীত পৃথিবীতে তেইশটি বছরের রাত ও দিনের প্রতিটি মূহূর্তে নিজেকে সর্বসাধারণের দৃষ্টির সামনে রেখে দিতে, নিজের প্রাইভেট জীবনকেও উম্মুক্ত করে দিতে এবং নিজের স্ত্রীদের পর্যন্ত লোকদের সামনে নিজের পারিবারিক জীবনের অবস্থাও পরিষ্কারভাবে বিবৃত করার অনুমতি প্রদানের দুসাহস আর কে করতে পারত এবং গোটা মানব ইতহাসে কে এইরূপ সৎসাহস দেখাতে পেরেছে?
অভিযোগসমূহের বিস্তারিত মূল্যায়ন
উপরোক্ত বিষয়সমূহ দৃষ্টির সামনে রেখে বিজ্ঞ বিচারপতির পেশকৃত প্রতিটি হাদীস স্বতন্ত্রভাবে নিরীক্ষণ করে দেখা যাক।
প্রথমোক্ত হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) মূলত বলতে চাচ্ছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যদিও বৈরাগ্যে থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন এবং দুনিয়ার মানুষ নিজ নিজ স্ত্রীর সাথে যেরুপ সম্বন্ধ ও সম্পর্ক বজায় রাখে তিনিও নিজ স্ত্রীদের সাথে তদ্রুপ সম্বন্ধ ও সম্পর্ক বজায় রাখতেন। কিন্তু তথাপি আল্লাহ তাআলার সাথে তার এমন গভীর সম্পর্ক ছিল যে, বিছানায় স্ত্রীর সাথে শুয়ে যাওয়ার পরও কখনও কখনও হঠাৎ তার উপর ইবাদতের আকাংখা প্রবল হয়ে উঠতো এবং তিনি পার্থিব স্বাদ ও ভোগ বিলাস ত্যাগ করে এমনভাবে উঠে যেতেন যে, আল্লাহর বন্দেগী ছাড়া কোন জিনিসের প্রতি যেন তার কোন আকর্ষন নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, নবী করীম (স) এর পবিত্র জীবনের এই নির্জন গন্ডি সম্পর্কে তার স্ত্রীগণ ব্যতীত আর কে বলতে পারত? এই তথ্য যদি আলোতে না আসৎ তবে আল্লাহর প্রতি তার নিষ্ঠার সঠিক অবস্থা বিশ্ব কিভাবে জানতে পারত? ওয়াজ নসীহতের মজলিসে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের প্রদর্শণী কে না করে থাকে? মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপন অবস্থা ও কার্যাবলী সম্পর্কে অবগত হওয়া গেলেই তখন আল্লাহর প্রতি গভীর ও সত্যিকার ভালোবাসা ও তাকওয়ার অবস্থা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে।
দ্বিতীয় হাদীসে মূলত একথা বলা উদ্দেশ্য যে, চুমু দেয়া স্বয়ং উযূ নষ্টকারী জিনিস নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না যৌন উত্তেজনা বশত বীর্যরস নির্গত হয়। লোকেরা সাধারণত চুমুকেই স্বয়ং উযু নষ্ট না হলেও অন্তত পবিত্রতার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য বা ক্রটি এসে যায়। তাদের এই সন্দেহ দূর করার জন্য হযরত আয়েশা (রা) কে বলতে হয়েছে যে, মহানবী (স) স্বয়ং চুমু খাওয়ার পর উযু না করেই নামায পড়েছেন। অন্য লোকের নিকট এই মাসআলাটির গুরুত্ব থাক বা না থাক, কিন্তু যাদের নামায পড়তে হয় তাদের তো অবশ্যি এটা মেনে নেয়া অত্যাবশ্যক যে, কোন অবস্থায় তারা নামায পড়ার উপযোগী থাকে এবং কোন অবস্থায় থাকে না।
তৃতীয় হাদীসে এক মহিলার এই মাসআলা জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মত নারীদের ও যদি স্বপন্নদোষ হয় তবে তাকে কি করতে হবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে যেহেতু তা কমই ঘটে থাকে তাই তারা এর শরীআত সম্মত বিধান সম্পর্কে অনবহিত ছিল। ঐ মহিলা রসূলুল্লাহ (স ) এর নিকট উপস্থিাত হয়ে মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে বলেন, পুরূষদের মত তাকেও গোসল করতে হবে, শুধু তাকেই নয়, যে কোন মহিলাকেই (এরূপ ঘটলে) গোসল করতে হবে। এভাবে তিনি একজন মহিলার মাধ্যমে সব স্ত্রীলোককে একটি জরূরী শিক্ষা দান করলেন। এর উপর যদি কারো আপত্তি থেকে থাকে তবে তিনি কি এটাই চাচ্ছেন যে, মহিলারা তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল কারো কাছে জিজ্ঞেস না করুক এবং লজ্জাবনত অবস্থায় নিজের বুদ্ধিতে যা আসে তাই করতে থাকুক? হাদীসের দ্বিতীয় অংশে এক মহিলার আশ্চর্যবোধ করার প্রেক্ষিতে মহানবী (স) দেহ বিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি তথ্য বর্ণনা করেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মত প্রাপ্তবয়স্কা নারীদের দেহ থেকেও পদার্থ (বীর্য) নির্গত হয়। উভয়ের মিলিত হওয়ার ফলে সন্তান পয়দা হয় এবং উভয়ের মধ্যে যার বীর্যের অংশ বেশী থাকে সন্তানের মধ্যে তার বৈশিষ্ট্যের প্রাবল্য অধিক প্রতিয়মান থাকে। বুখারী ও মুসলিমের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এ হাদীসের যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে তা মিলিয়ে দেখুন। এক বর্ণনায় মহানবী (স) এর বক্তব্য নিম্নরূপ:
“সন্তানের মধ্যে সাদৃশ্য কি এ ছাড়া অন্য কোন কারণে হয়ে থাকে? যখন স্ত্রীর বীর্য স্বামীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করে তখন সন্তান মাতুল গোষ্ঠীর অনুরূপ হয়ে থাকে। আর যখন স্বামীর বীর্য স্ত্রীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করে তখন সন্তান পিতৃকূলের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়।”
হাদীস অস্বীকারকারীরা অজ্ঞান অথবা ভন্ডামীর আশ্রয় নিয়ে এসব হাদীসের এই অর্থ করেছে যে, সহবাসে যদি নারীর আগে পুরূষের বীর্যপাত হয় তবে বাচ্চা পিতৃকূলের প্রভাব প্রাপ্ত হয়, অন্যথায় মায়ের অনুরূপ হয়। আমরা এদেসের পরিস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত যে, জাহেল-মূর্খ ও নিকৃষ্ট স্বভাবের লোকেরা প্রকাশ্যে হাদীসের জ্ঞান নিয়ে এই প্রকারের ধোকাবাজি করছে এবং উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা পর্যন্ত অনুসন্ধান ছাড়াই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই ভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছে যে, হাদীস বিশ্বাসের অযোগ্য কথায় ভরপুর।
চতুর্থ হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন যে, স্বামী-স্ত্রী একসাথে গোসল করতে পারে এবং মহানবী (স) স্বয়ং এরূপ করেছেন। যেসব দম্পতি নিয়মিত নামায পড়ত মূলত তাদেরই এ মাসআলাটি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ফজরের সময় বারংবার তারা এমন অবস্থায় সম্মুখীন হয়েছিল যে, সময়ের সংকীর্ণতার কারণে একজনের পরে অপরজন গোসল করলে একজনের নামাযের জামাআত ছুটে যেত। এরূপ পরিস্থিতিতে তাদেরকে একথা বলে দেয়া আবশ্যক ছিল যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একসাথে গোসল করা শুধু জায়েযই নয়, বরং তাতে দোষেরও কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে আরও জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, সে সময় মদীনায় গোসল খানায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্তা ছিল না এবং ফজরের জামাআত তার প্রথম ওয়াক্তে অনুষ্ঠিত হত এবং মহিলারাও ফজর ও এশার নামায মসজিদে গিয়ে জামাআতে আদায় করত। এসব তথ্য দৃষ্টির সামনে রেখে আমাদের বলে দেয়া হোক এ হাদীসে কোন জিনিসটি গ্রহণযোগ্য নয়?
পঞ্চম হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন যে, খারাপ স্বপ্ন দেখলে কোন অবস্থায় গোসল ফরয হয় এবং কোন অবস্থায় ফরয হয়না। আর ষষ্ঠ হাদীসে তিনি বলেছেন যে, জাগ্রত অবস্থায় কখন গোসল ওয়াজিব হয়। এ দুটি হাদীস কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিকভাবে উপলব্দি করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে জানতে পারে যে তৎকালীন সময়ে গোসল ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈদের মধ্যে একটি মতভেদের উদ্ভব হয়েছিল।
কতিপয় সাহাবী ও তাদের ছাত্রবৃন্দ ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়ে পড়েছিলেন যে, সংগমকালে বীর্যপাত হলেই কেবল গোসল ফরয হয়। এই ভুল বুঝাবুঝি দূরীকরণার্থে হযরত আয়েশা (রা) কে একথা বলে দিতে হয়েছে যে, এই হুকুম কেবল স্বপ্নদোষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং সহবাসের ক্ষেত্রে উভয় লিংগ পরস্পর একত্র হলেই গোসল ফরয হয়ে যাবে এবং রসূলুল্লাহ (স) এর স্বীয় আমলও তাই ছিল। একথা সুস্পষ্ট যে, নামাযী লোকদের জন্য এই মাসআলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যেসব ব্যক্তি কেবল বীর্যপাত হলেই গোসল ফরজ হওয়ার পক্ষপাতী ছিল তারা স্ত্রীসহবাসে বীর্যপাত না হওয়ার ক্ষেত্রে গোসল না করেই নামায পড়ার মত ভুল করে বসতে পারত। এ প্রসঙ্গে মহানবী (স) এর নিজস্ব কর্মনীতি বলে দেয়ার মাধ্যমেই এই বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গেল।
৭,৮,৯, ১০ ও ১১ নম্বরের এই হাদীস কয়টি সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য জানা প্রয়োজন যে, ফরয গোসল ও হায়েয (মহিলাদের মাসিক ঋতু) অবস্থায় মানুষের নাপাক হওয়ার ধারণা প্রাচীন শরীআতেসমূহেও ছিল এবং শরীআতে মুহাম্মদীতেও পেশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন শরীআতসমূহে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মযাজকদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এই ধারণাকে এতটা ভারসাম্যহীন করে দেয় যে. তারা এই অবস্থায় মানুষের অস্তিত্বকেই নাপাক মনে করতে থাকে এবং এদের প্রভাবে হেজাযের এবং বিশেষত হায়েযগ্রস্ত মহিলারা তো সেখানে সম্পূর্ণ সমাজচ্যুত হয়ে পড়ত।
বিজ্ঞ বিচারপতি মেশকাতের যে গ্রন্থ থেকে এসব হাদীস উধৃত করেছেন তার “হায়েয” শীর্ষক অনুচ্ছেদের প্রথম হাদীস এই যে, “নারীরা হায়েযগ্রস্ত হয়ে পড়লে ইহুদীরা তাদের সাথে একত্রে পানাহার, শয়ন ও স্বাভাবিক মেলামেশা পরিত্যাগ করত। মহানবী (স) লোকদের বলেন যে, এ অবস্থায় কেবল সহবাসই নিষিদ্ধ, অবশিষ্ট যাবতীয় মেলামেশা পূর্ববৎ স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকবে।” কিন্তু তা সত্ত্বেও এক উল্লেখযোগ্য সময় যাবত লোকদের মধ্যে প্রাচীন ধ্যানধারণা অবশিষ্ট থাকে এবং তারা মনে করতে থাকে যে, হায়েয অবস্থায় নারীর অস্তিত্ব কিছু না কিছু অপবিত্র তো থাকেই এবং এ অবস্থায় যে যে জিনিসে তার হাত লেগে যায় তাও অন্তত কিছুটা অপবিত্র অবশ্যই হয়ে যায়। এই ধ্যানধারনাকে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য হযরত আয়েশা (রা) কে বলতে হয়েছেঃ এ অবস্থায় স্বয়ং মহানবী (স) বেছেগুছে চলতেন না। তার মতে না পানি নাপাক হয়ে যেত, না বিছানা, না জায়নামায। অনন্তর তিনি আরও বলে দিয়েছেন যে, হায়েযগ্রস্ত আচার-ব্যবহার ও মেলামেশা তার সাথে করতে পারে। হযরত আয়েশা (রা) এবং মহানবী (স) এর অপরাপর স্ত্রীগণ তাঁর কর্মনীতির বিবরণ দান করে যদি এই কুসংস্কারের মূলোৎপাটন না করতেন তবে আজ আমাদেরকে নিজেদের পারিবারিক কাজকর্মে যেসব সংকীর্ণতা ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হত তা অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের উপর এই অনুগ্রহ প্রদর্শনকারিণীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের পরিবর্তে আমরা এখন বসে বসে চিন্তা করছি যে, আচ্ছা নবী (স) এর স্ত্রীগণ কি এ জাতীয় কথা মুখে আনতে পারেণ।
আরও দুটি হাদীস সম্পর্কে অভিযোগ
অত:পর ২৮ নং প্যারায় বিচারপতি সাহেব আরও দুটি হাদীস উধৃত করেছেন, যাতে মহানবী (স) বলেছেন যে, তিনি জান্নাতসমূহ দেখেছেন এবং তার অধিকাংশ অধিবাসী ছিল দরিদ্র ও ফকির-মিসকীন। তিনি দোযখও দেখেছেন এবং অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল স্ত্রীলোক।
এ হাদীস সম্পর্কে তিনি শুধুমাত্র এই মত প্রকাশ করেননি যে, “আমি নিজেকে বিশ্বাসই করাতে পারছি না যে, মহানবী (স) এই রকম কথা বলে থাকবেন বরং তিনি এ হাদীসের প্রথমাংশ সম্পর্কে এই রায় ব্যক্ত করেন যে, “এর অর্থ কি এই যে, মুসলমানদের ধন-সম্পদ উপার্জন করতে নিষেধ করা হয়েছে।”
এ জাতীয় কোন হাদীস যদি কোন ব্যক্তি কখনও হালকা দৃষ্টিতে দেখে তবে সে উপরোক্ত ভ্রান্তির শিকার হবে যা এই বিজ্ঞ বিচারপতি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যেসব লোক ব্যাপক ও গভীরভাবে হাদীস অধ্যয়ন করেছে এবং যাদের সামনে এ ধরনের প্রচুর হাদীস এসেছে তাদের একথা অজ্ঞাত নয় যে, মহনবী (স) তাঁর এই পর্যবেক্ষণ কেবলমাত্র কাহিনী বলার খাতিরে বর্ণনা করেননি, বরং বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত লোকের সংশোধনের জন্য বর্ণনা করেছেন। তিনি অবশ্যই একথা বলেননি যে, গরীব লোকদের তুলনায় ধনী লোকরা দোযখের অধিক উপযোগী হয়ে থাকে, বরং সম্পদশালীদের এও বলেছেন যে, তাদের কি কি দোষ বা অপরাধ রয়েছে যা আখেরাতে তাদের ভবিষৎ ধ্বংস করে দেয়; এবং তাদের কি কর্মধারা অবলম্বন করা উচিত যার ফলশ্রুতিতে তারা পার্থিব জীবনের মত আখেরাতেও সুখ-স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে। অনুরুপভাবে তিনি তাঁর বিভিন্ন ভাষণে মহিলাদেরও বলে দিয়েছেন যে, তাদের কোন ধরনের দোষক্রটি তাদেরকে জাহান্নামের বিপদে নিক্ষেপ করতে পারে, যা থেকে তাদের বেচেঁ থাকা উচিত এবং কি ধরনের ভালো কাজ করে তারা জান্নাত লাভের অধিকারী হতে পারে। যেসব লোকের কোন একটি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট সার্বিক দিক অধ্যয়ন ও গবেষণার অবকাশ নেই তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যৎসামান্য জ্ঞানের উপর ভরসা করে মত প্রকাশের কি প্রয়োজন আছে?
আরও একটি হাদীসের বিরুদ্ধে অভিযোগ
এরপর ২৯ নং প্যারায় বিজ্ঞ বিচারপতি বলেন, “উপরন্তু এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ এমন কথা বলে থাকবেন যা বুখারীর ৮২৫ নং পৃষ্ঠায় রিওয়ায়াত নং ৬০২/৭৪-এ আবদুল্লাহ ইবনে কায়েসের সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মুসলমানগণ জান্নাতে একটি তাঁবুর বিভিন্ন অংশে উপবিষ্ট নারীদের সাথে সংগম করবে?”
আমরা অত্যন্ত পেরেশান ছিলাম যে, এই বুখারী নামক হাদীস গ্রন্থে শেষ পর্যন্ত কোন কিতাব যার ৮৫২ নং পৃষ্ঠার বরাত দেয়া হয়েছে? অবশেষে সন্দেহ দূরীভুত হল যে, সম্ভবত এ গ্রন্থটি হচ্ছে তাজরীদুল বুখারীর উর্দূ অনুবাদগ্রন্থে যা মালিক মুহাম্মাদ এন্ড সন্স প্রকাশ করেছেন। অনুবাদগ্রন্থখানি বের করে দেখা গেল সত্যিই উক্ত গ্রন্থের বরাত দেয়া হয়েছে। এখন কিছুটা এই জুলুম ও অবিচারের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, বিজ্ঞ বিচারপতি হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে একটি বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তে বিজ্ঞসুলভ রায় প্রকাশ করেছেন এবং বরাত দিচ্ছেন এমন একটি ভুলভ্রান্তিপূর্ণ অনুবাদগ্রন্থের যার অনুবাদকের নামটা পর্যন্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়নি। আরও অধিক জুলুম ও অন্যায় এই যে, তিনি হাদীসের মূল ভাষা পড়ার পরিবর্তে অনুবাদের ভাষা পাঠ করে রায় প্রদান করেছেন এবং এতটুকুও অনুভব করলেন না যে, অনুবাদে কি ভুল রয়েছে। হাদীসের মূল পাঠ ও তার সঠিক অনুবাদ নিম্নেপ্রদত্ত হলঃ
“বেহেশতে একটি তাবু আছে যা কারুকার্য খচিত মণিমুক্তা দ্বারা নির্মিত। তার প্রস্থ ষাট মাইল। এর এক প্রকোষ্ঠের লোকেরা অপর প্রকোষ্ঠে বসবাসকারীদের দেখতে পায় না। মুমিনগণ তাদের নিকট যাতায়াত করবে”
(অর্থাৎ মাঝে প্রতিটি প্রকোষ্ঠের বাসিন্দাদের নিকট যাতায়াত করতে থাকবে)১
রেখাংকিত “ইয়াতূফূনা আলাইহিম” বাক্যাংশের অর্থ অনুবাদক সাহেব করেছেন- “তারা তাদের সাথে সংগম করবে” এবং বিজ্ঞ বিচারপতি এর উপর নিজের রায়ের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। অথচ “তাফা আলাইহে” এর অর্থ “কখন্ কখনো কারো নিকট যাতায়াত করা” “সহবাস করা” এর অর্থ নয়। কুরআন মজীদে জান্নাতের উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছেঃ
يَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُونَ
“তাদের নিকট এমন সব কিশোরেরা যাতায়াত করবে যারা চিরকালই কিশোর থাকবে” (সূরা ওয়াকিয়াঃ ১৭; আদ-দাহরঃ১৯)। এর অর্থ কি এই যে, এসব কিশোর তাদের সাথে সংগম করবে? সূরা নূর-এ (৫৮ নং আয়াতে) দাস-দাসী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকদের সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা তিন সময়ে বাড়ির মালিকের নির্জন কক্ষে অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করবে না। অবশ্য অন্যান্য সময়ে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করতে পারবে এবং এই নির্দেশের যে কারণ বর্ণনা করা হয়েছে তা এই যে, طوافونعليكم “তাদেরকে তোমাদের নিকট যাতায়াত করতে হয়।” এখানেও কি এই তাওয়াফ শব্দের অর্থ সংগমই হবে? আলোচ্য হাদীসে (আহল) শব্দের অর্থ যদি একজন মুমিন ব্যক্তির স্ত্রীগণই হয়ে থাকে যারা এই ষাট মাইল প্রশস্ত তাবুর বিভিন্ন অংশে বসবাস করবে, তবুও কোন ব্যক্তির নিজের স্ত্রীদের কোঠাসমূহে “যাতায়াত” কি অপরিহার্যরূপে “সংগম” এর সমার্থবোধক? কোন উত্তম ব্যক্তি কি এই একটি উদ্দেশ্য ছাড়া নিজের স্ত্রীর প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ করে না? তাওয়াফ শব্দের এই অর্থ তো কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই করতে পারে যার মন মগজের উপর যৌনাবেগ নিকৃষ্টভাবে সওয়ার হয়ে আছে।
বিচারপতির মতে সুন্নাতে নববী আইনের উৎস না হওয়ার ব্যাপারে আরও দুটি প্রমাণ
৩০ নম্বর প্যারায় বিজ্ঞ বিচারক আরও দুটি প্রমাণ পেশ করেছেন। (এক) রাফে ইবনে খাদীজ (রা) থেকে বণিত হাদীসে (যার বরাত তিনি দিয়েছে) মহানবী (স) স্বযং বলেছেন, যেসব বিষয় দীন ইসলামের সাথে সম্পর্কিত নয় সেসব ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যকে চুড়ান্ত মনে করবে না। (দুই) মহানবী (স) স্বয়ং এই বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন (এখানে তিনি অবশ্য কোন বরাত উল্লেখ্য করেননি) যে, শুধু কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা জীবনের সার্বিক দিক ও বিভাগে মুসলমানদের পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত।
এর মধ্যে প্রথম দলীল তাঁর পেশকৃত হাদীসের সাহায্যেই চুরমার হয়ে যায়। উক্ত হাদীসে এই ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে যে, মহানবী (স) খেজুরের উৎপাদন কার্যের ব্যাপারে মদীনাবাসীদের একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করাতে খেজুরের উৎপাদন কমে যায়। এর ভিত্তিতে তিনি বলেন, “আমি তোমাদের দীনের ব্যাপারে যখন তোমাদের কোন নির্দেশ দেই তখন তার অনুসরণ কর এবং যখন নিজের ব্যক্তিগত অভিমত অনুযায়ী কিছু বলি তবে সে ক্ষেত্রে আমি একজন মানুষই।”
উপরোক্ত হাদীস থেকে একথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ইসলাম যেসব বিষয় নিজের দিক নির্দেশনার আওতাভুক্ত করে নিয়েছে সেসব ক্ষেত্রে তো মহানবী (স) এর বাণীর আনুগত্য অপরিহার্য। অবশ্য যেসব বিষয় দীন ইসলাম নিজের আওতাভুক্ত করেনি সেসব ক্ষেত্রে নবী (স) এর ব্যক্তিগত অভিমতের আনুগত্য অপরিহার্য নয়। এখন স্বয়ং প্রত্যেক ব্যক্তি দেখে নিতে পারে যে, দীন ইসলাম কোন সব বিষয় নিজের আওতাভুক্ত করে নিয়েছে এবং কোনটিকে নয়। একথা সুস্পষ্ট যে, লোকদের উদ্যানচর্চা, অথবা দর্জীর কাজ, অথবা বাবুর্চির কাজ শিখানোর বিষয় দীন ইসলাম নিজের দায়িত্বভুক্ত করেনি। কিন্তু স্বয়ং কুরআন মজীদই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন, পারিবারিক আইন, অর্থনৈতিক বিধান এবং অনুরূপভাবে সামাজিক জীবনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে আইন-কানূন বলে দেয়ার দায়িত্ব দীন ইসলাম তার কার্যক্ষেত্রে আওতায় নিয়ে নিয়েছে। এসব বিষয় সম্পর্কে মহানবী (স) এর হেদায়াত ও পথনির্দেশ প্রত্যাখ্যান করার জন্য উপরোক্ত হদীসকে কিভাবে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা যেতে পারে?
তার দ্বিতীয় দলীল সম্পর্কে আমাদের দাবী এই যে, অনুগ্রহপূর্বক আমাদের বলে দেয়া হোক যে, মহানবী (স) এর কোন হাদীসে এই বক্তব্য এসেছে যে, মুসলমানদের পথনির্দেশ লাভের জন্য শুধুমাত্র কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করা উচিৎ।
تركت فيكم امرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنة رسوله
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ মোটেই পথভ্রষ্ট হবে নাঃ (এক) আল্লাহর কিতাব, (দুই) তার রসূলের সুন্নাত”-(মুওয়াত্তা ইমাম মালেক)।
১. বুখারী বাংলা অনু. ৪খ. হাদীস নং ৪৫২ ইংরেজী অনু. ডক্টর মুহসিন খান, ৬খ. হাদীস নং ৪০২ মুসলিম (জান্নাত) তিরমিযী (জান্নাত) দারিমী, (রিকাক) মুসনাদে আহমাদ. ৩য়., ৪র্থ খন্ড- (অনুবাদ)।
স্বয়ং মুহাদ্দিসগণের কি হদীসসমূহের উপর আস্থা ছিল না?
৩১ নং প্যারায় সম্মানিত বিচারক আরও একটি যুক্তি পেশ করেছেন। তিনি বলেন, “স্বয়ং মুহাদ্দিসগণ নিজেদের সংগৃহীত হাদীসসমূহের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না শুধু এই একটিমাত্র বিষয় থেকে প্রতীয়মান হয় যে,তারা মুসলমানদের বলেন না যে, তোমরা আমাদের সংগৃহীত হাদীসগুলো যথার্থ বলে গ্রহণ কর। বরং তারা বলেন, এগুলোকে আমাদের নির্ধারিত হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের মানদন্ডে যাচাই করে তোমরা নিশ্চিত হও। এসব হাদীসের যথার্থতা সম্পর্কে তাঁরা যদি নিশ্চিত হতেন তবে যাচাই বাছাইয়ের প্রশ্ন ছিল সম্পূর্ণ নিরর্থক ও নিষ্প্রয়োজন।”
বাস্তবিকই এ এক আজব যুক্তি। দুনিয়ার কোন প্রতিভাবান ও বিচক্ষণ লোক কোন জিনিসকে ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক বলেন না, যতক্ষণ না তিনি স্বয়ং যথার্থতা সম্পর্কে আশ্বস্ত হতে পারেন। কিন্তু আপনি একজন ঈমানদার প্রতিভাবান ব্যক্তি সম্পর্কে এ আশা করতে পারেন না যে, তিনি নিজের তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণার উপর ঈমান আনার জন্য দুনিয়া ব্যাপী দাবী করবে এবং প্রতারণার সাথে লোকদের বলবে যে, আমি এটাকে সঠিক মনে করি, অতএব তোমাদেরও তা সঠিক বলে মেনে নেয়া উচিৎ। তিনি তো এটাই বলবেন যে, নিজের তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা চলাকালে যে তথ্যাবলীই তার সামনে আসবে তার সমস্তটাই লোকদের সামনে রেখে দেবেন এবং বলে দেবেন যে,এই তথ্যাবলীর ভিত্তিতে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌছেছি, তোমরা তা যাচাই করে নাও। যদি তোমরা আমার পেশকৃত তথ্য সম্পর্কে আশ্বস্ত হতে পার তবে তা কবুল করে নাও, অন্যথায় এই উপকরণ উপস্থিত আছে তার মাধ্যমে নিজেরাই যাচাই বাছাই করে নাও। মুহাদ্দিসগণ এই কাজ করেছেন। তাদের নিকট মহানবী (স) এর যে কথা ও কাজের বিবরণ পৌছেছে তার পূর্ণ সনদ (সূত্র পরস্পর) তারা বর্ণনা করেছেন। প্রতিটি সনদ সূত্রে যতজন রাবীর (বর্ণনাকারী) নাম এসেছে তাদের প্রত্যেকের অবস্থা স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। বিভিন্ন সনদসূত্রে প্রাপ্ত রিওয়ায়াতসমূহে যে যে দিক থেকে দুর্বল বা শক্তিশালী হওয়ার কোন কারণ পাওয়া যেত তাও তারা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। প্রতিটি হাদীস সম্পর্কে তাঁরা নিজেদের মত ব্যক্ত করে বলেছেন যে, আমরা অমুক অমুক যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে এই হাদীসকে সহীহ অথবা দুর্বলতার দিক থেকে এই মর্যাদা দান করি।
এখন পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মুহাদ্দিসগণ যেসব হাদীসকে এই যুক্তিপূর্ণ পন্থায় সহীহ বলেন, তা তাদের নিকট সহীহ বলেই বিবেচিত। এগুলো সহীহ ও যথার্থ হওয়া সম্পর্কে তাঁরা যদি নিশ্চিতই না হতে পারতেন এবং তাদের যদি এরুপ বিশ্বাসই না জন্মাত তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা একে সহীহ বলবেনই বা কেন। এর পরও কি তাদের এরূপ আহবান জানানোর প্রয়োজন ছিল যে, হে মুসলমানগণ! তোমরাও এসব হাদীসের সহীহ ও যথার্থ হওয়ার উপর ঈমান আন, কারণ আমরা এগুলোকে সহীহ ও যথার্থ সাব্যস্ত করেছে?
হাদীসের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ততা ও অসংলগ্নতার অভিযোগ
বিজ্ঞ বিচারপতি ৩৩ নং প্যারায় দুটি কথা বলেছেন, যেখানে পৌছে তার যুক্তিপ্রমাণের সমাপ্তি হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কথা এই বলেছেন যে, “প্রচুর হাদীসের বক্তব্য খুবই সংক্ষিপ্ত, অসংলগ্ন ও সম্পর্কহীন যা পাঠ করলে পরিষ্কার অনুভব করা যায় যে, এগুলোকে পূর্বাপর সম্পর্ক ও যথাস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে হৃদয়ংগম করা এবং এর যথার্থ দাবী ও তাৎপর্য নিরুপন করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না তার পূর্বাপর সম্পর্কের বিষয়টি সামনে রাখা হবে এবং কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে রসূলে পাক সংশ্লিষ্ট বক্তব্য রেখেছেন বা কোন কাজ করেছেন তা জ্ঞাত হওয়া যাবে।”
তার দ্বিতীয় কথা এই যে, “একথা বলা হয়েছে এবং যথার্থভাবেই বলা হয়েছে যে, হাদীস কুরআনের বিধান মানসূখ (রহিত) করতে পারে না। কিন্তু অন্ততপক্ষে একটি ক্ষেত্রে তো হাদীসসমূহ কুরআন পাকে সংশোধন আনয়ন করেছে, আর তা হচ্ছে ওসিয়াত সম্পর্কিত বিষয়।”
উপরোক্ত দুটি কথা সম্পর্কেও কয়েকটি বাক্য নিবেদন করে আমরা এই সমালোচনার পরিসমাপ্তি টানব।
প্রথম কথাটি মূলত এমন একটি প্রতিক্রিয়া যা হদীসের সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র গ্রন্থাবলীর কোন একটি গ্রন্থ সম্পূর্ণ অগভীর দৃষ্টিতে পাঠ করার পর একজন পাঠকের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু হাদীসের বিরাট ও ব্যাপক ভান্ডার সম্পর্কে বিস্তারিত অধ্যয়নের পর তার পাঠক জানতে পারে যে, যেসব হদীস এক স্থানে সংক্ষিপ্ত আকারে ও সম্পর্কহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোই অন্য স্থানে তার পূর্বাপর সম্পর্কের সাথে এবং সংশ্লিষ্ট সমস্ত ঘটনার সাথে সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে। যেসব হাদীসের ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না, সে সম্পর্কেও যদি চিন্তাভাবনা করা হয় তবে তার মূল পাঠ স্বয়ং তার প্রেক্ষাপটের দিকে ইংগীত করে থাকবে। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট কেবলমাত্র সেইসব লোকই সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন, যাঁরা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলী প্রচুর পরিমাণে অধ্যয়নের পর রসূলুল্লাহ (স) এর যুগ এবং তার সমসাময়িক সমাজের অবস্থা ও ধরন প্রকৃতি উত্তমরূপে উপলব্দি করতে পেরেছেন। তারা কোন একটি সংক্ষিপ্ত হাদীসে হঠাৎ কোন কথা বা কোন অবস্থায় এবং কোথায় ও কোনপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছিল; এবং এই ঘটনা কোন ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয়েছিল। এর কতিপয় উদহারণ আমরা ইতিপূর্বে এই সমালোচনার এক পর্যায়ে কয়েকটি হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসংঙ্গে পেশ করে এসেছি।
হাদীস কি কুরআনের পরিবর্তন ও সংশোধন করে?
দ্বিতীয় কথাটি সম্পর্কে আমাদের নিবেদন এই যে, বিজ্ঞ বিচারক ওসিয়াত সম্পর্কে যেসব হদীসকে কুরআন মজীদে পরিবর্তন বা সংশোধনের সমার্থবোধক সাব্যস্ত করছেন সেগুলোকে যদি সূরা নিসায় বর্ণিত মীরাস সম্পর্কিত বিধানসমূহের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা হয় তবে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ঐসব হাদীসে কুরআন মজীদের নির্দেশের পরিবর্তন বা সংশোধন করা হয়নি, বরং ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এই সূরার দ্বিতীয় রূক’তে কতিপয় নিকটাত্মীয়ের অংশ নির্দিষ্ট করে দেয়ার পর বলা হয়েছে যে, এই অংশসমূহ মৃত ব্যক্তির ওসিয়াত পূর্ণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর বের করা হবে। মনে করুন এক ব্যক্তি ওসিয়াত করল যে, তার কোন ওয়ারিশকে কুরআন কর্তৃক নির্দিষ্ট অংশের কম দিতে হবে, কাউকে বেশী দিতে হবে এবং কাউকে কিছুই দেযা যাবে না, তবে সে মূলত এই ওসিয়াতের মাধ্যমে কুরআন মজীদের নির্দেশের পরিবর্তন বা সংশোধনকারী সাব্যস্ত হবে। এজন্য মহানবী (স) বলেছেঃ
لاوصية بوارث
“ওয়ারিশদের জন্য কোন ওসিয়াত করা যাবে না।” অর্থাৎ কুরআন মজীদে তার জন্য যে অংশ নির্দিষ্ট করে দেযf হয়েছে তা ওসিয়াতের সাহায্যে বিলোপ করা যাবে না, হ্রাসও করা যাবে না এবং বৃদ্ধিও করা যাবে না, বরং কুরআন অনুযায়ী মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। অবশ্য যারা ওয়ারিশ নয় তাদের অনুকূলে, অথবা সামাজিক স্বার্থে অথবা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য যে কোন ব্যক্তি ওসিয়াত করতে পারে। কিন্তু এই সুযোগেও কোন ব্যক্তির কোন কারণে নিজের সমস্ত সম্পত্তি অথবা এর অধিকাংশ যারা ওয়ারিশ নয় তাদের দিয়ে দেয়ার ওসিয়াত করে বসার এবং ওয়ারিশদের বঞ্চিত করার আশংকা ছিল। তাই মহানবী(স) সম্পত্তির মালিকের একতিয়ারসমূহের উপর আরও একটি বিধিনিষেধ আরোপ করেন যে, সে কেবল তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ। ওসিয়াত করতে পারবে এবং অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি সেইসব হকদারের জন্য ত্যাগ করতে হবে, যাদেরকে কুরআন নিকটতর আত্মীয় সাব্যস্ত করেছে এবং উপদেশ দিয়েছে যে,
لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا
“তোমাদের জানা নাই যে, তাদের মধ্যে উপকারের দিক থেকে তোমাদের নিকটতর”-(সূরা নিসাঃ১১)।
কুরআনিক বিধান অনুযায়ী কাজ করার জন্য কুরআনের ধারক ও বাহক রসূল(স) যে নীতিমালা ও আইন-কানূন প্রণয়ন করেছেন তা উত্তমরূপে হৃদয়ংগম করার পর আমাদের বলে দেয়া হোক যে, শেষ পর্যন্ত কোন যুক্তিসংগত দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে এটাকে “পরিবর্তন বা সংশোধন”-এর সংজ্ঞাভুক্ত করা যেতে পারে? এই প্রকারের বক্তব্য রাখার পূর্বে কিছু চিন্তাভাবনা তো করা উচিৎ যে, কুরআন পাকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যদি তার ধারক ও বাহকই না করেন তবে আর কে করবে? আর এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যদি ঐ সময় না করে দেয়া হত তবে ওসিয়াতের অধিকারসমূহ প্রয়োগ করতে গিয়ে লোকেরা কুরআন মজীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আইনের অবয়ব কিভাবে বিকৃত করে ফেলত। আবার এর চেয়েও আশ্চর্যজনক কথা এই যে, এই সঠিক ব্যাখ্যাকে তো বিজ্ঞ বিচারক “পরিবর্তন বা সংশোধন” সাব্যস্ত করেছেন, কিন্তু স্বয়ং নিজের উপরোক্ত সিদ্ধান্তের তিনি নমুনা স্বরূপ কুরআনের তিনটি বিধানের যে মুজতাহিদ সুলভ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন সে সম্পর্কে তিনি মোটেই অনুভব করছেন না যে, মূলত তার নিজের ব্যাখ্যাই “পরিবর্তন ও সংশোধন” এর সংজ্ঞার আওতায় পড়ে।
শেষ নিবেদন
এ হলো সার্বিক যুক্তিপ্রমাণ যা বিজ্ঞ বিচারপতি হাদীস ও সন্নাহ সম্পর্কে নিজের রায়ের পক্ষে পেশ করেছেন। আমরা তার পেশকৃত প্রতিটি যুক্তির বিস্তারিত মূল্যায়নপূর্বক যে আলোচনা পেশ করেছি তা অধ্যয়নপূর্বক প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তি স্বয়ং সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, এসব যুক্তির কতটুকু ওজন আছে এবং এর প্রতিকূলে সুন্নাহ আইনের উৎস হওয়ার এবং হদীসসমূহের নির্ভরযোগ্য সূত্র হওয়ার সপক্ষে আমরা যেসব দলীল-প্রমাণ পেশ করেছি তা কতটা শক্তিশালী। আমরা বিশেষভাবে স্বয়ং বিজ্ঞ বিচারপতির নিকট এবং তার বন্ধুদের নিকট নিবেদন করছি যে, তারা গভীর চিন্তাভাবনা সহকারে আমাদের এই সমালোচনা অধ্যয়ন করুন এবং তাদের নিরপেক্ষ রায় অনুযায়ী একটি উচ্চ আদালাতের বিজ্ঞ বিচারপতিগণের রায় যেরূপ নিরপেক্ষ হওয়া উচিৎ এই সমালোচনা যদি বাস্তবিকই শক্তিশালী যুক্তিপ্রমাণের উপর ভিত্তিশীল হয়ে থাকে তবে তারা আইন অনুযায়ী এমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করুন যার ফলে উক্ত রায় ভবিষ্যতের জন্য নযীর হতে না পারে। বিচারালয়সমূহের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিটি দেশের বিচার ব্যবস্থা ও ন্যায়-ইনসাফের প্রাণস্বরূপ এবং বহুলাংশে তার উপর যে কোন দেশের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। দেশের উচ্চতর আদালতসমূহের রায় যদি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দুর্বল যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে দেওয়া হয় এবং অযথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও অযথার্থ তথ্য সম্বলিত হয় তবে তা তার মান-মর্যাদার জন্য যতটা ক্ষতিকর অন্য কোন জিনিস ততটা ক্ষতিকর নয়। অতএব ঈমানদার সুলভ সমালোচনার মাধ্যমে এ ধরনের কোন ভ্রান্তি চিহ্নিত হয়ে গেলে প্রথম অবসরেই স্বয়ং বিচারালয়সমুহের বিচারকগণের এর প্রতিকারের পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
(সমাপ্ত)