চলমান পেজের সূচীপত্র
ভূমিকা
সুন্নাত অস্বীকার করার ফেতনা ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম দ্বিতীয় হিজরী শতকে উত্থিত হয়েছিল। এই ফিতনার সূত্রপাত করেছিল খারিজী ও মুতাযিলা সম্প্রদায়। খারিজীদের এই ফিতনা উত্থাপনের প্রয়োজন এজন্যে হয়েছিল যে, তারা মুসলিম সমাজে যে নৈরাজ্যে ছড়াতে চাচ্ছিল তার পথে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ (হাদীস) প্রতিবন্ধক ছিল যা এই সমাজকে একটি সুশৃংখল ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাদের এ পথে মহানবী (স) এর সেই সব বাণীও প্রতিবন্ধক ছিল যার বর্তমানে খারিজীদের চরমপন্থী মতবাদ অচল হয়ে পড়েছিল। এ কারণে তারা হাদীসের যথার্থতায় সন্দেহ পোষণ এবং সুন্নাহর অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করার দ্বিবিধ পন্থা অবলম্বন করে।
মুতাযিলাদের এই ফিতনার সূত্রপাত করার প্রয়োজন এজন্য দেখা দেয় যে, অনারব ও গ্রীক দর্শনের সাথে প্রথম বারের মত সাক্ষাত হওয়ার সাথে সাথেই ইসলামী আকীদা- বিশ্বাস, নীতিমালা ও আইন-বিধান সম্পর্কে যেসব সন্দেহের সৃষ্টি হতে থাকে তা পূর্ণরূপে অনুধাবনের পূর্বে তারা কোন না কোনভাবে এর সমাধান দিতে চাচ্ছিল। স্বয়ং এই দর্শনের উপর তাদের এতটা অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি হয়নি যে, তার সমালোচনামূলক মূল্যায়নের ভিত্তিতে তার বিশুদ্ধতা ও শক্তি উপলদ্ধি করতে পারে। দর্শনের নামে যে কথাই এসেছে তারা তাকে সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির দাবী মনে করেছে এবং তারা চাচ্ছিল যে, ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস ও নীতিমালার এমন ব্যাখ্যা করা হোক যাতে তা এই নামমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক দাবীর অনুরূপ হয়ে যায়। এ পথেও হাদীস এবং সুন্নাহ্ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তারাও খারিজীদের মত হাদীসকে সন্দেহযুক্ত মনে করে এবং সুন্নাহকে দলীল হিসাবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।
এই উভয় দলের ফেতনার উদ্দেশ্যে এবং তাদের কৌশল ছিল অভিন্ন। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল, কুরআন মজীদকে তার বাহকের মৌখিক ও আমলী (বাস্তব) ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ থেকে এবং আল্লাহর রসূল (স) স্বীয় পরিচালনায় ও নির্দেশনায় যে চিন্তা ও কর্ম ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র একটি গ্রন্থের আকারে উপস্থাপন করা, অতপর তার একটা মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করে আরেকটি ব্যবস্থায় রূপান্তর করা, যার উপর ইসলামের লেবেল আঁটা থাকবে। এ উদ্দেশ্যে তারা যে কৌশল অবলম্বন করে তার দুটি অস্ত্র ছিলঃ
(এক) হাদীস সম্পর্কে মনের মধ্যে এই সন্দেহ সৃষ্টি করতে হবে যে, তা আদৌ মহানবী (স) এর বাণী কি না?
(দুই) এই মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে যে, কোন কথা বা কাজ মহানবী (স)-এর হলেও তার অনুসরণ ও আনুগত্য করতে আমরা কখন বাধ্য?
তাদের দৃষ্টিভংগী এই ছিল যে, মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) আমাদের পর্যন্ত কুরআন মজীদ পৌছিয়ে দিতে আদিষ্ট ছিলেন। অতএব তিনি তা পৌছে দিয়েছেন। অতপর মুহাম্মদ (স) ইবনে আবদুল্লাহ আমাদের মতই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন তা কি আমাদের জন্য হুজ্জাত (অকাট্য প্রমাণ) হতে পারে?
এই দুটি ফিতনা সামান্য কাল চলার পর নিজের অপমৃত্যু নিজেই ঘটিয়েছে এবং তৃতীয় হিজরী শতকের পর কয়েক শতক পর্যন্ত ইসলামী দুনিয়ার কোথাও তার নামগন্ধও অবশিষ্ট ছিল না। নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো ঐ সময় উল্লেখিত ফিতনার মূলোৎপাটন করেঃ
১.মুহাদ্দিসগণের ব্যাপক অনুসন্ধানমূলক কাজ যা মুসলিম সমাজের সকল চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান লোকদের আশ্বস্ত করে যে, রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাহ যেসব রিওয়ায়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তা কখনও সন্দেহযুক্ত নয়, বরং অতীব বিশ্বস্ত মাধ্যমে উম্মাতের নিকট পৌছেছে এবং তাকে সন্দেহযুক্ত রিওয়ায়াত থেকে পৃথক করার জন্য সর্বোত্তম বুদ্ধিবৃত্তিক মাধ্যম ও উপায় উপকরণ বর্তমান রয়েছে।
২.কুরআনের ব্যাখ্যা, যার সাহায্যে তৎকালীন যুগের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ মুসলিম জনসাধারণের সামনে এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স)-এর মর্যাদা তাই নয়-যা হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীরা তাঁকে দিতে চাচ্ছে। কুরআন মজীদ পৌছে দেয়ার জন্য তাঁকে একজন পত্রবাহক মাত্র নিযুক্ত করা হয়নি, বরং আল্লাহ তাআলা তাঁকে শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, কুরআনের ভাষ্যকার, আইনপ্রণেতা এবং বিচারক ও প্রশাসকও নিযুক্ত করেছিলেন। অতএব স্বয়ং কুরআন মজীদের আলোকেই তাঁর আনুগত্য ও অনুবর্তন আমাদের জন্য ফরয এবং তা থেকে মুক্ত হয়ে যে ব্যক্তি কুরআনের অনুসরণের দাবী করে সে মূলত: কুরআনের অনুসারীই নয়।
৩.সুন্নাত অস্বীকারকারীদের স্বকপোল কল্পিত ব্যাখ্যা- যারা কুরআনকে খেলনায় পরিণত করেছিল। সে বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মুসলিম সর্বসাধারণের সামনে এই সত্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে তুলে ধরেন যে, রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের সাথে কুরআন মজীদের সম্পর্ক ছিন্ন করা হলে দীন ইসলামের অবয়ব কতটা নিকৃষ্টভাবে বিকৃত হয়ে যায়, আল্লাহর কিতাবের সাথে কিভাবে কিভাবে খেলতামাশা করা যায় এবং তার অর্থগত বিকৃতির কি ধরনের হাস্যকর নমুনা সামনে আসে।
৪.উম্মাতের ঐক্যবদ্ধ চিন্তা, যা কোন ক্রমেই একথা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না যে, মুসলিম ব্যক্তি কখনও রসূলুল্লাহ (স)- এর আনুগত্য ও অনুবর্তন থেকে মুক্তও হতে পারে। মুষ্টিমেয় এমন কিছু লোক তো প্রতিটি যুগেই এবং প্রতিটি জাতির মধ্যেই থাকে যারা ছন্দহীন কথার মধ্যেই ছন্দ অনুভবকরে,যুক্তিহীনকথারমধ্যেযুক্তিঅনুভবকরে, কিন্তু সমগ্র উম্মাতের চালিকা শক্তি হওয়া তাদের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। মুসলিম সর্বসাধারণের মানসিক ছাঁচে এই অযৌক্তিক কথা কখনও ঠিকভাবে খাপ খায় না যে, লোকে রসূলুল্লাহ (স)-এর রিসালাতের উপর ঈমানও আনবে আবার নিজের ঘাড় থেকে তাঁর আনুগত্যের রশিও খুলে ফেলবে। একজন সহজ সরল প্রকৃতির মুসলমান যার মনমগজে বক্রতা নেই, কার্যত নাফরমানিতে লিপ্ত হতে পারে,কিন্তু এই আকীদা কখনও গ্রহণ করতে পারে না যে, যেই রসূলের উপর সে ঈমান এনেছে তাঁর আনুগত্য করতে মোটেই বাধ্য নয়।
এটা ছিল সবচেয়ে বড় বুনিয়াদী জিনিস যা শেষ পর্যন্ত সুন্নাহ প্রত্যাখ্যানকরীদের শিকড় কেটে দিয়েছে। উপরন্তু মুসলিম জাতির মেজাজ এত বড় বিদআতকে হজম করার জন্য কোন প্রকারেই প্রস্তুত হয়নি যে, এই পূর্ণাংগ জীবন-বিধান,তার সমস্ত আইন কানুন,বিধি ব্যবস্থা এবং কাঠামো সমেত প্রত্যাখ্যান করা হবে যা রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগ থেকে শুরু হয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, আইম্মাই মুজতাহিদীন (মুজতাহিদ ইমামগণ) এবং উম্মাতের ফকীহগণে পথনির্দেশনায় ধারাবাহিকভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় উত্তরোত্তর ক্রমবিকাশ লাভ করে আসছিল,এবং তা পরিত্যাগ করে ভাবিষ্যতে একটি নতুন ব্যবস্থা এমন লোকদের দ্বারা গড়ে তোলা হবে যারা দুনিয়ার প্রতিটি দর্শন ও প্রতিটি হেয়ালির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামের একটি আধুনিক সংস্করণ বের করতে চায়।
এভাবে ধ্বংসের অতল গহবরে নিমজ্জিত হয়ে সুন্নাত প্রত্যাখ্যানের এই ফিতনা কয়েক শতাব্দী যাবত নিজের শ্মশানভূমিতে পড়ে থাকে। অবশেষে হিজরী ত্রয়োদশ শতকে(খৃষ্টীয় উনবিংশ শতকে) তা পুনরায় জীবন্ত হয়ে উঠে। তার পহেলা জন্ম হয় ইরাকে,এখন পুনর্জন্ম লাভ করেছে ভারতে। এখানে স্যার সায়্যিদ আহমাদ খান ও মৌলভী চেরাগ আলী এর সূচনা করেন। অতপর মৌলভী আব্দুল্লাহ চক্রালোভী এর পতাকাবাহীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। পরে মৌলভী আহমাদুদ-দীন অমৃতসরী এর ভেলা ভাসালেন এবং মাওলানা আসলাম জয়রাজপুরী তা নিয়ে সামনে অগ্রসর হন। অবশেষে আসে চৌধুরী গোলাম আহমাদ পারভেযের ভুমিকা, যিনি এই গোমরাহীকে চরম পর্যায় পৌছান।
এর পুনর্জন্মের কারণও তাই ছিল, যা দ্বিতীয় হিজরী শতকে এর জন্মের কারণ হয়েছিল। অর্থাৎ বাইরের দর্শন ও ইসলাম-বিরোধী সংস্কৃতির সম্মুখীন হয়ে মানসিক পরাজয় বরণ করা এবং সমালোচনা ব্যতীতই বাইরের এসব জিনিসকে সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির দাবী বলে মেনে নিয়ে ইসলামকে তদনুযায়ী ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা। কিন্তু দ্বিতীয় শতকের তুলনায় ত্রয়োদশ শতকের পরিস্থিতি ছিল অনেক ভিন্নতর। ঐ সময় মুসলমানরা ছিল বিজয়ী, তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যও ছিল এবং তারা যেসব দর্শনের সম্মুখীণ হয়েছিল তা ছিল বিজিত ও পরাভূত জাতিসমূহের দর্শন। একারণে তাদের মন- মগজে এসব দর্শনের আক্রমণ খুবই হালকা প্রমাণিত হয় এবং অনতিবিলম্বে তা প্রত্যাখ্যাত হয়।
পক্ষান্তরে ত্রয়োদশ শতকে মুসলমানদের উপর এই হামলা এমন সময় করা হয় যখন তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে থেকে গুটিয়ে আসছিল,তাদের আধিপত্যের এক একটি ইট খসে পড়ছিল, তাদের দেশ শত্রুরা দখল করে নিয়েছিল, অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদেরকে নিকৃষ্টভাবে পংগু করে দেয়া হয়েছিল, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উলোটপালট করে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের উপর বিজয়ী জাতি নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতি,ভাষা, আইন-কানুন এবং নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসন ও শৃংখল পুরোপুরি চাপিয়ে দিয়েছিল। এই অবস্থায় যখন মুসলমানগন বিজয়ী জাতির দর্শন, বিজ্ঞান এবং তাদের আইন-কানুন ও সাংস্কৃতিক নীতিমালার সম্মুখীন হল তখন তাদের মধ্যে পূর্বকালের মুতাযিলাদের তুলনায় হাজার গুণ বেশী ভীত প্রভাবিত মনের মুতাযিলার আবির্ভাব হতে থাকল। তারা মনে করে নিল যে, পাশ্চাত্য থেকে যে মতবাদ. যে চিন্তা, যে ধ্যানধারণা, সভ্যতা-সংস্কৃতির যে নীতিমালা এবং জীবন-বিধান আমদানী হচ্ছে তা সম্পূর্ণ যুক্তিগ্রাহ্য, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তার সমালোচনা করে সত্য-মিথ্যার ফয়সালা করা অজ্ঞতা প্রসূত ধারণা বৈ কিছু নয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ইসলামকে যেভাবেই হোক কেটেছেটে যুগোপযোগী করে নিতে হবে।
এই উদ্দেশ্যে তারা যখনই ইসলামকে মেরামত করতে চাইল তখন তারাও অতীতের মুতাযিলাদের অনুরুপ অসুবিধারই সম্মুখীন হল। তারা অনুভব করল যে,ইসলামের জীবন ব্যবস্থাকে যে জিনিস পৃর্ণাংগ ও বাস্তবরূপে কায়েম করেছে তা হচ্ছে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাহ। এই সুন্নাহই কুরআন মজীদের উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করে মুসলমানদের পূর্ণ সমাজিক ও সাংস্কতিক ধারণার বিনির্মাণ করেছে এবং এই সুন্নাহই জীবনের প্রতিটি শাখায় ইসলামের বাস্তব রূপ মজবুত ভিত্তির উপর গঠন করেছে। অতএব এই সুন্নাহর ব্যাপারে মানুষকে বীতশ্রদ্ধ না করা পর্যন্ত ইসলামের কোনরুপ নতুন মেরামত সম্ভব নয়। তারপর অবশিষ্ট থাকবে কেবল কুরআনের শব্দ ও বাক্যসমূহ, যেগুলো বুঝার ক্ষেত্রে না থাকবে কোন বাস্তব নমুনা,না কোন নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আর না কোন প্রকারের রিওয়ায়াত ও নযীর। এভাবে কুরআনকে অপব্যাখ্যার নিপুণ ফলকে পরিণত করা সহজ হবে এবং ইসলাম পরিণত হবে একটি মোমের পিন্ডে, যাকে দুনিয়ার প্রতিটি প্রচলিত দর্শন অনুযায়ী প্রতি দিন একটি নতুন আকৃতি দান করা যাবে।
এই উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য তারাও আবার অতীত কালে ব্যবহৃত দুটি কৌশল দুটি মারণাস্ত্র হিসাবে অবলম্বন করে। অর্থাৎ একদিকে যেসব হাদীসের মাধ্যমে সুন্নাত প্রতিষ্ঠিত হয়-তার যথার্থতায় সন্দেহের সৃষ্টি করা হল এবং অপরদিকে সুন্নাতের স্বয়ং ও সরাসরি হুজ্জাত (প্রমান) হওয়ার বিষয়কে অস্বীকার করা হল। কিন্তু এখানে পরিস্থিতির পার্থক্য এই কৌশল ও তার মারনাস্ত্রের বিস্তারিত আকারের মধ্যে বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করে দেয়। অতীত কালে যেসব লোক এই ফেতনার পতাকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল তারা ছিল জ্ঞান ও বুদ্ধিতে পরিপক্ক। তারা আরবী ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শী ছিল। কুরআন, হাদীস ও ফিকহ-এর জ্ঞানেও তারা ছিল যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তাদের প্রতিদ্বন্ধিতা হয় সেইসব মুসলমানদের সাথে যাদের জ্ঞান চর্চার ভাষা ছিল আরবী। তখনকার সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল অনেক উন্নত। সেখানে ইসলামী জ্ঞান- বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ সর্বত্র বিচরণ করতেন এবং এই ধরনের জনগণের সামনে কোন কাঁচা কথা এনে পরিবেশন করলে স্বয়ং সেই ব্যক্তিরই বিপাকে পড়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। এ কারণে অতীত কালের মুতাযিলাগণ পরিমাপ করে কথা বলত। পক্ষান্তরে আমাদের যুগে যেসব লোক এই ফিতনা ছড়ানোর জন্য আবির্ভুত হয়েছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক মানও স্যার সায়্যিদ আহমাদ খানের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে একজন থেকে আরেকজনের নিম্নতর হতে থাকে। আর তাদেরকে এমন লোকদের মোকাবিলা করতে হয় যাদের মধ্যে আরবী ভাষা ও ইসলামী জ্ঞানের অধিকারীদের নাম “শিক্ষিত” নয়, এবং “শিক্ষিত” এমন ব্যক্তির নাম যে পার্থিব বিষয়ে চাই যত কিছুই জানুক, কিন্তু, কুরআনের উপর খুব মেহেরবানী করে থাকলে শুধু তার তরজমাটুকু-তাও আবার ইংরেজী তরজমার সাহায্যে পড়তে পারে। হাদীস ও ফিকহ সম্পর্কে বেশী জোর তারা কানে শুনা জ্ঞানের অধিকারী, তাও আবার প্রাচ্যবিদদের পৌছানো জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। ইসলামী রীতিনীতির উপর খুব বেশী হলে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে, আবার তাও এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, কতগুলো বাসিপঁচা হাড়ের সমষ্টি-যাতে ঠোকর মেরে যুগ অনেক সামনে এগিয়ে গেছে। পুনশ্চ ইসলামী জ্ঞান- বিজ্ঞানের ভান্ডার সম্পর্কে তারা এই ধারণায় লিপ্ত হয়েছে যে, ইসলাম সম্পর্কে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানে তারা সম্পূর্ণ সক্ষম। এই অবস্থায় অতীতের মুতাযিলাদের তুলনায় বর্তমান কালের মুতাযিলাদের যোগ্যতার মানদন্ড কতটা নিম্নতর হতে পারে তা সুস্পষ্ট। এখানে জ্ঞানের পরিমাণ কম এবং অজ্ঞাতার বাহাদুরী ও দৃষ্টতা অত্যধিক।
বর্তমানে এই ফেতনার প্রসারের জন্য যে কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে তার গুরুত্বপূর্ন অংশগুলো নিম্নেউল্লেখ করা হলঃ
১. হাদীসকে সন্দেহপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদগণ যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেন তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং নিজেদের পক্ষ থেকে টীকা সংযোজন করে তা মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া,যাতে অজ্ঞ লোকেরা এই বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয় যে, উম্মাত রসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট থেকে কুরআন ব্যতীত কোন জিনিসই নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়নি।
২. ক্রটি বের করার উদ্দেশ্যে হাদীস ভান্ডারে শুদ্ধি অভিযান চালানো-ঠিক সেই ভাবে যেভাবে আর্য সমাজ ও খৃষ্টান মিশনারীরা কখনও কুরআন মজীদে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিল এবং এমন এমন জিনিস বের করে বরং মনগড়াভাবে রচনা করে জনসাধারণের সমানে পেশ করা যাতে তাদের নিকৃষ্টভাবে প্রভাবিত করা যায় যে, হাদীসের গ্রন্থাবলী নেহায়েত লজ্জাজনক অথবা হাস্যকর উপাদানে প্লাবিত। অতপর অশ্রু বিসর্জন পূর্বক এই আবেদন পেশ করা যে, ইসলামকে অপমান থেকে বাঁচাতে হলে এই সমস্ত মূল্যহীন ভান্ডার সমুদ্রে নিক্ষেপ কর।
৩. রসূলুল্লাহ (স) এর রিসালাতের পদমর্যাদাকে শুধুমাত্র একজন ডাকপিয়নের পদ সাব্যস্ত করা যার দায়িত্ব কেবলমাত্র জনগনের নিকট কুরআন মজীদ পৌছে দেয়া।
৪. শুধুমাত্র কুরআন মজীদকে ইসলামী আইনের উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া এবং রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতকে ইসলামী আইন ব্যবস্থার আওতা থেকে বহিস্কৃত করা।
৫. উম্মাতের সকল আলেম, ফকীহ (আইন শাস্ত্রবিদ), মুহাদ্দিস (হাদীস শাস্ত্রজ্ঞ) মুফাসসির (কুরআনের ভাষ্যকার) এবং ভাষাবিশারদ ইমামগণকে অনির্ভরযোগ্য ও অবিশ্বস্ত সাব্যস্ত করা, যাতে মুসলমানগণ কুরআন মজীদের বক্তব্য হৃদয়ংগম করার জন্য তাদের শরনাপন্ন না হয়, বরং তাদের সম্পর্কে এই ভ্রান্তির শিকার হয়যে, তাঁরা সকলে কুরআনের যথার্থ শিক্ষাকে গোপন করার জন্য একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।
৬. স্বয়ং একটি নতুন অভিধান রচনা করে কুরআন মজীদের সমস্ত পরিভাষাসমূহের অর্থের পরিবর্তন সাধন এবং কুরআনের আয়াতসমূহের এমন বিকৃত অর্থ আবিষ্কার করা যা পৃথিবীর যে কোনো আরবী ভাষাবিদের দৃষ্টিতে কুরআনের শব্দ থেকে বের করার কোনো অবকাশ নেই। (মজার ব্যাপার এই যে, যে ব্যক্তি এই কাজ করছে তার সামনে যদি কুরআন মজীদের কয়েকটি আয়াত স্বরচিহৃ বাদ দিয়ে লিখে রাখা হয় তবে সে তা সঠিকভাবে পড়তেও সক্ষম নয়। কিন্তু তার দাবি এই যে, এখন স্বয়ং আরবরাই আরবী জানে না। তাই তাদের বর্ণিত অর্থ যদি কোন আরব কুরআনের শব্দভান্ডারে না দেখতে পায় তবে অপরাধ এই আরবদেরই।)
এই ধ্বংসাত্মক কাজের সাথে সাথে একটা অভিনব ইসলামের বিনির্মাণ কাজও চলছে যার মৌলনীতি সংখ্যায় মাত্র তিনটি,কিন্তু দেখুন না তা কতটা তুলনাহীন মৌলনীতি (!)
১.প্রথম মূলনীতি এই যে, সমস্ত ব্যক্তিমালিকানা খতম করে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকারে ন্যস্ত করা হবে এবং সেই সরকার জনগণের মধ্যে রিযিক বন্টনের সর্বময় কর্তা হবে। এর নাম ‘প্রতিপালন ব্যবস্থা’এবংবলা হয়ে থাকে যে, এই ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাই ছিল কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিগত তের শতাব্দী ধরে কারো পক্ষেই তা বুঝে উঠার সৌভাগ্য হয়নি। শুধুমাত্র অতি বুযুর্গ কার্ল মারক্স এবং তার বিশিষ্ট খলীফা এঞ্জেলসই কুরআনের এই মৌল উদ্দেশ্য বুঝতে সক্ষম হয়েছে।
২.তাদের দ্বিতীয় মূলনীতি হলো, সমস্ত দল-উপদলের বিলুপ্তি সাধন করতে হবে এবং মুসলমানদের কোন দল গঠনের অনুমতিই দেয়া হবে না,যাতে অর্থনৈতিক দিক থেকে অসহায় হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যদি কেন্দ্রীয় সরকারের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করতে চায় তবে যেন অসংগঠিত থাকার ফলে তা করতে সক্ষম না হয়।
৩.তাদের তৃতীয় মূলনীতি এই যে, কুরআন মজীদে যে “আল্লাহ ও রাসূলের” উপর ঈমান আনার, যাদের আনুগত্য করার এবং যাদেরকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার দ্বারা মূলত বুঝানো হয়েছেঃ“জাতির কেন্দ্র” (কেন্দ্রীয় সরকার)। সরকারই যেহেতু স্বয়ং“খোদা আর খোদার রসূল” তাই এই কেন্দ্রীয় সরকার কুরআনের যে অর্থই করবে তাই হবে তার আসল অর্থ। তার কোন নির্দেশ বা বিধান সম্পর্কে এই প্রশ্ন মোটেই তোলা যাবে না যে, তা কুরআনের পরিপন্থী। সে যা কিছুই হারাম করবে তাই হারাম, যা কিছু হালাল করবে তাই হালাল। তার নির্দেশই হচ্ছে শরীআত এবং ইবাদত থেকে শুরু করে পারস্পরিক কার্যক্রম পর্যন্ত যে জিনিসের যে নমুনা সে প্রস্তাব করবে তা মান্য করা ফরজ, বরং ইসলামের শর্ত। যেভাবে ‘রাজা’ ভুল করতে পারেনা, অনুরূপভাবে এই ‘জাতির কেন্দ্র’ ও সম্পূর্ন নির্ভল ও পবিত্র। জনগণের কাজ কেবল তার সামনে মাথা পেতে দেয়। কারণ “আল্লাহ ও রাসূল” না সমালোচনার লক্ষ্য বস্তু হতে পারে, আর না তাদের দ্বারা ভুল করার প্রশ্ন উঠতে পরে, আর না তাদের পরিবর্তন করা যেতে পারে।
এই নতুন ইসলামের “প্রতিপালন ব্যবস্থার” উপর ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা এখনও অনেক কম। কিন্তু তার অবশিষ্ট সকল পুনর্গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্বক শাখাগুলো কতিপয় বিশিষ্ট পরিমন্ডলে খুবই জনপ্রিয় হচ্ছে। আমাদের শাসকদের নিকট তাদের “জাতির কেন্দ্র” শীর্ষক মতবাদ বহুত আবেদন সৃষ্টি করছে। তবে এই শর্তে যে , সমস্ত উপায়- উপকরণ থাকবে তাদের হাতে এটাও তাদের খুবই জনপ্রিয় যে, সমস্ত উপা- উপকরণ থাকবে তাদের হাতে এবং জাতি সম্পূর্ণরূপে অসংগঠিত অবস্থায় তাদের মুষ্টিবদ্ধ হয়ে থাকবে। তা এজন্য পছন্দনীয় মনে করে যে, বৃটিশ রাজত্বকালে তারা যে ধরনের আইন ব্যবস্থার শিক্ষ ও প্রশিক্ষণ লাভ করেছে তার, মূলনীতি, বুনিয়াদী দৃষ্টিভংগী ও আনুষংগিক বিধানের সাথে ইসলামের সুপ্রসিদ্ধ আইন ব্যবস্থার পদে পদে সংঘর্ষ হচ্ছে এবং তার উৎস সম্পর্কেও তাদের কোন জ্ঞান নেই। এই কারণে উপরোক্ত মতবাদ তাদের নিকট খুবই পছন্দনীয় লাগল যে, সুন্নাহ ও ফিকহ-এর ঝঞ্জাট থেকে তারা মুক্তি পেয়ে যাবে এবং শুধুমাত্র কুরআন অবশিষ্ট থাকবে যার ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ আধুনিক অভিধানের সাহায্যে এখন আরও সহজতর হয়ে গেছে। তাছাড়া পাশ্চাত্য প্রভাবিত সমস্ত লোককে এই মতবাদ নিজের দিকে আকৃষ্ট করছে। কারণ ইসলাম থেকে বহিষ্কার হয়েও মুসলমান থাকার জন্য এর চেয়ে উত্তম আর কোন ব্যবস্থাপত্র এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তা ছাড়াও তাদের জন্য এর চেয়ে অধিক খুশীর কথা আর কি হতে পারে যে, যা কিছু পাশ্চত্যে হালাল কি “মোল্লা-মৌলভীর ইসলামে” এতোদিন পর্যন্ত হারাম ছিল তা এখন হালালও হয়ে যাবে এবং হালাকারীদের অনুকূলেই কুরআনের প্রমাণও বিদ্ধমান পাওয়া যাবে?
আমি বিগত পচিশ- ছাব্বিশ বছর ধরে এই ফেতনার মূলোচ্ছদের জন্য অনেক প্রবন্ধ লিখেছি যা আমার বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এখন এই গ্রন্থে অনেক প্রবন্ধ স্থান পাচ্ছে তা দুই অংশে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে আমার ও ডকটর আবদুল ওয়াদুদ সাহেবের মধ্যে “সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা” সম্পর্কে যে দীর্ঘ ও ধারাবাহিক পত্রালাপ হয়েছিল তার সবগুলো একত্র সন্নিবেশ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হাইকোর্টেল একজন সদস্য বিচারপতি মুহাম্মদ শফী সাহেবর একটি সিদ্ধান্ত উধৃত করা হচ্ছে। তিনি ১৯৬০ সালের ২১ জুলাই রাশীদা বেগম বনাম শিহাবুদ্দীন গং-এর মামলায় এই রায় প্রদান করেন এবং আমি এর বিস্তারিত সমালোচনা পেশ করেছি।
এই দুই অধ্যায়ে পাঠকগণ একদিকে হাদীস অস্কীকারকারীদের সমস্ত প্রশ্ন ও যুক্তি প্রমাণ তাদের ভাষায় শুনতে পাবেন এবং অপরদিকে তারা এও জানতে পারবেন যে, দীন ইসলামের সার্বিক ব্যবস্থা ও কাঠামোতে সুন্নাহর আসল মর্যাদা কী। এরপর পাঠক কোন মত গ্রহণ করবেন সেই সিদ্বান্তে উপনীত হওয়া তার নিজের দায়িত্ব।
যেসব বিদগ্ধ পাঠকের হাতে আমার এ গ্রন্থটি পৌছবে তাদের নিকট আমি একটি বিশেষ আবেদন রাখতে চাই। তার হল, এই আলোচনা দীন ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত, যেখানে কোন একটি দিক বর্জন এবং অপর দিক গ্রহণের পরিণতি সুদূরপ্রসারী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীন ইসলামের ভিত্তি সম্পর্কে এই বিতর্ক আমাদের দেশে শুধুমাত্র ছড়িয়েই পড়েনি, বরং এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। আমাদের ক্ষমতাসীন মহলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সুন্নাত প্রত্যাখ্যানের মতবাদে বিভ্রন্ত হচ্ছে। আমাদের উচ্চ বিচারালয়সমূহের বিচারকগণ এর দ্বারপা প্রভাবান্বিত হচ্ছে, এমনকি হাইকোর্ট থেকে সম্পূর্ণত সন্নাহ অস্বীকার করার ভিত্তির উর একটি রায়ও প্রদান করা হয়েছে। কে জানে এই রায়কে ভবিষ্যতে কতো মোকদ্দমায় নযীর হিসাবে পেশ করা হবে। আমদের শিক্ষিত সমাজে এবং বিশেষত সরকারী দফতরসমূহে এই অশুভ আন্দোলন সংগঠিতভাবে চলছে। তাই জরুরী প্রয়েজন মনে করছি,যাদের নিকট এই গ্রন্থখানা পৌছবে শুধুমাত্র আপনারা নিজেরাই যেন তা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে ক্ষান্ত না হন, বরং তা অধ্যয়নের জন্য অন্যদের দৃষ্টিও আকর্ষণ করুন, চাই তারা সুন্নাহগ্রহণকারীই হোক অথবা অস্বীকারকারী। যে ব্যক্তি যেরুপ চায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। কিন্তু শুধু একতরফা অধ্যয়নপূর্বক নিজের একটি দৃষ্টিভংগী গড়ে তোলা এবং প্রতিপক্ষের বক্তব্যে আমল দিতে অস্বীকার করা কোন শিক্ষিত লোকের জন্য শোভনীয় নয়। এই গ্রন্থে যেহেতু দুই পক্ষের বক্তব্যই বিস্তারিতাভাবে এসে গেছে তাই আশা করা যায়, এটা সুন্নাহ গ্রহণকারী ও সুন্নাহ প্রত্যাখ্যানকারী উভয় দলকে একটি ভরসাম্যপূর্ন সিদ্ধান্তে পৌছতে সাহায্য করবে।
লাহোর,৩০ জুলাই, ১৯৬১ খৃ.
বিনীত
আবুল আ’লা
সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা
একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র বিনিময়
(‘বাযমে তুলূয়ে ইসলাম’ শীর্ষক মাসিক পত্রিাকার একজন প্রসিদ্ধ সদস্য জনাব ডকটর আবদুল ওয়াদুদ এবং এই গ্রন্তকারের মধ্যেত সুন্নাহকে ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে যে পত্র বিনিময় হয়েছিল একানে তা উদ্ধৃত করা হল)।
ডকটর সাহেবের প্রথম পত্র
মাখদূম ও মুহতারাম মওলানা! আপনি দীর্ঘজীবি হোন।
আসসালামু আলাইকুম। সংবিধান গ্রণয়নের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিটি সং মুসলমানের দীনী আশা-আকাংখার মৌলিক দাবী এই যে, পাকিস্তানের আইন ইসলামের স্থায়ী ও স্বকীয় মূল্যেবোধের ভিত্তিতে প্রণীত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হোক। এ প্রসংগে আইন কমিশনের প্রশ্নমালার জওয়াবে আপনার এবং অপরাপর বিশিষ্ট আলেমগণের এই অভিন্ন দাবীও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, পাকিস্তানের জন্য প্রণীত আইনের ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। “সুন্নাতের” বাস্তব গুরুত্বকেও আমি অস্বীকার করছি না এবং তার এই গুরুত্বকে খতম করার অভিপ্রায়ও আমার নেই। কিন্তু সুন্নাতকে যখন ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে তখন এটি সন্দেহ অবশ্যম্ভাবীরূপে মন-মগজে উত্থিত হয় এবং তার পরিণতিতে যেসব প্রশ্নের উদয় হয় তা আপনার সামনে পেশ করছি এবং আশা করছি আপনি প্রথম অবসরেই এই সন্দেহের অপনোদনকল্পে উত্তর প্রদান করবেন। প্রশ্নগুলো নিম্নেপ্রদত্ত হলঃ
১. আপনার মতে “সুন্নাত”-এর অর্থ কি? অর্থাৎ যে যেভাবে কিতাব বলতে কুরআন মজীদকে বুঝায় অনুরূপভাবে সুন্নাত (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়া সাল্লামের সুন্নাত ) – এর অর্থই বা কি?
২. আমাদের নিকট (কুরআনের মত) এমন কোন কিতাব আছে কি যার মধ্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত ধারাবাহিকভাবে সুগ্রথিত হয়েছে? অর্থাৎ কুরআনের মত সুন্নাতেরও কোন মৌলিক ও অর্থবহ গ্রন্থআছে কি?
৩. রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের এই গ্রন্থের মূলপাঠ সকল মুসলমানের নিকট কি কুরআন মজীদের মূল পাঠের অনুরূপ গ্রহণযোগ্য ও সর্বসমর্থিত এবং সন্দেহ ও সমালোচনার উর্ধ্বে?
৪. অনুরূপ কোন কিতাব যদি বর্তমান না থাকে তবে কুরআনের কোনো আয়াত বা আয়াতাংশ সম্পর্কে যেমন সহজেই বুঝা যায় যে, এটি কুরআন মাজীদের আয়াত, তেমটি এটা কিভাবে জানা যাবে যে, অমুক কথা রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত কিংবা সুন্নাত নয়?
আমি আপনাকে নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, আমি অন্তর ও দৃষ্টির পূর্ন একাত্মতা সহকারে ইসলামী আইনকে এতোটা গুরুত্বপূর্ন মনে করি যে, এটাকে একজন মুসলমানের জীবনের উদ্দেশ্য হিসাবে স্বীকার করি। আমার এই অকৃত্রিম আবেদনের উদ্দেশ্য হলো, আমি চাই ইসলামী আইনের দাবী করতে গিয়ে ইসলামপ্রিয় লোকদের মন-মগজে তার একটি সুস্পষ্ট, অভিন্ন ও কার্যোপযোগী রূপরেখা বর্তমান থাকুক। যাতে দেশের ধর্মহীন বুদ্ধিজীবীরা পূর্ণ শক্তিতে ইসলামী আইনের বিরুদ্ধে যেরূপ তৎপর রয়েছে তার মোকাবিলা করার জন্য ইসলামপ্রিয় শক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি না হয়। আইনের ব্যাপারে যেহেতু জনসাধারণের মনে পেরেশানী লক্ষ্য করা যায়, তাই তাদের অবহিতির জন্য আপনার প্রদত্ত উত্তর পত্রিকায় প্রকাশ করা হলে আশা করবো তাতে আপনার কোন আপত্তি থাকবে না। ওয়াসসালাম।
বিনীত
আবদুল ওয়াদুদ
উত্তর
শ্রদ্ধেয়,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
২১ মে , ১৯৬০ ঈসাঈ তারিখে আপনার পত্র হস্তগত হয়েছে। আপনি যেসব প্রশ্ন করেছেন তা আজ আপনি প্রথম করেননি। ইতিপূর্বেই বিভিন্ন মহল থেকে তা উত্থাপিত হয়েছে এবং তার জওয়াবও আমি পরিষ্কার ভাষায় প্রদান করেছি। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার একই ধরনের প্রশ্নাবলীর পুনরাবৃত্তি করা এবং পূর্বের দেয়া উত্তরসমূহের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা কোন যুক্তিসংগত কথা নয়। যদি ধরে নেয়া হয় যে, এ সম্পর্কে অনেক পূর্বেই আমি যে জবাব দিয়েছি তা আপনি অবহিত নন, তবে আমি আপনাকে তার বরাত বলে দিচ্ছে(দ্র. তরজমানুল কুরআন,জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ., পৃ. ২০৯-২২০: ডিসেম্বর ১৯৬৮ খৃ.,পৃ. ১৬০-১৭০)। আপনি তাঅধ্যয়নপূর্বক বিস্তারিতভাবে জানান যে, আপনার প্রশ্নাবলীর মধ্যে কোন প্রশ্নের জবাব সেখানে নাই এবং যেসব প্রশ্নের উত্তর বর্তমান আছে তার উপর আপনার কি আপত্তি আছে।
আপনি যদি আপনার এই পত্রের সাথে আমার ঐ উত্তরমালাও ছাপানোর ইচ্ছা রাখেন তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার উল্লেখিত প্রবন্ধদ্বয়ও হুবহু ছাপিয়ে দিন। কারণ মূলত আমার পক্ষ থেকে সেগুলিই আপনার প্রশ্নাবলীর জবাব। এজন্য আপনি বলতে পারেন না যে, আমি আপনার প্রশ্নবলীর উত্তর দিতে অনীহা প্রকাশ করেছি।
বিনীত
আবুল আ’লা
ডকটর আবদুল ওয়াদুদ সাহেবের দ্বিতীয় পত্র
শ্রদ্ধেয় মাওলানা, আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি হোক!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আপনার পত্র পেয়েছি। পত্রোত্তরের জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। আমি জানি, এই ধরনের প্রশ্নাবলী ইতিপূর্বেও বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়েছিল। কিন্তু আমার জন্য বিশেষভাবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন এজন্য হয়েছে যে, উল্লেখিত প্রশ্নাবলীর সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট জবাব পর্যন্ত আমার নজরে পড়েনি।
আপনি আপনার যেসব প্রবন্ধের প্রতি দিকনির্দেশ করেছেন তা আমি দেখেছি। কিন্তু আমাকে খুবই আফসোসের সাথে এই আবেদন করতে দিন যে, সেখানেও আমি আমার প্রশ্নাবলীর সুনির্দিষ্ট জবাব পাইনি। বরং তাতে আমার অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ সেখানে এমন কয়েকটি কথা আছে যা আপনার অন্যান্য প্রবন্ধের বিপরীত। যাই হোক বিতর্ক আমার উদ্দেশ্য নয় (আর না আপনার মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে তার দুঃসাহস আমি করতে পারি), বরং বক্তব্য অনুধাবনই আমার উদ্দেশ্য। তাই আপনার প্রবন্ধ পাঠে আমি যা কিছু অনুধাবন করতে পেরেছি তা নিম্নেপেশ করছি। আমি যদি সঠিক অনুধাবন করে থাকি তবে তার স্বীকৃতি দিন, আর ভুল বুঝে থাকলে অনুগ্রহপৃর্বক তার ব্যাখ্যা প্রদান করুন। এজন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব।
১. আপনি বলেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে যা কিছু বলেছেন, অথবা কার্যত করেছেন, তাকে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত বলা হয়।
এই বক্তব্য থেকে দুটি সিদ্ধান্তে পৌছা যায়।
(ক) রসূলুল্লাহ (স) এই তেইশ বছরের জীবনে যেসব কথা ব্যক্তি হিসাবে বলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
(খ) ‘সুন্নাত’ হচ্ছে কুরআনের বিধান ও মৌলনীতির ব্যাখ্যা। কুরআন ব্যতীত দীন ইসলামের মূলনীতি অথবা বিধান নির্ধারণ করা যায় না এবং ‘সুন্নাত’ কুরআনের কোন নির্দেশ রহিত (মানসূখ) করতে পারে না।
২. আপনি বলেছেন, এমন কোন গ্রন্থ বর্তমান নাই যার মধ্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের সবই পূর্ণরুপে সংকলিত পাওয়া যেতে পারে এবং যার মূল পাঠ (মতন) কুরআন মজীদের মূল পাঠের মত সমস্ত মুসলমানের নিকট।
৩. আপনি আরও বলেছেন, হাদীসের বর্তমান সংকলনসমূহ থেকে সহীহ হাদীসসমূহ পৃথক করা যাবে। এজন্য হাদীসসমূহ যাচাইয়ের যে মূলনীতি পূর্ব থেকে স্থিরিকৃত আছে তা চুড়ান্ত নয়। রিওয়ায়াতের মূলনীতি ছাড়াও দিরায়াতের সাহায্য নেয়া যেতে পারে এবং যেসব লোকের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের দীর্ঘ চর্চার ফলে সুগভীর দূরদৃষ্টি সৃষ্টি হয়েছে তাদের দিরায়াতই গ্রহণযোগ্য হবে।
৪. হাদীসসমূহের এভাবে যাচাই করার পরও একথা বলা যায় না যে, কুরআন যেমন আল্লাহর বাণী, এটাও তেমনি রসূলুল্লাহ (স) এর বাণী।
আমি আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। ওয়াসসালাম।
বিনীত
আবদুল ওয়াদূদ
উত্তর
মুহতারামী ও মুকাররামী,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আপনার চিঠি ২মে, ১৯৬০ খৃ. তারিখে ডাক মারফত হস্তগত হয়েছে। এরপর আপনি পুনর্বার ২৮ মে একই চিঠির প্রতিলিপি লোক মারফতও পাঠিয়েছেন। কিন্তু অবিরাম ব্যস্ততার কারণে এখন পর্যন্ত উত্তর দিতে পারিনি। এই অপারগতার জন্য আমি দঃখিত।
আপনি আপনার পত্রে এই নিশ্চয়তা প্রদানে আমি আনন্দিত যে, পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া আপনার উদ্দেশ্য নয়,বরং আপনি বিষয়টি হৃদয়ংগম করতে চাচ্ছেন। আপনার মত ব্যক্তিত্বের নিকট আমি এটাই আশা করছিলাম। কিন্তু বিষয়টি বুঝার জন্য আপনি পত্র মাধ্যমে যে পন্থা অবলম্বন করেছেন তা আপনার নিশ্চয়তা প্রদানের সাথে সামান্যতম সামঞ্জস্য রাখে, অন্তত আপনার চিঠি থেকে তা আমি অনুভব করতে পারছি না। আপনার ২১ মে তারিখের চিঠিটি বের করে পুনরায় পাঠ করুন। তাতে আপনি চারটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন আমার সামনে রেখে সেগুলোর উত্তর চেয়েছিলেন। আমি ঐ তারিখেই সে পত্রের উত্তরে আপনাকে লিখেছিলাম, আপনি তরজমানুল কুরআনের ১৯৫৮ সনের জানুয়ারী সংখ্যা এবং ডিসেম্বরে সংখ্যায় আমার অমুক অমুক প্রবন্ধ অধ্যয়নপূর্বক আমাকে বিস্তারিতভাবে বলুন যে, আপনার প্রশ্নবলীর মধ্যে কোন প্রশ্নটির জবাব তাতে নেই এবং যেসব প্রশ্নের জবাব তাতে বর্তমান আছে তার উপর আপনার কি আপত্তি আছে। কিন্তু আপনি ঐসব প্রবন্ধ পাঠ করে আপনার প্রথম দিককার প্রশ্নবলীর আলোকে সে সম্পর্কে কোন বক্তব্য রাখার পরিবর্তে আরও কিছু প্রশ্ন যোগ করেছেন এবং এখন আপনি চাচ্ছেন যে, আমি এগুলোর উত্তর দেই। একটি আলোচনা শেষ করার পূর্বে আরেকটি আলোচনা উত্থাপন করা এবং কোন সমাপ্তি ছাড়া একইভাবে বক্তব্যের পর বক্তব্যের ধারা অব্যাহত রাখাটা কি বাস্তবিকই কোন বিষয় হৃদয়ংগম করার কোন পন্থা হতে পারে?
আপনার নতুন প্রশ্নাবলীর উপর আলোকপাত করার পূর্বে আমি চাই, আপনি আপনার প্রথম দিককার প্রশ্নবলীর দিকে প্রত্যাবর্তন করুন এবং স্বয়ং দেখুন, ঐ প্রশ্নগুলোর একেকটির কি উত্তর আপনি আমার সেসব প্রবন্ধে পেয়েছেন এবং তা কিভাবে উপেক্ষা করেছেন।
সুন্নাত কি?
আপনি চারটি প্রশ্ন এই কারণে উত্থাপন করেছেন যে, আমি আইন কমিশনের প্রশ্নমালার জবাব দিতে গিয়ে “ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে সুন্নতের উল্লেখ করেছিলা”।অন্য কথায় আপনার এই প্রশ্ন কয়টি “সুন্নাতের আইনগত মর্যাদার” সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এই প্রসংগে আপনার প্রথম প্রশ্ন ছিল: “আপনার মতে সুন্নাতের অর্থ কি? অর্থাৎ কিতাব বলতে যেভাবে কুরআন মজীদকে বুঝায়, অনুরূপভাবে সুন্নাত (অর্থা রসূলুল্লাহর সুন্নাত) বলতে কি বুঝায়”?
এই প্রশ্নের যে উত্তর আমার পূর্বেকার প্রবন্ধসমূহে দেখতে পেয়েছেন, তা এইঃ:
এই মুহাম্মদী শিক্ষা সেই উচ্চতর আইন যা সর্বোচ্চ বিধানদাতার (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার) মর্জি ও ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিধান মুহাম্মাদ (স) থেকে আমাদের নিকট দুইটি মাধ্যমে পৌছেছে। এক, কুরআন মজীদ যা অক্ষরে অক্ষরে মহান আল্লাহর বিধান ও তাঁর হেদায়াতের সমষ্টি। দুই, মুহাম্মাদ (স)-এর উসওয়া-ই হাসানা (অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ) , অথবা তাঁর সুন্নাত যা কুরআন মজীদের উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। মুহাম্মদ (স) শুধুমাত্র আল্লাহর পত্রবাহকই ছিলেন না যে, তাঁর কিতাব পৌছে দেয়া ব্যতীত তাঁর আর কোন দায়িত্ব ছিল না, বরং তিনি তাঁর নিয়োগকৃত পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা ও শিক্ষকও ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কানূনে ইলাহীর ব্যাখ্যা প্রদান করা, তার সঠিক উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেয়া, তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী লোকদের প্রশিক্ষণ দেয়া। অতপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের সমন্বয়ে একটি সুসংগঠিত জামায়াতের রূপ দান করে সমাজের সংশোধন ও সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালানো। অতপর এই সংশোধিত সমাজকে একটি সং ও সংশোধনকারী রাষ্টের রূপ দান করে দেখিয়ে দেয়া যে, ইসলামের আদর্শ ও নীতিমালার উপর একটি পূর্ণাংগ সভ্যতা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মহনবী (স)-এর এই সমগ্র কাজই হচ্ছে সুন্নাত যা তিনি তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে আঞ্জাম দিয়েছেন। তাঁর এই সুন্নাত কুরআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ আইন প্রণেতার উচ্চতর আইনের রূপায়ন ও পূর্ণতা বিধান করে। আর ইসলামী পরিভাষায় এই উচ্চতর আইনের নাম শরীআত” (তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ.পৃ.২১০-২১১)।
“এ এক অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নবূওয়াতের পদে সমাসীন হওয়ার পর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে শুধুমাত্র কুরআন মজীদ পৌছে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং একটি সামগ্রিক বিপ্লবও পরিচালনা করেন, যার ফলশ্রুতিতে একটি মুসলিম সমাজের জন্ম হয়, সভ্যতা- সংস্কৃতির একটি নতুন ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে এবং একটি রাষ্টীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, কুরআন মজীদ পৌছে দেয়া ছাড়াও মুহাম্মদ (স) অন্য যে কাজটি করলেন তা শেষ পর্যন্ত কি হিসাবে করলেন? তা কি নবী হিসাবে করেছেন-যেখানে তিনি কুরআনের অনুরূপ আল্লাহর মর্জি ও ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করতেন? অথবা তাঁর নবূওয়াতী পদমর্যাদা কি কুরআন মজীদ পৌছে দেয়ার পর শেষ হয়ে গেছে এবং অতপর তিনি সাধারণ মুসলমানদের মত একজন মুসলান হিসাবে থেকে যান-যাঁর কথা ও কার্যবলী নিজের মধ্যে সরাসরি কোন আইনগত মর্যাদা রাখে না? প্রথম কথা স্বীকার করে নিলে সুন্নাতকে কুরআনের সাথে আইনের উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্য দ্বিতীয় অবস্থায় তাকে আইনের উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
এ ব্যাপারে কুরআনের বক্তব্য সম্পূর্ন সুস্পষ্ট যে, মুহাম্মাদ (স) শুধুমাত্র পত্রবাহক ছিলেন না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত পথপ্রদর্শক, আইন প্রণেতা এবং শিক্ষকও ছিলেন, যাঁর আনুগত্য ও অনুবর্তন মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক এবং যাঁর জিন্দেগীকে গোটা ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য আদর্শ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিবেক বুদ্ধি একথা মেনে নিতে সম্মত নয় যে, একজন নবী শুধুমাত্র আল্লাহর কালাম পড়ে শুনিয়ে দেয়ার সীমা পর্যন্তই নবী এবং তারপরে তিনি একজন সাধারণ মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিটি যুগে এবং তাঁর আদেশ-নিষেধকে বাধ্যতামূলক বলে মেনে নিয়েছে। এমনকি কোন অমুসলিম পন্ডিতও এই বাস্তব বিষয়টি অস্বীকার করতে পারেনা যে, মুসলমানগণ সর্বদা মুহাম্মদ (স)-এর এই মর্যাদাই স্বীকার করে নিয়েছে আর এই কারণে ইসলামের আইন ব্যবস্থা কুরআনের পাশাপাশি সুন্নাতকে আইনের দ্বিতীয় উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এখনি আমি বলতে পারছি না যে, কোন ব্যক্তি সুন্নাতের এই আইনগত মর্যাদাকে কিভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত সে পরিষ্কারভাবে এ কথা না বলে যে, মুহাম্মদ (স) কে এই মর্যাদা কি স্বয়ং সে দিচ্ছে, নাকি কুরআন তাঁকে এই মর্যাদা প্রদান করেছে? প্রথম ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে তার বক্তব্যের কোন সম্পর্ক নাই। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাকে কুরআন থেকে নিজ দাবীর সমর্থনে প্রমাণ পেশ করতে হবে”-(তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ.পৃ.২১৬-২১৭)।
এবার আপনি বলুন, “সুন্নাত বলতে কি বুঝায়” আপনার সে প্রশ্নের জবাব আপনি পেয়েছেন কি? আর আপনি জানতে পারছেন কি না যে, ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে যে সুন্নাতের উল্লেখ করা হয় তা কি জিনিস? অন্যান্য প্রশ্ন উত্থাপনের পূর্বে আপনাকে একথা পরিষ্কার করতে হবে যে, আপনার মতে রসূলুল্লাহ (স) কুরআন পড়ে শুনিয়ে দেয়া ছাড়াও দুনিয়াতে আরও কোন কাজ করেছেন কি না, যদি করে থাকেন তবে তা কি হিসাবে করেছিলেন? যদি আপনার মতে এই কাজ করে দেয়ার পর মহানবী (স) সাধারণ মুসলমানদের মতই একজন মুসলমান হয়ে গিয়ে থাকেন এবং কুরআন পাঠ করে শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত কথা ও কাজে তাঁর নবী সুলভ মর্যাদা ছিল না, তাহলে আপনি একথা পরিষ্কার করে বলুন এবং এটাও বলে দিন যে, আপনার এই মতের উৎস কি? এটা কি আপনার মনমগজ প্রসূত কথা,নাকি কুরআনে এর সমর্থনে কোন প্রমাণ আছে? আপনি যদি একথা স্বীকার করেন যে, আল্লাহ তাআলার মনোনীত পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা,বিচারক, শিক্ষক ও অভিভাবক হিসাবে মহানবী (স) একটি মুসলিম সমাজ গঠন করার এবং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রণয়ন করে এবং চালিয়ে দেখানোর যে কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, তাতে তাঁর একজন নবীসুলভ মর্যাদা ছিল, তবে তা সেই সুন্নাত কি না ইসলামে যার আইনের ভিত্তি হিসাবে মর্যাদাথাকা উচিৎ? এটা পরের কথা যে, এই সুন্নাত কোন জিনিসের উপর প্রয়োগ হয় এবং কোন জিনিসের উপর প্রয়োগ হয়না। প্রথমে তো আপনাকে একথা পরিষ্কার বলতে হবে যে. কুরআন মজীদ ছাড়াও রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত স্বয়ং কোন জিনিস কি না? এবং সেটাকে আপনি কুরআনের পাশাপাশি আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করেন কি না? যদি তা স্বীকার না করেন তবে তার অনুকূলে আপনার প্রমাণ কি? এই মৌলিক কথা যতক্ষণ না সুস্পষ্ট হবে ততক্ষণ আপনার দ্বিতীয় পত্রে উত্থাপিত প্রশ্নবলীর উপর আলোকপাত করে কি লাভ?
সুন্নাত কি অবস্থায় বর্তমান আছে
আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, “কুরআনের অনুরূপ আমাদের এখানে কি এমন কোন গ্রন্থ বর্তমান আছে যার মধ্যে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত ধারাবাহিকভাবে মওজুদ রয়েছে? অর্থাৎ কুরআনের মত সুন্নাতের কি পূর্ণাংগ কোন কিতাব আছে?”
এই প্রশ্নের জবাবও আমার উধৃত প্রবন্ধে বর্তমান ছিল এবং আপনি তা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে থাকলে এর জবাবও পেয়ে থাকবেন। আমি পুনরায় তা এখানে তুলে দিচ্ছি যাতে আপনি পূর্বে পেয়ে না থাকলে এখন তা পেয়ে যান।
“সুন্নাতকে স্বয়ং আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করে নেয়ার পর এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তা জানার উপায় কি? আমি এর উত্তরে আরজ করব, আজ চৌদ্দশত বছর অতীত হওয়ার পর আমরা প্রথমবারের মত এই প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি যে, দেড় হাজার বছর পূর্বে যিনি নবী হিসাবে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কি সুন্নাত রেখে গিয়েছিলেন? দুটি ঐতিহাসিক সত্য অনস্বীকার্যঃ
এক, কুরআন মজীদের শিক্ষা এবং মুহাম্মদ (স)-এর সুন্নাতের ভিত্তিতে ইসলামের সূচনাতে যে সমাজ প্রথম দিন কায়েম হয়েছিল তা সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে জীবন্ত রয়েছে, তা গোটা জীবনকালে এক দিনের জন্যও বিচ্ছিন্ন হয়নি এবং তার সবগুলো প্রতিষ্ঠিত এই সমগ্রকালে উপর্যুপরি কর্মতৎপর থাকে। আজ দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তাপদ্ধতি,নৈতিক মূল্যবোধ (value), ইবাদত-বন্দেগী, আচার-ব্যবহার, লেনদেন, জীবনদর্শন ও জীবনপদ্ধতির দৃষ্টিকোণ থেকে যে গভীর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, যার মধ্যে মতভেদের তুলনায় ঐক্য ও মিলনের উপাদান অধিক পরিমাণে বর্তমান, যা তাদেরকে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সত্ত্বেও একই উম্মাত হিসাবে গেথে রাখার সর্বাপেক্ষা মৌলিক ও বুনিয়াদী কারণ হয়ে রয়েছে-তা প্রমাণ করে যে, এই সমাজকে কোন একক সুন্নাতের উপরই কায়েম করা হয়েছিল এবং সেই সুন্নাত এই দীর্ঘ কালের পরিক্রমায় ক্রমাগতভাবে অব্যাহত রয়েছে। এটা কোন লুপ্ত জিনিস নয় যার অন্বেষণের জন্য আমাদের অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
দ্বিতীয় উজ্জ্বল ও স্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্য এই যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর থেকে প্রতিটি যুগে মুসলমানগণ নিরবচ্ছিন্নভাবে জানতে চেষ্টা করে যে, প্রামান্য ও প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত কি এবং কি জিনিস কোন কৃত্রিম পন্থায় তাদের জীবন ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করছে। যেহেতু সুন্নাত তাদের নিকট আইনের মর্যাদা সম্পন্নএবং এর ভিত্তিতে সুন্নাত তাদের বিচারালয়সমূহে রায় প্রদান করা হতো এবং তার ভিত্তিতে তাদের ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যাবতীয় বিষয় পরিচালিত হতো, তাই এর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই বিশ্লেষণের উপায়-উপকরণ এবং তার ফলাফলও ইসলামের প্রাথমিক খিলাফত থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বংশ পরস্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা লাভ করেছি এবং কোন বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই প্রতিটি বংশধরের (generation) সম্পাদিত কাজ সংরক্ষিত রয়েছে।
এই দুটি সত্যে যদি কেউ উত্তমরূপে অনুধাবন করে এবং সুন্নাতকে জানার মাধ্যমসমূহ যথারীতি অধ্যয়ন করে তবে সে কখনও এমন সন্দেহের শিকার হতে পারে না যে, আজ হঠাৎ সে এক অসমাধানযোগ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে”– (তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮খৃ., পৃ.২১৮)।
একই বিষয়ের উপর পুর্নবার আলোকপাত করতে গিয়ে আমি আমার দ্বিতীয় প্রবন্ধে, যার বরাতও আগেই আপনাকে দিয়েছি, লিখেছিলাম যেঃ
“মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সল্লাম তাঁর নবূওয়াতী জিন্দেগীতে মুসলমানদের জন্য শুধুমাত্র একজন পীর-মুরশিদ ও ধর্মীয় বক্তাই ছিলেন না, বরং কার্যত নিজের জামাআতের নেতা, পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা, বিচারক, রাষ্টনায়ক, পৃষ্ঠপোষক, শিক্ষক সবকিছুই ছিলেন এবং আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা থেকে শুরু করে বাস্তব জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুসলিম সমাজের সম্পূর্ণ গঠন তাঁরই নির্দেশিত, শিখানো এবং নির্ধারিত পন্থায় হয়েছিল। এজন্য কখনও এটা হয়নি যে, তিনি নামায, রোযা ও হজ্জের অনুষ্ঠনাদির যে শিক্ষা দান করে থাকবেন কেবল তাই মুসলমানদের মধ্যে চালু আছে এবং অন্যান্য সব কথা তারা কেবল ওয়াজ-নসীহত হিসাবে শুনেই ক্ষান্ত থাকবেন। বরং বাস্তবে যা ঘটেছে তা এই যে, যেভাবে তাঁর শিখানো নামায সাথে সাথে মসজিদে চালু হয় এবং জামাআতসমূহও কায়েম হতে থাকে, ঠিক সেভাবেই বিবাহ-শাদী, তালাক ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে যে আইন-কানুন তিনি নির্ধারন করেন, মুসলিম পরিবারগুলোতে তার বাস্তব অনুসরন শুরু হয়ে যায়। লেনদেন আদান-প্রদানের যে নিয়ম কানূন তিনি নির্ধারণ করে দেন, বাজারসমূহে তার প্রচলন হয়ে যায়। মোকদ্দমাসমূহের যে রায় তিনি প্রদান করেন তাই রাষ্টীয় বিধান হিসাবে স্বীকৃতি পায়। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের সাথে তিনি যে আচরণ করেন এবং বিজয়ী হয়ে বিজীত এলাকায় জনগণের সাথে তিনি যে আচরণ করেন তা-ই মুসলিম রাষ্টের বিধিবদ্ধ আইনে পরিণত হয় এবং সার্বিকভাবে ইসলামী সমাজ ও তার জীবন ব্যবস্থা তার সমস্ত শাখা-প্রশাখাসহ সেইসব সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় স্বয়ং তিনি যার প্রচলন করেন অথবা পূর্ব থেকে প্রচলিত রীতিনীতির মধ্যে যেগুলোকে বহাল রেখে তিনি ইসলামী সুন্নাতের অংশে পরিণত করেন।
এগুলো ছিল জ্ঞাত, পরিচিত ও প্রসিদ্ধ সুন্নাত যেগুলো মসজিদ থেকে শুরু করে পরিবার, বাজার, বিচারালয়, রাজপ্রসাদ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যন্ত মুসলমানদের সামাজিক জীবনের সমস্ত শাখা ও বিভাগ মহানবী (স)-এর জীবদ্দশায়ই কার্যকর হতে থাকে এবং পরে খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে নিয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামো তার উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। বিগত শতক পর্যন্ত তো এসব প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক সূত্র একদিনের জন্যও কর্তিত হয়নি। এরপরে যদি কোনরূপ বিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত হয়ে থাকে তবে তা শুধুমাত্র সরকার, বিচার বিভাগ এবং আইন বিভাগ ইত্যাকার প্রতিষ্ঠনসমূহ কার্যত এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে। এসব সুন্নাতের ব্যাপারে একদিকে হাদীসের নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াত এবং অন্যদিকে উম্মাতের অব্যাহত আমল, দুটিই পরস্পরের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ- (তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ., পৃ. ১৬৭)।
পুনরায় সামনে অগ্রসর হয়ে এ প্রসংগে আরো ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমি এও লিখেছিলামঃ
এসব জ্ঞাত ও প্রসিদ্ধ সুন্নাত ব্যতীত আরেক প্রকারের সুন্নাত এরুপ ছিল যা রসূলুল্লাহ (স)-এর জীবদ্দশায় প্রসিদ্ধ লাভ করেনি এবং সাধারণভাবে প্রচলিত হয়নি, সেগুলো বিভিন্ন সময়ে মহানবী (স)-এর কোন সিদ্ধান্ত,বাণী, আদেশ-নিষেধ, মৌন সমর্থন [মৌন সমর্থন মূলে রয়েছে ‘তাকরীর’। এর অর্থ রসূলুল্লাহ (স) নিজের উপস্থিতিতে কোন কাজ হতে দেখলেন, অথবা কোন পন্থার প্রচলন হল এবং তিনি তা নিষিদ্ধ করেননি। অন্য কথায় তাকরীর এর অর্থ কোন জিনিস বহাল রাখা-(গ্রন্থকার)।] ও অনুমতি অথবা কাজ দেখে বা শুনে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির গোচরে এসেছিল এবং সাধারন লোকেরা সে সম্পর্কে অবহিত হতে পারেনি।
এসব সুন্নাতের জ্ঞান, যা বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল, উম্মাত সংগ্রহ করার অব্যাহত প্রচেষ্টা মহানবী(স)-এর ইন্তেকালের পরপরই শুরু করে দেয়। কারণ খলীফা,প্রশাসকবর্গ, বিচারকমন্ডলী, মুফতী ও জনসাধারণ সকলে স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে আগত সমস্যা সম্পর্কে কোন ফয়সালা অথবা কাজ নিজের রায় ও মাসআলা নির্গত করার ভিত্তিতে করার পূর্বে এটা জ্ঞাত হওয়া অত্যাবত্যকীয় মনে করতেন যে, এই প্রসংগে মহানবী (স)-এর কোন পথনির্দেশ বর্তমান আছে কি না। এই প্রয়োজনের তাগিদেই এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে অনুসন্ধান করা শুরু হয় যার নিকট সুন্নাতের কোন জ্ঞান ছিল। আর যার নিকটই এই জ্ঞান বর্তমান ছিল তিনি তা অন্যদের নিকট পৌছে দেয়া স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করতেন। এটাই হাদীস রিওয়ায়াতের সূচনা বিন্দু এবং ১১ হিজরী থেকে ৩য়-৪র্থ হিজরী শতক পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা এই সুন্নত একত্রিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। জাল হাদীস প্রণয়নকারীরা তার সাথে সংমিশ্রণ ঘটানোর যত অপচেষ্টাই করেছে তা প্রায় সম্পূর্ণই ব্যর্থ করে দেয়া হয়। কারণ যেসব সুন্নাতের মাধ্যমে কোন জিনিস প্রমাণিত অথবা পরিত্যক্ত হত, যার ভিত্তিতে কোন জিনিস হারাম অথবা হালাল সাব্যস্ত হত, যারভিত্তিতে কোন ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করত অথবাকোন অপরাধী মুক্তি পেত, মোটকথা যেসব সুন্নাতের উপর আইন-কানুনের ভিত্তি ছিল সেগুলো সম্পর্কে সরকার, বিচার বিভাগ এবং ফতোয়া বিভাগের এতটা বেপরোয়া হওয়ার প্রশ্নই উঠে না যে, হঠাৎ দাঁড়িয়েই কোন ব্যক্তি “কালান-নাবিয়্যু সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম” (নবী স. বলেন) বলে দিত আর একজন বিচারক, প্রশাসক অথবা মুফতী তা মেনে নিয়ে কোন হুকুম দিয়ে বসতেন। এজন্য যেসব সুন্নাত আইন-কানূনের সাথে সম্পর্কিত ছিল সেগুলো সম্পর্কে পূর্ণরূপে অনুসন্ধান চালানো হয়। সমালোচনার কঠোর চালুনি দ্বারা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। রিওয়ায়াতের মূলনীতির আলোকেও তা পরখ করা হয় এবং দিরায়াত (বুদ্ধি-বিবেচনা)-এর মূলনীতির আলোকেও। আর যেসব মূলনীতির ভিত্তিতে কোন রিওয়ায়াত গ্রহন অথবা বর্জন করা হয়েছে সেগুলোও সংকলিত করে রাখা হয়েছে, যাতে পারবর্তী কালেও প্রতিটি ব্যক্তি তা গ্রহণ বা বর্জন সম্পর্কে অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে সক্ষম হয়”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ.পৃ. ১৬৮-১৬৯)
এই উত্তর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করার পর এবার বলুন, আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আপনি পেয়েছেন কি না? হয়ত আপনি প্রতিউত্তরে বলতে পারেনঃআপনি “কুরআনের অনুরূপ একটি পূর্ণাংগ গ্রন্থের” নামই তো উল্লেখ করতে পারেননি, যার মধ্যে“রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত সুবিন্যস্তভাবে সংকলিত আছে। কিন্তু আমি বলব, আমার এই উত্তরের উপর এইরূপ আপত্তি একটি স্থুল বিতর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি একজন শিক্ষিত বুদ্ধিমান ব্যক্তি। আপনি কি এতটুকু কথাও বুঝতে পারেন না যে, একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের গোটা ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র একটি সুবিন্যস্ত আইনের গ্রন্থের উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয় না। বরং এই আইন গ্রন্থের সাথে সাধারণ প্রথা (Convention),ঐতিহ্য (tradition),নজির বা পূর্বদৃষ্টfন্ত (precedent), বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, ব্যবস্থাপনা আইন, নৈতিক নির্দেশনা ইত্যাদির একটি দীর্ঘ ধারাক্রমও থাকে যা আইন গ্রন্থের ভিত্তিতে কার্যত একটি জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার ফল। এই জিনিস একটি জাতির জীবন ব্যবস্থার প্রাণসত্তা যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবলমাত্র না আইন গ্রন্থ তার জীবন ব্যবস্থার পূর্ণ চিত্র পেশ করতে পারে, আর না তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে। আর এই জিনিস পৃথিবীর কোথাও কোন একটি গ্রন্থে সুবিন্যস্ত আকারে লিপিবদ্ধ থাকে না, থাকতেও পারে না। আর এই ধরনের একটি গ্রন্থে অভাব থাকার অর্থ এই নয় যে,এই জাতির নিকট উক্ত আইন গ্রন্থ ব্যতীত কোন রীতিনীতি বা আইন-কানূন বর্তমান নাই। আপনি ইংল্যান্ড, আমেরিকা অথবা দুনিয়ার অপর কোন জাতির সামনে একথা বলে দেখুন যে, তোমাদের নিকট তোমাদের রচিত আইন (Condified Law) ব্যতীত যা কিছুই আছে তা সবই অনির্ভরযোগ্য এবং তোমাদের সমস্ত প্রথা-ঐতিহ্য প্রভৃতি হয় একটি গ্রন্থের আকারে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে অন্যথায় সেগুলোকে আইনগত দিক থেকে সম্পূর্ন অনির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করতে হবে। অতপর আপনি নিজেই জানতে পারবেন, আপনার এই কথা কতটা গুরুত্ব পাওয়ার অধিকারী হয়।
নবী যুগের প্রচলিত প্রথা, ঐতিহ্য,নজির, সিদ্ধান্তসমূহ, আইন-কানূন ও নির্দেশাবলীর পূর্ণ রেকর্ড একটি গ্রন্থের আকারে সুবিন্যস্ত পাওয়া উচিত ছিল কেউ যদি এরূপ দাবী করে, তাহলে তা মূলত একটি নিরেট অবাস্তব চিন্তা এবং এমন ব্যক্তিই এরূপ দাবী করতে পারে, যে কল্পনার জগতে বাস করে। আপনি প্রাচীন কালের আরবদের অবস্থা বাদ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য আজ এই যুগের অবস্থার কথা চিন্তা করুন, যখন ঘটনাবলী ও অবস্থা রেকর্ড করার উপায়-উপকরণসমূহের অস্বাভাবিক রকম উন্নতি হয়েছে। মনে করুন এই যুগে এমন কোন নেতা আছেন যিনি ২৩ বছর পর্যন্ত রাতদিনের ব্যস্ত জীবনে এক মহান বিপ্লব সংগঠিত করেন। হাজার হাজার লোককে শিক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজের উদ্দীষ্ট বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করেন, তাদের কাজে লাগিয়ে গোটা দেশের চিন্তাগত, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বিপ্লব সাধন করেন, নিজের নেতৃত্ব ও পরিচালনার মাধ্যমে একটি নতুন সমাজ এবং একটি নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। এই সমাজে তার ব্যক্তিত্ব প্রতিটি মুহূর্তে হেদায়াতের একটি স্থায়ী নমুনা হিসাবে বিরাজ করে। সর্বাবস্থায় লোকেরা তাকে দেখে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে যে, কি করা উচিত আর কি করা উচিৎ নয়। সর্বস্তরের লোক রাতদিন তার সাথে মিলিত হতে থাকে এবং তিনি তাদেরকে আকীদা-বিশ্বাস,চিন্তাধারা, চরিত্র নৈতিকতা, ইবাদত বন্দেগী, লেনদেন,আচার-ব্যবহার মোটকথা জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে মৌলিক দিকনির্দেশও দিয়ে থাকেন এবং আনুষংগিক ব্যাপারেও। তাছাড়া রাষ্ট্রের পরিচালক, বিচারক, আইন প্রণেতা, পরিকল্পনাকারী এবং সেনানায়কও তিনি হয়ে থাকেন এবং দশ বছর পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের বিভাগসমূহকে তিনি নিজের মৌলনীতির উপর স্থাপন করেন এবং তার ভিত্তিতে নিজে তা পরিচালনা করেন। আপনি কি মনে করেন, আজ এই যুগেও এই সমস্ত কাজ কোন একটি দেশে সম্পাদিত হলে তার সমস্ত রেকর্ড “একটি গ্রন্থে” আকারে সংকলিত হতে পারে? সব সময় কি এই নেতার সাথে টেপ রেকর্ডার লাগিয়ে রাখা সম্ভব? প্রতিটি মূহুর্তে কি তার দিনরাতের প্রতিটি গতিবিধি সংরক্ষণের জন্য তার পেছনে ক্যামেরা লাগিয়ে রাখা সম্ভব? যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে এই নেতা লাখলাখ লোকের জীবনের উপর, গোটা সমাজের চেহারায় এবং রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার উপর যে ছাপ রেখে গেছেন তা কি কোন সাক্ষ্যই নয় যার উপর নির্ভর করা যেতে পারে? আপনি কি এই দাবী করবেন যে, এই নেতার ভাষণসমূহ শ্রবণকারী, তাঁর জীবনাচার অবলোকনকারী এবং তার সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী অসংখ্য লোকের প্রদত্ত রিপোর্ট সম্পূর্ণই অনির্ভরযোগ্য, কারণ স্বয়ং ঐ নেতার সামনে তা “একটি গ্রন্থাগারে” লিপিবদ্ধ করা হয়নি এবং তিনি তার সত্যায়ন করেননি? আপনি কি বলবেন যে,তার বিচার বিভাগীয় ফয়সালা, তারা ব্যবস্থাপনা, আইন, তার আইনগত ফরমানসমূহ এবং যুদ্ধ ও সন্ধি সংক্রান্ত যত তথ্য বিভিন্ন উৎসে ও বিভিন্ন আকারে বর্তমান আছে তার কোন মূল্য ও মর্যাদাই নেই, কারণ তা তো একটি “পূর্ণাংগ গ্রন্থরূপে” সংকলিত নেই?
এসব বিষয়ের উপর যদি বিতর্কের উদ্দেশ্যে নয় বরং বক্তব্য অনুধাবনের উদ্দেশ্যে চিন্তাভাবনা করা হয় তবে একজন বুদ্ধিবিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি স্বয়ং অনুধাবন করতে পারবে যে, “একটি গ্রন্থের” এই দাবী কতটা অর্থহীন। এই ধরনের কথা একটি বদ্ধ কক্ষে বসে কতিপয় অর্ধ-শিক্ষিত ও প্রতারিত অনুসারীদের সামনে বলাবলি করলে কিছু যায় আসে না, কিন্তু উন্মুক্ত ময়দানে শিক্ষিত মানুষের সামনে তা চ্যালেঞ্জ হিসাবে পেশ করা বড়ই দুঃসাহসের ব্যাপার।
সুন্নাত কি সর্বস্বীকৃত এবং তার যথার্থতা পরীক্ষার উপায় কি?
আপনার তৃতীয় প্রশ্ন ছিলঃ “রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের সেই গ্রন্থখানির মূলপাঠ কি সব মুসলমানের নিকট কুরআন মজীদের মূল পাঠের মতো সর্বস্বীকৃত এবং সংশয়-সন্দেহ ও সমালোচনার উর্ধে?”
এবং চতুর্থ প্রশ্নঃ “যদি এরূপ কোন গ্রন্থ বর্তমান না থাকে তবে যে ভাবে সহজেই জানা যায় যে, এই বাক্য বা বাক্যাংশটুকু কুরআন মজীদের আয়াত, অনুরূপভাবে এটা কিভাবে জানা যাবে যে, অমুক কথা রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত কি না?
উল্লেখিত প্রশ্নদ্বয়ের উত্তরের জন্য আমি যেসব প্রবন্ধের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম, যদি আপনি তা পাঠ করে থাকেন তবে সেখানে আপনি নিম্নোক্ত বক্তব্য অবশ্যই দেখে থাকবেনঃ
“নিসন্দেহে সুন্নাত সম্পর্ক তথ্যানুসন্ধান এবং তা নির্ণয় করতে গিয়ে মতবিরোধ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে। কিন্তু এই ধরনের মতবিরোধ কুরআন মজীদের অনেক হুকুম-আহকাম ও বক্তব্যের অর্থ নির্ণয় করতে গিয়েও হয়েছে এবং হতে পারে। এ ধরনের মতবিরোধ যদি কুরআন মজীদ পরিত্যাগ করার অনুকূলে প্রমাণ না হতে পারে, তবে কী করে সুন্নাত পরিত্যাগ করার পক্ষে তাকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে? এই মুলনীতি পূর্বেও স্বীকার করা হত এবং আজও স্বীকার করাছাড়া উপায় নাই যে, যে ব্যক্তিই কোন নির্দেশকে কুরআনের অথবা সুন্নাতের নির্দেশ বলে দাবী করবে তাকে অবশ্যি তার বক্তব্যের অনুকূলে প্রমাণ পেশ করতে হবে। তার বক্তব্য যথার্থ হয়ে থাকলে উম্মাতের বিশেষজ্ঞ আলেমগণের অথবা অন্তত তাদের কোন বৃহৎ অংশের দ্বারা তা সীলমোহর করাতে হবে। আর যে কথা দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতেই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের কোটি কোটি মুসলমান কোন একটি ফিকহী মাযহাবে দলবদ্ধ হয়েছে এবং তাদের বৃহৎ বৃহৎ জনপদ কুরআনিক নির্দেশের কোন ব্যাখ্যা এবং প্রতিষ্ঠিত সুন্নাতের কোন সংকলনের উপর নিজেদের সামগ্রিক জীবনের ব্যবস্থা কায়েম করেছে-(তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ., পৃ.২১৯)।
“মতবিরোধপূর্ণ সুন্নাত যদি স্বয়ং কোন উৎস ও প্রাধিকার (Authority) না হতে পারে, বরং যা কিছু মতবিরোধ হয়েছে তা এই বিষয়ে যে, কোন বিশেষ ব্যাপার যে জিনিসকে সুন্নাত হওয়ার দাবী করা হয়েছে তা বাস্তবিক প্রামাণ্য সুন্নাত কি না, তবে কুরআন মজীদের আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য নির্ধারণেও এরূপ মতভেদ হয়েছে। প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তি এই বিতর্ক উত্থাপন করতে পারে যে, কোন বিষয়ের যে হুকুম কুরআন মজীদ থেকে নির্গত করা হচ্ছে-তা মূলত কুরআন থেকে নির্গত হয় কি না? সম্মানিত পত্রলেখক স্বয়ং কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মতবিরোধের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এই ধরনের মতভেদের সুযোগ সত্ত্বে তিনি স্বয়ং কুরআনকে আইনের উৎস ও প্রাধিকার হিসাবে মান্য করেন। প্রশ্ন হচ্ছে-অনুরূপভাবে ভিন্ন ভিন্ন মাসআলার ব্যাপারে সুন্নাতের প্রমাণ ও তথ্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মতভেদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বয়ং সুন্নাতকে আইনের উৎস ও প্রাধিকার স্বীকার করতে তাঁর এত সংশয় কেন?
একথা পত্রলেখকের মত একজন আইনজ্ঞের নিকট অজ্ঞাত থাকতে পারেনা যে, কুরআন মজীদের কোন নির্দেশের বিভিন্ন সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যক্তি, সংস্থা অথবা বিচারালয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থা প্রয়োগের পর শেষ পর্যন্ত যে ব্যাখ্যাকে বিধানের আসল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে, তার জ্ঞান ও কার্যসীমার মধ্যে ঐটিই আল্লাহর নির্দেশ। যদিও চূড়ান্তভাবে এই দাবি করা যায় না যে, প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহর নির্দেশ। সম্পূর্ণ এভাবেই সুন্নাতের পর্যালোচনার ইলমী উপায়-উপকরণ প্রয়োগ করে কোন বিষয়ে যে সুন্নাতই কোন ফকীহ অথবা আইন পরিষদ অথবা বিচারালয়ের নিকট প্রমাণিত হবে, তাই তার জন্য রসূলুল্লাহ (স) এর হুকুম,যদিও চূড়ান্তভাবে একথা বলা যায়না যে, প্রকৃতপক্ষে এটাই রসূলুল্লাহ (স) এর নির্দেশ। এই উভয় অবস্থায় বিষয়টি যদিও বিতর্কিত থেকে যায় যে, আমার নিকট আল্লাহ তাআলা অথবা তাঁর রসূল (স)-এর নির্দেশ কি এবং আপনার নিকট কি, কিন্তু তথাপি আপনি এবং আমি যতখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল (স) কে চুড়ান্ত কর্তৃপক্ষ (Final Authority) মেনে নিচ্ছি তখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল (স)-এর নির্দেশ আমাদের জন্য আইনবিধান কি না এবং সেগুলো অবশ্য পালনীয় কিনা তা আমাদের নিকট বিতর্কিত বিষয় হতে পারে না” -(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ., পৃ.১৬২)।
“সুন্নাতের উল্লেখযোগ্য অংশের ব্যাপারে ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একটি অংশে মতভেদ আছে। কতিপয় লোক কোন জিনিসকে সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং কতেকে তা সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু এই ধরনের সব মতবিরোধী সম্পর্কে শত শত বছর ধরে বিশেজ্ঞ আলেমগণের মধ্যে আলোচনার ধারা অব্যাহত আছে এবং অতিশয় বিস্তারিতভাবে প্রতিটি দৃষ্টিকোণের সপক্ষে প্রদত্ত যুক্তি-প্রমাণ এবং যে মৌলিক উপাদানের উপর এই যুক্তির ভিত্তি রাখা হয়েছে তা সবই ফিকহ ও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে বর্তমান আছে। কোন জিনিসের সুন্নাত হওয়া বা না হওয়া সম্পর্কে নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে পৌছে আজ কোন শিক্ষিত লোকের জন্য কষ্টকর নয়। তাই আমার বুঝে আসে না যে, সুন্নতের নামে কারো শংকিত হওয়ার কি যুক্তিসংগত কারণ থাকতে পারে? অবশ্য যারা জ্ঞানবিজ্ঞানের এই শাখা সম্পর্কে অবহিত নয় এবং যারা দূর থেকে হাদীসের মধ্যে মতবিরোধের কথা শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে তাদের কথা স্বতন্ত্র”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ.পৃ.১৬৯)।
আমি আপনার উপরোক্ত প্রশ্নদ্বয়ের জবাবে এই আলোচনা অধ্যয়নের পরামর্শ এই আশায় দিয়েছি যেন, একজন শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তি যিনি বক্তব্য অনুধাবনের আকাংখী, তা অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজের প্রশ্নাবলীতে নিহিত মৌলিক ভ্রান্তিসমূহ অনুধাবনে সক্ষম হন এবং তিনি সরাসরি বুঝতে পারেন যে, সুন্নাতের পর্যালোচনায় মতপার্থক্য সুন্নাতকে আইনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, যেমন কুরআন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সৃষ্ট মতভেদ কুরআনকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। কিন্তু আপনি না এই ভ্রান্তি অনুভব করেছেন, আর না বক্তব্য হৃদয়ংগম করার চেষ্টা করেছেন, বরং উল্টোদিকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন নিক্ষেপ করেছেন। আমি আপনার উত্থাপিত এসব প্রশ্নের উপর তো পরে আপত্তি তুলব, প্রথমে আপনি পরিষ্কার বলুন যে, আপনার মতে যদি শুধুমাত্র মতভেদমুক্ত জিনিসই আইনের উৎস হতে পারে তবে এই আসমানের নীচে পৃথিবীতে এমন কি জিনিস আছে যা মানব জীবনের বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে এবং তাতে মানবীয় জ্ঞান মতভেদের কোন সুযোগ পায় না? আপনি কুরআন মজীদ সম্পর্কে এর অতিরিক্ত দাবী করতে পারেন না যে, তার মূলপাঠ সর্বস্বীকৃত এবং এর কোন আয়াত বা আয়াতাংশ কুরআনের আয়াত হওয়ার ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। কিন্তু আপনি কি একথা অস্বীকার করতে পারেন যে, কুরআনের আয়াতসমূহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবনের এবং তা থেকে বিবিধ নির্দেশ নির্গত করার ক্ষেত্রে প্রচুর মতবিরোধ হতে পারে এবং হয়েছেও? যদি কোন আইনের আসল উদ্দেশ্য শব্দাবলীর মূলপাঠ বর্ণনা না হয়ে বরং বিধান বর্ণনা হয়ে থাকে তবে এই উদ্দেশ্যের বিচারে শব্দাবলীর (মূল পাঠ) ক্ষেত্রে ঐক্যমতে কি লাভ, যখন বিধান নির্ণয় করতে গিয়ে মতবিরোধ হয়ে যায় এবং সর্বদা হতে পারে? এজন্য হয় আপনাকে আপনার এই দৃষ্টিভংগির পরিবর্তন করতে হবে যে, “আইনের ভিত্তি কেবল এমন জিনিসই হতে পারে যার মধ্যে মতবিরোধের সুযোগ নাই” অথবা কুরআনকে আইনের উৎস হিসাবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে হবে। মূলত এই শর্ত সহকারে পৃথিবীতে কোন আইনই তো রচিত হতে পারে না। যেসব দেশের মোটেই কোন লিখিত সংবিধান (Written constitution) নাই (যেমন ব্রিটেন) তাদের সার্বিক ব্যবস্থার কি অবস্থা হতে পারে? বরং যাদের নিকট একটি লিখিত সংবিধান আছে তাদের মধ্যেও আইনের মূল পাঠেই কেবল মতৈক্য আছে, কিন্তু তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও যদি মতৈক্য থেকে থাকে তবে অনুগ্রহপূর্বক তা দেখিয়ে দিন।