সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা

চারটি মৌলিক সত্য

তাছাড়া আমার উল্লেখিত বক্তব্যে আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে যার প্রতি আপনি দৃষ্টিপাত না করে আসল সমস্যা থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য ভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে পশ্চাদাপসরণ করতে দেব না, যতক্ষণ না আপনি এসব বিষয় সম্পর্কে কোন পরিষ্কার বক্তব্য পেশ করছেন। হয় আপনি তা সহজভাবে স্বীকার করে নেবেন এবং নিজের অবস্থান পরিবর্তন করবেন, অথবা শুধুমাত্র দাবীর ভিত্তিতে নয়, বরং যুক্তিসংগত দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে তা প্রথ্যাখ্যান করুন। সেই বিষয়গুলো হচ্ছেঃ

১. “সুন্নাতের বিরাট ও ব্যাপক অংশের উপর উম্মাতের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌলিক ছাঁচ যেসব সুন্নাতের মাধ্যমে গঠিত হয় তার প্রায় সবগুলোতেই মতৈক্য রয়েছে। তাছাড়া যেসব সুন্নাতের উপর শরীআতের মূলনীতির ভিত্তি স্থাপিত সেসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতৈক্য বিদ্যমান। যেসব সুন্নাত থেকে আনুষংগিক বিধান নির্গত হয়েছে, অধিকাংশ মতভেদ কেবল সেই সুন্নতগুলোকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। তারও সবগুলো মতবিরোধপূর্ণ নয়, বরং তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উপর উম্মাতের আলেমগণের মতৈক্য লক্ষ্য করা যায়। “মতভেদযুক্ত মাসআলাগুলোই বেশীর মঞ্চে উত্থাপনকরা হয়েছে” এই কথা ‘সুন্নাত সম্পূর্ণতই বিতর্কিত’ এরূপ সিদ্ধান্তে পৌছার জন্য যথেষ্ট নয়। অনুরূপভাবে কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উন্মাদ ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞ লোকের দলের কখনও কোথাও আত্মপ্রকাশ করে সর্বস্বীকৃত জিনিসকেও বিরোধপূর্ণ বানানোর অপচেষ্টা সুন্নাতের বিরাট অংশ সর্বস্বীকৃত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। এধরনের গ্রুপ শুধুমাত্র সুন্নাতের উপর অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাদের মধ্যে কতেক কুরআন মজীদ তাহরীফ (বিকৃত) হওয়ার দাবী পর্যন্ত করেছে। কিন্তু এ ধরনের মুষ্টিমেয় লোকের অস্তিত্ব মুসলিম উম্মাতের সম্মিলিত মতৈক্য বাতিল করতে পারে না। এ ধরনের দুই চার শত বা দুই চার হাজার লোককে শেষ পর্যন্ত এই অনুমতি কেন দেয়া হবে যে, গোটা দেশের জন্য যে আইন রচিত হচ্ছে তার মধ্য থেকে এমন একটি জিনিসকে বাদ দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়াবে যাকে কুরআনের পরে গোটা উম্মাত ইসলামী আইনের দ্বিতীয় ভিত্তি হিসাবে মেনে নিয়েছে এবং সর্বকালে মেনে আসছে?

২. আনুষংগিক বিধানের সাথে সম্পর্কিত যেসব সুন্নাতের ক্ষেত্রে মতবিরোধ আছে তার ধরনও এরূপ নয় যে, তাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে দ্বিমত পোষণ করে, বরং “পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে কোটি কোটি মুসলমান কোন একটি ফিকহ-ভিত্তিক মাযহাবের অধীনে সংঘবদ্ধ হয়ে গেছে এবং তাদের বৃহৎ বৃহৎ জনপদ কুরআনী বিধানের কোন একটি ব্যাখ্যার উপর এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নাতের কোন একটি সংকলনের উপর নিজেরদের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা স্থাপন করেছে।” উদাহরণস্বরূপ আপনি আপনার নিজের দেশ পাকিস্তানের দিকে তাকান যার আইন প্রণয়নের বিষয়টি আলোচনাধীন। আইনগত দিক থেকে এ দেশের গোটা মুসলিম জনবসতি মাত্র তিনটি বৃহৎ সম্প্রদায়ে বিভক্তঃহানাফী, শীআ ও আহলে হাদীস। এদের মধ্যে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকেরা কুরআনিক বিধানের একটি ব্যাখ্যা এবং প্রমাণ্য সুন্নাতের একটি সংগ্রহ গ্রহণ করে নিয়েছে। আমরা কি গণতান্ত্রিক মূলনীতির ভিত্তিতে আইনের বিষয়টির এভাবে সমাধান করতে পারি না যে, ব্যক্তিগত আইনের সীমা পর্যন্ত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য তাদের কুরআনিক ব্যাখ্যা ও প্রামান্য সুন্নাতের সংকলন নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে, যা তারা অনুসরণ করছে, আর জাতীয় আইন-এর ক্ষেত্রে কুরআনের যে ব্যাখ্যা ও সুন্নাতের যে সংগ্রহের উপর অধিকাংশের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে?

৩. “এটা কি করে জানা যাবে যে, অমুক কথা রসূলুল্লাহ (স)-এর হাদীস নি না”-এই প্রশ্ন সমাধানের অযোগ্য কোন প্রশ্ন নয়। যেসব সুন্নাত সম্পর্কে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে যে, তা প্রামাণ্য কি না-“সেগুলোকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে এবং যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে প্রতিটি দৃষ্টিকোণের সপক্ষে প্রদত্ত যুক্তিপ্রমাণ এবং যার উপর এসব যুক্তির ভিত্তি রাখা হয়েছে তা সবই ফিকহ ও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে মওজুদ আছে। কোন জিনিসের সুন্নাত হওয়া বা না হওয়া সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে পৌছা আজ আর কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির জন্যেই কষ্টকর ব্যাপার নয়।

৪.অতপর আইন-বিধানের উদ্দেশ্যে এই বিষয়ের চূড়ান্ত সমাধান হচ্ছে:“কুরআন মজীদের বিভিন্ন সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যক্তি,সংস্থা অথবা বিাচারালয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুপ্রসিদ্ধ ইলমী ও যৌক্তিক পন্থা প্রয়োগপূর্বক অবশেষে যে ব্যাখ্যাকে বিধানের আসল উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করে,তার জ্ঞান ও কার্যসীমার মধ্যে ঐটিই আল্লাহর নির্দেশ। যদিও চুড়ান্তভাবে এই দাবী করা যায় না যে, বাস্তবেও এটাই আল্লাহর নির্দেশ। সম্পূর্ণত এভাবেই সুন্নাত পর্যালোচনার বুদ্ধিবৃত্তিক উপায় উপকরণ ব্যবহার করে কোন বিষয়ে যে সুন্নাতই কোন ফকীহ অথবা আইন পরিষদ অথবা বিচারালয়ের নিকট প্রমাণিত হবে তা তার জন্য রসূলুল্লাহ (স)-এর হুকুম,যদিও চূড়ান্তভাবে একথা বলা যায় না যে, এটাই রসূলুল্লাহ (স)-এর নির্দেশ।

এখন আপনি নিজেই ঈমানদারীর সাথে নিজের বিবেকর নিকট জিজ্ঞাসা করুন, আমার উধৃত বাক্যসমূহে আপনার সামনে যেসব বিষয় এসে গেছে তার মধ্যে আপনি আপনার তৃতীয় ও চতুর্থ প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন কি না? এর সম্মুখীন হয়ে এ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে একটি ইতবাচক অথবা নেতিবাচক বক্তব্য পেশ করার পরিবর্তে আপনি আরও প্রশ্নবাণ নিক্ষেপের যে চেষ্টা করেছেন তার যুক্তিসংগত কারণ কি যার উপর আপনার বিবেক আশ্বস্ত হতে পারে?

দ্বিতীয় পত্রের জওয়াব

এরপর আমি  আপনার দ্বিতীয় চিঠিটি সামনে রাখছি। এই পত্রে আপনি অভিযোগ করেছেন, আপনার প্রথম চিঠির জওয়াব আমি যেসব প্রবন্ধ নির্দেশ করেছিলাম তার মধ্যে আপনি আপনার প্রশ্নাবলীর সুনির্দিষ্ট উত্তর পাননি, বরং আপনার অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু এখন আমি আপনার প্রশ্নাবলী সম্পর্কে যে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করলাম তা পাঠ করে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিন যে, তার মধ্যে আপনি প্রতিটি প্রশ্নের একটি সুনির্দিষ্ট জওয়াব পেয়েছন কি না এবং তাতে আপনার অস্থিরতা বৃদ্ধির আসল কারণ কি উল্লেখিত প্রবন্ধসমূহ না কি আপনার মন-মগজ?

আপনি আরও বলেছেন যে, উল্লেখিত প্রবন্ধে এমন কতগুলো কথা আছে যা আমার অন্যান্য প্রবন্ধের সাথে সাংঘর্ষিক। এর উত্তরে আমি বলতে চাই, অনুগ্রহপূর্বক আমার সেসব প্রবন্ধের বরাত উল্লেখ করুন এবং বলুন যে,তার মধ্যে কোন বিষয়গুলো এই প্রবন্ধের বিপরীত। তবে আমার আশংকা হচ্ছে, আপনি পশ্চাদাপসরণ করার জন্যে আরেকটি প্রশস্ত মাঠ খুঁজেছেন। এজন্য আলোচনার ক্ষেত্রকে আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে কেন্দ্রীভূত রাখার খাতিরে এই জওয়াব দেয়ার পরিবর্তে আমি আবেদন করব, আমার অন্য প্রবন্ধের কথা আপাতত বাদ দিন, এখন আমি আপনার সামনে যেসব কথা পেশ করছি সে সম্পর্কে বলুন যে, তা আপনি কবুল করছেন না প্রত্যাখ্যান করছেন। যদি প্রত্যাখ্যান করেন তবে তার অনুকূলে যুক্তিগ্রাহ্য কি দলীল আপনার নিকট আছে?

চার দফার সারসংক্ষেপ

এরপর আপনি আমাকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, এই পত্রালাপে আপনার উদ্দেশ্যে বিতর্ক নয়, বরং বিষয়টি অনুধাবনই হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য। একথা বলার পর আপনি চার দফা আকারে আমার প্রবন্ধাবলীর নির্যাস নির্গত করে আমার সামনে পেশ করছেন এবং আমার নিকট দাবী করছেন, হয় আমি একথা স্বীকার করে নেব যে, আমার ঐসব প্রবন্ধের নির্যাস তাই, অথবা প্রমাণ করব যে, আপনি এসব প্রবন্ধের তাৎপর্য ভুল বুঝেছেন।

যেসব দফা আপনি নির্যাস আকারে আমার প্রবন্ধ থেকে বের করেছেন সে সম্পর্কে এখনই ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী আলোচনা করব। কিন্তু এই আলোচনার পূর্বে আমি আপনার নিকট আরয করব, আমার প্রবন্ধসমূহ থেকে আমি যেসবপয়েন্ট উপরে পেশ করেছি তার সামনে আপনার গৃহীত এই পয়েন্টগুলো রেখে আপনি নিজেই দেখুন এবং সিদ্ধান্ত নিন যে, যে মনমগজ ঐ পয়েন্টগুলো পরিবর্তে এই পয়েন্টগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে তা কি বক্তব্য হৃদয়ংগম করার আকাংখী না বিতর্কপ্রিয় রোগী?

প্রথম দফা

আপনার বের করা প্রথম দফা হলো: “আপনি বলেছেন, মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা কিছু বলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তাকে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত বলা হয়। এই বক্তব্য থেকে দুটি জিনিস পাওয়া যাচ্ছে:

(ক) রসূলুল্লাহ (স) এই তেইশ বছরের জীবনে ব্যক্তি হিসাবে যেসব কথা বলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তা সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত নয়।

(খ) সুন্নাত হচ্ছে কুরআনের বিধান ও মূলনীতির ব্যাখ্যা। তা কুরআনের অতিরিক্ত দীন ইসলামের কোনো মূলনীতি অথবা বিধান প্রণয়ন করে না এবং সুন্নাত কুরআনের কোন নির্দেশও রহিত করতে পারেনা।”

রসূলুল্লাহ (স)-এর কাজের ধরন

আমার বক্তব্য থেকে আপনি যে নির্যাস বের করেছেন তার প্রথম অংশই ভুল। আমার এসব প্রবন্ধের কোন স্থানে একথা লিখিত আছে যে, “মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা কিছুবলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তাকে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত বলা হয়?” বরং এর বিপরীতে আমি তো বলেছি যে, মহানবী (স)-এর নবূওয়াতী জীবনের সমস্ত কাজ যা তিনি তেইশ বছরে আঞ্জাম দিয়েছেন, কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এই সুন্নাত কুরআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ সত্তার (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা) মহান বিধানের গঠন ও পূর্ণতা প্রদান করে এবং এই সমগ্র কাজ মহানবী (স) যেহেতু নবী হিসাবে করেছেন, তাই তিনি এসব কাজে কুরআন মজীদের মতই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও মর্জির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

আপনি যদি অন্যের বক্তব্যের মধ্যে আপনার নিজের ধারণা পড়তে অভ্যস্থ না হয়ে থাকেন তবে আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাবে আমি যা কিছু বলেছি তা অধ্যয়নপূর্বক দেখে নিন আমি কি বলেছিলাম এবং তাকে কি বানিয়ে দিয়েছেন।

অনন্তর আপনি তা থেকে যে দুটি সিদ্ধান্তে পৌছেছেন তার উভয়টি এই কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আপনি আমার উক্ত বক্তব্যের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের পরিবর্তে একটি নতুন বিতর্কের পথ খুজেছেন। কেননা আপনার প্রথম প্রশ্ন ঐ বক্তব্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল না, আর আমিও আপনাকে আমার পূর্বোক্ত প্রবন্ধের বরাত এজন্য দেইনি যে, আপনি এই সমষ্যার সমাধান তার মধ্যে অনুসন্ধান করবেন। তথাপি আমি আপনাকে একথা বলার সুযোগ দিতে চাই না যে, আমি আপনার নিক্ষিাপ্ত প্র্শ্নাবলীর জবাব দিতে পশ্চাৎপদ হয়েছি। তাই আমি এই দুটি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করছি।

মহানবী (স)-এর ব্যক্তিসত্তা ও নবূওয়াতী সত্তার মধ্যে পার্থক্য

(ক) ইসলামী শরীআতে একথা সম্পূর্ণ স্বীকৃত যে, মহানবী (স) রসূল হিসাবে যেসব কথা বলেছেন এবং যেসব কাজ করেছেন তা সবই সুন্নাত এবং তার অনুসরণ উম্মাতের জন্য বাধ্যতামূলক। আর তিনি ব্যক্তি হিসাবে যেসব কথা বলেছেন অথবা কার্যত যেসব কাজ করেছেন তা অবশ্যি সম্মানার্হ্য, কিন্তু তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব (রহ) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা”-য় “বাব বায়ানি আকসামি উলূমিন-নাবিয়্য (স)” শীর্ষক অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ পূণাংঙ্গ ও অর্থবহ আলোচনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (রহ)  তাঁর “সহীহ” গ্রন্থে একটি পূর্ণ অনুচ্ছেদই এই মূলনীতির আলোচনায় ব্যয় করেছেন এবং তার শিরোনাম দিয়েছে: “বাব ওয়াজিবি ইমতিসালে মা কালাহু শারআন দূনা মা যাকারাহু (স) মিন মাআইশিদ-দুনয়া আলা সাবীলির-রায়” [অনুচ্ছেদ: মহানবী (স) শরীআতের বিধান হিসাবে যা বলেছেন তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক,পার্থিব ব্যাপারে তিনি ব্যক্তিগত অভিমত হিসাবে যা বলেছেন তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়]। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,মহনবী (স)-এর ব্যক্তি সত্তা ও নববী সত্তার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে শেষ পর্যন্ত কে এই সিদ্ধান্ত নিবে যে, তাঁর বক্তব্য ও কার্যবলীর মধ্যে কোন সুন্নাতের অনুসরণ অপরিহার্য এবং কোনগুলি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ের? প্রকাশ থাকে যে, আমরা স্বয়ং এই পার্থক্য ও সীমা নির্দেশ করার অধিকারী নই। এই পার্থক্য দুটি পন্থায়ই হতে পারে। হয় মহানবী (স) স্বয়ং তাঁর কোন কথা বা কাজ সম্পর্কে পরিষ্কার বলে দিয়ে থাকবেন যে, তা ব্যক্তিগত পর্যায়ের। অথবা মহানবী (স) এর প্রদত্ত শিক্ষা থেকে শরীআতের যে মূলনীতি নির্গত হয় তার আলোকে প্রজ্ঞাবান, সৎর্ক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্নই আলেমগণ ব্যাপক বিশ্লেষণ করে দেখবেন যে, তাঁর বক্তব্য ও কার্যবলীর মধ্যে কোন ধরনের কথা ও কাজগুলো তাঁর নবূওয়াতী সত্তার সাতে সম্পর্কযুক্ত আর কোন ধরনের কথা ও কার্যাবলীকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফেলা যায়। এ বিষয়ে আমি আমার একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি যার শিরোনাম হচ্ছে-“রসূলুল্লাহ (স)-এর ব্যক্তিসত্তা ও নবূওয়াতী সত্তা”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৯ খৃ.)।

কুরআনের অতিরিক্ত হওয়া এবং কুরআনের বিরোধী হওয়া সমার্থবোধক নয়

(খ) এটা আপনার সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত যে, সুন্নাত কুরআনিক বিধান ও মূলনীতির ভাষ্যকার এই অর্থে যে, “তা কুরআনের অতিরিক্ত দীন ইসলামের কোনো মূলনীতি অথবা বিধান প্রণয়ন করে না।” আপনি যদি এর পরিবর্তে “কুরআনের পরিপন্থী” শব্দটি ব্যবহার করতেন তবে আমি শুধু ঐক্যমতই পোষণ করতান না, বরং উম্মাতের সকল ফকীহ ও মহাদ্দিসগণও এর সাথে একমত হতেন। কিন্তু আপনি “কুরআনের অতিরিক্ত” শব্দ ব্যবহার করেছেন যার অর্থ কুরআনের অতিরিক্তই হতে পারে। আর একথা পরিষ্কার যে, “অতিরিক্ত” হওয়া এবং “পরিপন্থী বা বিপারীত” হওয়ার মধ্যে আসমান-জমীন পার্থক্য রয়েছে।[প্রকাশ থাকে যে, কোন হাদেীসকে এমন অবস্থায় কুরআনের পরিপন্থী সাব্যস্ত করা যেতে পারে যখন কুরআন এক কাজ করার নির্দেশ দেয়, আর হাদীস তা করতে নিষেধ করে। অথবা কুরআন একটি জিনিস থেকে বিরত থাকতে বলে কিন্তু হাদীস তা করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু হাদীস যদি কুরআনের কোন সংক্ষিপ্ত নির্দেশের ব্যাখ্যা দান করে অথবা তা কার্যকর করার নিয়ম বলে দেয় এবং তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দেয়, তবে তা কুরআনের “পরিপন্থী” নয়, বরং কুরআনের “অতিরিক্ত”।]সুন্নাত যদি কুরআন অীতরিক্ত কোন জিনিস না বলে তাহলে আপনি নিজেই চিন্তা করুন, এর প্রয়োজন কি? এর প্রয়োজন তো এজন্য যে, তা কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রতিভাত করে দেবে যা কুরআনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়নি। যেমন কুরআন মজীদ “নামায কায়েমের”নির্দেশ দিয়েই থেমে যায়। একথা কুরআন বলে না বরং সুন্নাতই বলে দেয় যে,নামাযের অর্থ কি এবং তা কায়েমের অর্থই বা কি। এ উদ্দেশ্য সুন্নাতই মসজিদে নির্মাণ,পাঁচ ওয়াক্ত আযান ও জামাআতের সাথে নামায আদায়ের পন্থা, নামাযের ওয়াক্তসমূহ,নামাযের ধরন, তার রাকআত সংখ্যা,জুমুআ ও দই ঈদের বিশেষ নামায এবং তার বাস্তব রূপ এবং আরও বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আমাদের বলে দেয়। এসব কিছুই কুরআনের অতিরিক্ত, কিন্তু তার পরিপন্থী নয়।

অনুরূপভাবে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে সুন্নাত কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী মানবীয় চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা, ইসলঅমী সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাষ্টীয় যে কাঠামো গঠন করেছে তা কুরআন থেকে এতটা অতিরিক্ত যে, কুরআনিক বিধানের আওতা থেকে সুন্নাতের পথনির্দেশনায় আওতা অনেকটা প্রশস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে কুরআনের পরিপন্থী কিছু নেই, এবং যে জিনিসই বাস্তবিকপক্ষে কুরআনের পরিপন্থী হবে তাকে উম্মাতের ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের কেউ রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত বলে স্বীকার করেন না।

সুন্নাত কি কুরআন মজীদের কোন হুকুম রহিত (মানসূখ) করতে পারে?

এ প্রসংগে আপনি আরও একটি সিদ্ধন্তে উপনীত হয়েছেন যে,“সুন্নাত কুরআন মজিদের কোন হুকুম রহিত করতে পারে না।” একথা আপনি একটা ভুলের শিকার হয়ে লিখেছেন যা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। হানাফী মাযহাবের ফিকহবিধগণ যে জিনিসকে “সুন্নাতের সাহায্য কিতাবের হুকুম রহিতকরণ” পরিভাষার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন তার অর্থ মূলত কুরআন মজীদের কোন সাধারণ হুকুমকে সীমাবদ্ধ করা এবং তার এমন উদ্দেশ্য বর্ণনা করা যা তার ভাষা থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন, সূরা বাকারায় পিতামাতা ও নিকটত্মীয়ের জন্য ওসীয়াত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল (আয়াত নম্বর ১৮০)। তাছাড়া সূরা নিসায় উত্তরাধিকার (সম্পত্তি) বন্টনের হুকুম নাযিল হল এবং বলা হল যে, এই অংশ মৃত ব্যক্তির ওসীয়াত পূর্ণ করার পর বন্টন করা হবে (আয়াত নম্বর ১১-১২৩)। এর ব্যাখ্যায় মহানবী (স), বলেন (ওয়ারিশদের জন্য ওসীয়াত করা যাবে না)। অর্থাৎ এখন ওসীয়াতের মাধ্যমে কোন ওয়ারিশের অংশে হ্রাসবৃদ্ধি করা যাবে না। কারণ কুরআন মজীদে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ওয়ারিসদের অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এসব অংশের মাধ্যে যদি কোন ব্যক্তি অসীয়াতের মাধ্যমে হ্রাসবৃদ্ধি করে তবে সে কুরআনের বিরোধিতা করল।

সুন্নাত এভাবে ওসীয়াতের সাধারণ অনুমতিকে, যা করআনের আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, এমন হকদারের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যারা ওয়ারিশ হতে পারে না। একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, আইনগতভাবে ওয়ারিশদের জন্য যে অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটানোর উদ্দেশ্যে ওসীয়াতের এই সাধারণ অনুমতির সুযোগ গ্রহণ করা যাবে না।

অনুরূপভাবে কুরআন মজীদের উযু সম্পর্কিত আয়াতে (সূরা মাইদা:৬) পা ধৌত করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং সেখানে কোন অবস্থাকে ব্যতিক্রম করা হয়নি। মহানবী (স) মোজার উপর মাসেহ করে এবং অন্যদের তদ্রুপ করার অনুমতি প্রদান করে ব্যাখ্যা দান করেন যে, এই হুকুম মোজা বিহীন পায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মোজা পরিহিত অবস্থায় পা ধৌত করার পরিবর্তে মাসেহ করলেই এই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়। এই জিনিসকে চাই ‘রহিতকরণ’ বলা হোক, অথবা ‘ব্যতিক্রমকরণ’ বলা হোক, কিংবা বলা হোক ‘ব্যাখ্যাকরণ’-এর অর্থ তাই এবং এটা সস্থানে সম্পূর্ণ সঠিক ও যুক্তিগ্রাহ্য জিনিস। এর উপর আপত্তি তোলার শেষ পর্যন্ত কি অধিকার সেইসব লোকের রয়েছে যারা নবী না হওয়া সত্বেও কুরআন মজীদের কোন কোন সুস্পষ্ট নির্দেশকে শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভংগির ভিত্তিতে “মধ্যবর্তী কালের বিধান” সাব্যস্ত  করেন-যার পরিষ্কার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ‘এই মধ্যবর্তী কাল’ যখন তাদের অশুভ মতানুযায়ী অতিক্রান্ত হয়ে যাবে কখন কুরআন মজীদের ঐসব বিধানও রহিত হয়ে যাবে।[জনাব পারভেয সাহেব কুরআন মজীদের উত্তরাধিার সংক্রান্ত বিধানসহ সাব্যস্ত মালিকানার বৈধতা প্রমাণকারী সমস্ত বিধানকে মধ্যবর্তী কালের বিধান সাব্যস্ত করেন। তার মতে কুরআনে হাকীমের এ সমস্ত বিধান তখনই রহিত হয়ে যাবে যখন পারভেয সাহেবের সকপোলকল্পিত “নিযামে রবূবিয়াত”  (খোদায়ী ব্যবস্থা) কায়েম হয়ে যাবে।]

দ্বিতীয় দফা

দ্বিতীয় যে বিষয়টি আপনি আমার প্রবন্ধ থেকে নির্গত করেছেন তা হলো: আপনি বলেছেন যে, “এমন কোন কিতাব নেই যার মধ্যে মহানবী (স)-এর সুন্নাত সম্পূর্ন ও পূর্ণাংগভাবে সংকলিত আছে এবং যার মূল পাঠ সম্পর্কে কুরআনের মূল পাঠের মত সমস্ত মুসলমান একমত।”

আমার প্রবন্ধ থেকে আপনি এই যে নির্যাস বের করেছেন এ সম্পর্কে আমি কেবল এতটুকুই আরয করব যে, নিজের কল্পনায় ডুবে থাকা ব্যক্তিরা এবং যুক্তিসংগত কথা হৃদয়ংগম করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী ব্যক্তিরা অন্যদের বক্তব্য থেকে এ ধরনের নির্যাস বের করতে অভ্যস্ত। এই কিছুক্ষণ পূর্বে আপনার এক নম্বর চিঠির উপর আলোচনাকালে দুই নম্বর প্রশ্নের উত্তরে যা কিছু লিখেছি তা পুনরায় পড়ে নিন। আপনি নিজেই জানতে পারবেন যে, আমি কি বলেছি আর আপনি তার কি নির্যাস বের করেছেন?

তৃতীয় দফা

আপনার গৃহীত তৃতীয় দফায় “আপনি বলেছেন, হাদীসের বর্তমান ভান্ডার থেকে সহীহ হাদীস পৃথক করা যেতে পারে। এজন্য রিওয়ায়াতের পরীক্ষা নিরীক্ষার যে নীতিমালা পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট আছে তা শেষ কথা নয়। রিওয়ায়াতের মূলনীতি ছাড়া দিরায়াতের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে। যেসব লোকের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টির সৃষ্টি হয়েছে, তাদের দিরায়াতই নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে।”

হাদীসসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে রিওয়ায়াত ও দিরায়ারেত প্রয়োগ

আপনি যে বাক্যগুলোর এই আশ্চর্যজনক ও চরমভাবে বিকৃত নির্গত করেছেন-আমি সেই বাক্যগুলো এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি, যাতে আমার বক্তব্যের অবিকল চিত্র সামনে আসতে পারে এবং মনগড়া নির্যাসের প্রয়োজন না থাকে।

“হাদীস শাস্ত্র   এই  সমালোচনারই (অর্থাৎ ঐতিহাসিক সমালোচনার) অপর নাম। ১ম হিজরী শতক থেকে আজ পর্যন্ত এই শাস্ত্রের এই সমালোচনার ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং কোনো ফকীহ অথবা মুহাদ্দিস এই কথার প্রবক্তা ছিলেন না যে, ইবাদত সংক্রান্ত হোক অথবা আচার-ব্যবহার ও লেনদেন সংক্রান্তই হোক-যে কোন বিষয় সম্পর্কিত রসূলুল্লাহ (স)-এর সাথে সংযুক্তকারী কোন হাদীস ঐতিহাসিক সমালোচনা ব্যতিরেকেই প্রমাণ   হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হবে। এই শাস্ত্র বাস্তবিকপক্ষে  উপরোক্ত সমালোচনার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত এবং আধুনিক যুগের উত্তম থেকে সর্বোত্তম ঐতিহাসিক সমালোচনাকেও অতি কষ্টে উপরোক্ত সমালোচনার যোগফল অথবা বিকশিত রূপ (Improvement) বলা যেতে পারে। বরং আমি বলতে পারি যে, হাদীসবেত্তাগণের সমালোচনার নীতিমালার মধ্যে এমন মাধুর্য ও সূক্ষ্মতা রয়েছে-যে পর্যন্ত বর্তমান কালের ইতিহাস সমালোচকগণের বুদ্ধিমত্তা এখনো পৌছতে সক্ষম হয়নি। এর চেয়েও সামনে অগ্রসর হয়ে আমি প্রতিবাদের আশংকা ছাড়াই বলব যে, পৃথিবীতে কেবলমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহে ওয়া সাল্লামের সুন্নাত ও জীবনাচার এবং তার যুগের ইতহাসের রেকর্ডই এমন যা মুহাদ্দিসগণের গৃহীত এই কড়া সমালোচনার মানদন্ডের পরীক্ষা সহ্য করতে পারত। অন্যথায় আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন মানুষ এবং কোন যুগের ইতহাসও সমালোচনার এরুপ কঠোর মানদন্ডের সামনে নিরাপদে টিকে থাকতে পারেনি এবং তা নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক রেকর্ড হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। তথাপি আমি একথা বলব যে, আরও অধিক সংশোধন ও উন্নতির পথ রুদ্ধ নয়। কোন ব্যক্তি এই দাবী করতে পারে না যে, রিওয়ায়াত যাচাই করার যেসব মূলনীতি মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেছেন তাই চুড়ান্ত। আজ যদি কোন ব্যক্তি নিজের মধ্যে এসব মূলনীতি সম্পকের্  গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জন করার পর তার মধ্যে কোন স্থবিরতা ও ক্রটি নির্দেশ করেন এবং অধিক সন্তোষজনক সমালোচনার জন্য কিছু মূলনীতি যুক্তিসংগত দলীল-প্রমাণসহ পেশ করেন তবে অবশ্যি তাকে স্বাগত জানানো হবে।  শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কে না চাইবে যে,কোন জিনিসকে রসূলুল্লাহ (স) এার সুন্নাত সাব্যস্ত করার পূর্বে তা প্রমাণিত সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করতে হবে এবং কোন কাঁচাপাকা কথা যেন মহানবী (স)-এর সাথে সম্পর্কিত হতে না পারে।

হাদীসসমূহের যাচই-বাছাই করার ক্ষেত্রে রিওয়ায়াতের সাথে দিরায়াতের ব্যবহারও একটি সর্বসমর্থিত জিনিস যার উল্লেখ সম্মানিত পত্রলেখক করেছেন ……. অবশ্য এই প্রসংগে যে কথাটি সামনে রাখা উচিত এবং আমি আশা করি যে, মুহতারাম পত্রলেখকও ভিন্নমত পোষণ করবেন না, তা এই যে, কেবলমাত্র এমন লোকদের দিরায়াত গ্রহণযোগ্য হবে যারা কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ফিকহের অধ্যয়ন ও চর্চায় নিজেদের জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কালের অধ্যবসায় ও অনুশীলনে এক বিশেষ পর্যায়ের অভিজ্ঞাতা ও প্রজ্ঞার সৃষ্টি হয়েছে এবং যাদের জ্ঞানবুদ্ধি ইসলামী চিন্তা ও কর্ম ব্যবস্থার চৌহদ্দির বাইরের মতবাদ,মূলনীতি ও মূলবোধ গ্রহণ করে ইসলামী ঐতিহ্যকে ঐগুলোর মানদন্ডে পরখ করার ঝোঁক প্রবণতা নেই। নিসন্দেহে আমরা না বুদ্ধিজ্ঞানের ব্যবহারের উপর কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারি, আর না কারো জিভ টেনে ধরতে পারি। কিন্তু যাই হোক এটা নিশ্চিত ব্যাপার যে, ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা আনাড়ির মত  কোন হাদীসকে মনোপূত পেয়ে গ্রহণ এবং কোন হাদীসকে নিজের মর্জি-বিরদ্ধ পেয়ে প্রত্যাখ্যান করতে থাকে অথবা ইসলামী-বিরোধী কোন চিন্তা ও কর্মব্যবস্থার মধ্যে প্রতিপালিত ব্যক্তিরা হঠাত উত্থিত হয়ে বিজাতীয় মানদন্ডের আলোকে হাদীসসমূহের গ্রহণ-বর্জনের পসরা বসায় তবে মুসলিম উম্মাহর নিকট তাদের দিরায়াত না গ্রনণযোগ্য হতে পারে আর না এই জাতির সামগ্রিক বিবেক ঐ ধরনের অর্থহীন বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্তের উপর কখনও আশ্বস্ত হতে পারে। ইসলামরে সীমার মধ্যে তো কেবল ইসলামের আলোকে লালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জ্ঞানবুদ্ধিই এবং ইসলামের মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্ঞানই সঠিক কাজ করতে পারে। বিজাতীয় রং ও মেজাজে রঞ্জিত জ্ঞানবুদ্ধি অথবা প্রশিক্ষণহীন জ্ঞান বিশৃংখলা সৃষ্টি ব্যতীত কোন গঠনমূলক কাজ ইসলামের পরিসীমার মধ্যে করতে পারে না” (তরজমানুল কুরআন,ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ. পৃ.১৬৪-১৬৬)।

উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে আপনি নিজেই আপনার গৃহীত নির্যাসের তুলনা করে দেখুন। আপনার সামনে উত্তমরূপে প্রতিভাত হয়ে যাবে যে, বক্তব্য হৃদয়ংগম করার আকাংখার কতটা উত্তম নমুনা আপনি পেশ করেছেন।

চতুর্থ দফা

আপনি  আমার প্রবন্ধ থেকে চতুর্থ যে দফাটি নির্গত করেছেন তা হলোঃ “হাদীসসমূহের এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও এটো বলা যায় না যে, তা  আল্লাহর কালামের মত সুনিশ্চিতভাবে রসূলুল্লাহ (স) এর বণী।”

এও আরেকটি অতুলনীয় নমুনা যা বিতর্কপ্রিয়তার পরিবর্তে বক্তব্য অনুধাবনের আকাংখা হিসাবে আপনি পেশ করেছেন। যে বাক্য সমূহ থেকে আপনি উপরোক্ত সারসংক্ষেপ  নির্গত করেছেন তা হুবহু এখানে তুলে দেয়া হল: “কুরআন মজীদের কোন নির্দেশের একাধিক সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যক্তি, অথবা সংস্থা অথবা বিচারালয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রসিদ্ধ ইলমী পন্থা প্রয়োগরে পর অবশেষে যে ব্যাখ্যাকে বিধানের আসল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে, তার জ্ঞান ও কার্যসীমার মধ্যে ঐটিই আল্লাহর নির্দেশ। সম্পূর্ণ এভাবেই সুন্নাতের পর্যালোচনার ইলমী উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে কোন বিষয়ে যে সুন্নাতই কোন ফকীহ অথবা আইন পরিষদ অথবা বিচারালয়ের নিকট প্রমাণিত মনে হবে তা তার জন্য রসূলুল্লাহ (স)-এর নির্দেশ।”

উপরোক্ত বক্তব্য যদিও আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছিলাম কিন্তু পুনরাবৃত্তি দূষনীয় হওয়া সত্ত্বেও আমি তা পুনরায় উল্লেখ করলাম যাতে আপনি নিজও আপনার নির্যাস নির্গত করার নৈপুণ্যের প্রতিষেধক দিতে পারেন। আর এই নৈতিক দু:সাহসের প্রতিষেধক আমি নিজের পক্ষ থেকে আপনাকে দিতেছি যে, আমার বক্তব্যকে ছিন্নভিন্ন করে আমার সামনে পেশ করে আপনি বাস্তবিকই বাহাদুরি প্রদর্শন করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনার যথার্থ মূল্য দিচ্ছি এবং সেই কথারও যা আপনার মত একজন বিবেকবান মানুষের কাছে আশা করা যায় না, কিন্তু হয়ত “বাযমে তুলূয়ে ইসলাম” পত্রিকাই আপনাকে এই পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে।

পত্রিকায় প্রকাশের দাবী

সবশেষে আমি আরজ করতে চাই যে, আপনার প্রথম টিঠি আপনি নিম্নোক্ত বাক্যে সমাপ্ত করেছেন:

“আইন প্রসংগে যেহেতু সর্বসাধারণের মনে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়, তাই তাদের অবগতির জন্য যদি আপনার প্রদত্ত জওয়াব পত্রস্থ করা হয় তবে আমি আশা করি যে, এ ব্যাপারে  আপনার  কোন আপত্তি থাকবে না।”

আমি এ সম্পর্কে বলতে চাই আপত্তি থাকা তো দূরের কথা আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, আপনি এই পত্রালাপ হুবহু পত্রিকায় ছাপিয়ে দিন। আমি নিজেও তা তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় ছাপিয়ে দিচ্ছি। আপনিও তা “তুলূয়ে ইসলাম” প্রত্রিকায় নিকটবর্তী কোন সংখ্যায় ছাপানোর ব্যবস্থা করুন, যাতে উভয় পক্ষের জনসাধারণ এ সম্পর্কে অবহিত হয়ে পেরেশানি  থেকে মুক্তি পেতে পারে।

তরজমানুল কুরআনবিনীত

জুলাই ১৯৬০ খৃ.আবূল আ‘লা

নবূওয়াতের পদমর্যাদা

[পূর্ববর্তী  পৃষ্ঠাগুলোতে সুন্নাতের আইনগত মর্যাদা সম্পর্কে ডকটর আবদুল ওয়াদূদ সাহেব ও প্রবন্ধকারের মধ্যে যে পত্রবিনিময় হয় তা পাঠকগণের  গোচরিভূত হয়েছ। এ সম্পর্কে ডকটর সাহেবের আরও একটি পত্র হস্তগত হয়েছে, যা নিম্নেগ্রন্থকারের জওয়াবসহ উল্লেখ করা হল]।

ডকটর সাহেবের পত্র

মুহাতারাম মাওলানা!

আসসালামু আলাইকুম। ৮আগষ্ট আপনার চিঠি পেয়েছি। আশা করি এরপর কিছুটা প্রসন্নতার সাথেই কথা বলা যাবে। আপনার ২৬ জুনের জত্রে আমার প্রথম পত্রের জওয়াবের সমাপ্তিতে আপনি বলেছিলেন:

“পরের প্রশ্নগুলো উত্থাপনের পূর্বে আপনার একথা পরিষ্কারভাবে বলা দারকার ছিল যে, রসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদ পাঠ করে শুনিয়ে দেয়া ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও কাজ করেছিলেন কিন, যদি করে থাকেন তবে কি হিসাবে?”

অনন্তর একথাও লিখেছিলেনঃ “প্রথমে আপনাকে পরিষ্কার বলতে হবে যে, রসূলুল্লাহ (স) -এর সুন্নাত স্বয়ং কোন জিনিস কি না? তাকে আপনি কুরআনের পাশাপাশি আইনের উৎস হিসাবে মানেন কি না, যদি না মানেন তার পেছনে আপনার যুক্তি কি?”

অতএব আমার বর্তমান পত্রে আলোচ্য বিষয়ের কেবল এই অংশ সম্পর্কে কথা বলাই যুক্তিসংগত মনে হচ্ছে। আর এর অবশিষ্ট অংশের আলোচনা ভবিষ্যতের জন্য মুলতবি রাখলাম। আপনার হয়ত মনে আছে, সুন্নাতের বাস্তব গুরুত্বকে না অস্বীকার করি, আর না তার গুরুত্বকে খতম করার কোন উদ্দেশ্য আমার আছে।”

অতএব “আমার মতে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত স্বয়ং কোন জিনিস কি না”-আপনার এরূপ প্রশ্ন অপ্রয়োজনীয়। অবশ্য সুন্নাত বলতে যা বুঝায় এ ব্যাপারে আপনার সাথে আমার মতবিরোধ আছে। এখন অবশিষ্ট থাকল এই প্রশ্ন যে, আমি সুন্নাতকে কুরআনের পাশাপাশি আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করি কি না? এ প্রসংগে আমার উত্তর নেতিবাচক। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন, এর সপক্ষে আমার প্রামণ কি? প্রথমে আমাকে একথা পরিষ্কার করবার অনুমতি দিন যে, রসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদ পাঠ করে শুনানো ছাড়া দুনিয়াতে আরও কোন কাজ করেছেন কিনা? যদি করে থাকেন তবে কি হিসাবে? এর উত্তর সামনে এসে গেলে সাথে সাথে যুক্তিপ্রমাণও সামনে এসে যাবে।

আমি আপনার সাথে শতকরা একশো ভাগ একমত যে, মহানবী (স) শিক্ষক ছিলেন, বিচারকও ছিলেন, সেনাপতিও। তিনি লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের একটি সুসংগঠিত জামাআতও প্রতিষ্ঠা করেছেন, অতপর একটি রাষ্ট্রও কায়েম করেছেন ইত্যাদি। কিন্তু আপনার একথার সাথে আমি একমত নই যে, “তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে রসূলুল্লাহ (স) যা কিছু করেছেন তা সেই সুন্নাত যা কুররআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ বিধানদাতার মহান আইনের গঠনও পূর্ণতা প্রদান করে।”

নিসন্দেহে মহানবী (স) সর্বোচ্চ বিধানদাতার আইন অনুযায়ী সমাজ সংগঠন করেছেন, কিন্তু আল্লাহর কিতাবের আইন (ন্উাযুবিল্লাহ) অসম্পূর্ণ ছিল এবং মহানবী (স) কার্যতক যা কিছু করেছেন তার দ্বারা এই আইন পূর্ণতা লাভ করে, এ কথা আমার বোধগম্য নায়। আমার মতে ওহী প্রাপ্তির ধারাবাহিকতা মহানবী (স) এর সাথে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু রিসালাতের দায়িত্ব যা রসূলুল্লাহ (স) সম্পাদন করেছেন তার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, মহানবী (স)-এর পরেও তাঁর পদাংক অনুসরণে  সমাজ পরিচালনা করা যেতে পারে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকবে। মহানবী (স) যদি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন)-অন্যদের নিকট পৌছে দিয়ে থাকেন, তবে উম্মাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে কে অন্যদের পর্যন্ত পৌছে দেয়া। মহানবী (স) যদি “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” অনুযায়ী জামাআত গঠন করে থাকেন, রাষ্ট কায়েম করে থাকেন এবং আমর বিল-মা‘রূফ ওয়া নাহী আনিল-মুনকার (সত্যন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায় ও অসত্যের প্রতিরোধ)-এর দায়িত্ব পালন করে থাকেন তবে উম্মাতেরও কর্তব্য হচ্ছে, ঠিক এভাবে কাজ করা। মহানবী (স) যদি “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন“ তদনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের মীমাংসা করে থাকেন তবে উম্মাতকেও

“আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী মীমাংসা করতে হবে। মহনবী (স) যদি (‘কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর’) অনুযায়ী রাষ্টীয় কার্যবলী পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করে  থাকেন তবে উম্মাতও তাই করবে। মহনবী (স) যদি তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে যুদ্ধ সমূহে ঘোড়ার পিঠে অতিবাহিত করে থাকেন তবে উম্মাতও ঐসব মূলনীতি সামনে রেখে যুদ্ধ করবে।

অতএব “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী উম্মাত যদি প্রশিক্ষণ,সংগঠন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, পরামর্শ, বিচার, যুদ্ধসংগ্রাম প্রভৃতি কাজ করে তবে তা রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতেরইড অনুসরণ। মহানবী (স)-ও তাঁর যুগের দাবী অনুযায়ী “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী আমল করে সমাজ গঠন করেন। আর রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ হচ্ছে এই যে, প্রতিটি যুগের উম্মাত নিজ যুগের দাবী অনুযায়ী “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী আমল করে সমাজ গঠন করবে। বর্তমান সময়ে আমরা যে ধরনের সরকার ব্যবস্থা পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং বর্তমানের দাবী অনুযায়ী উপযুক্ত মনে করব তদ্রুপ সরকার গঠন করব। কিন্তু “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তার চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থান করে তা করতে হবে। এটাই হচ্ছে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের উপর আমল। আমরা এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” শীর্ষক আয়াত যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তদনুযায়ী যদি যুদ্ধ করি তবে এটা হবে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের উপর আমল।

সুনানাতের অর্থ যদি এই হয়, যেমন এক মৌলভী সাহেব একটি স্থানীয় পত্রিকায় গত সপ্তাহের লিখেছিল যে, হযরত উমার (রা)-র সেনাবাহিনীর একটি দুর্গ দখলে এজন্য বিলম্ব হচ্ছিল যে, সৈনিকগণ কয়েক দিন ধরে মেসওয়াক করেননি, অথবা আজকের আনবিক যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে তীরের ব্যবহার সুন্নাত অর্থে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে থাকে, কারণ মহানবী (স) যুদ্ধের সময় তীর ব্যবহার করেছেলেন, তবে মহানবী (স) এর সুন্নাতের সাথে এর চেয়ে অধিক উপহাসের বিষয় আর কি হতে পারে!

উপরোক্ত সমস্ত কাজে মহানবী ( স) তেইশ বছরের নবূৗয়াতী জীবনে যার অনুসরণ করেছেন তা আল্লাহর কিতাবে বর্তমান-রই অনুসরণ করেছেন এবং উম্মাতকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারাও এর অনুসরণ করবে। যেখানে (“তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যা নাযিল করা হয়েছে-তোমরা তার অনুসরণ কর”- আ‘রাফ: ;৩) বলে উম্মাতের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, সেখানে এই ঘোষণাও দেয়া হয়েছে যে, মহনবী (স)-ও এর অনুসরণ করেন “বল, আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আমার নিকট যে ওহী করা হয় আমি তো শুধু তারই অনুসরণ করি”-(আরাফ:২০৩)। না জানি আপনি কোন সব কারণের ভিত্তিতে আল্লাহর কিতাবের বিধানকে অসম্পূর্ণ বলেছেন। অন্তত আমার দেহে তো এই ধারণাও কম্পন সৃষ্টি করে। আপনি কি কুরআন মজীদ থেকে এমন কোন আয়াত পেশ করতে পারেন যা থেকে জানা যাবে যে, কুরআনের বিধান অসম্পূর্ণ? আল্লাহ তাআলা তো মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্য শুধুমাত্র একটি আইন বিধানের দিকেই ইংগিত প্রদান করেছেন, যা সংশয় সন্দেহের উর্ধে,বরং তার শুরুই হয়েছে নিম্নোক্ত বাক্যর দ্বারা- “এটা সেই কিতাব, এত কোন সন্দেহ নাই।” আবার জীবনের যাবতীয় বিষয়ের ফয়সালার জন্য এই জীবন-বিধানের দিকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এটাও পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, এই আইন-বিধান ব্যাপক ও বিস্তারিত।

“তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে সালিশ মানব-যদিও তিনিই তোমাদের প্রতি সুস্পষ্ট কিতাব নাযিল করেছেন?”-(আনআম:১১৪)।

বরং মুমিন ও কাফেরের মধ্যে এই পার্থক্য রাখা হয়েছে যে-

“আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তরাই কাফের”- (মায়েদা:৪৪)।

কুরআন মজীদকে (মহিমাময় গ্রন্থ) বলে কি সম্বোধন করা হয়নি? (সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে তোমার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ”)- এর ঘোষণা কি একাথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয় যে, আল্লাহর বিধান পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে? আর যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা পূণৃ হয়ে গেছে। কাফেররাও তো এই কিতাব ছাড়া কোন জিনিস নিজেদের সান্ত্বনার জন্য আশা করত,যখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন যে, এই কিতাব কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয়?

“এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি যা তাদের নিকট পাঠ করা হয়?-(আনকাবূত:৫১)।

একথা আমি তীব্রভাবে অনুভব কারছি যে, দীনের দাবী যেহেতু এই ছিল যে, সামগ্রিকভাবে কিতাবের উপর আমল হবে এবং এটা হতে পারে না যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ বুঝ অনুযায়ী কুরআনের উপর আমল করবে। তাই সার্বিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য একজন জীবিত ব্যক্তির প্রয়োজন এবং আমি এও অনুভব করি যে, সেখানে সামগ্রিক ব্যবস্থা কায়েমের প্রশ্ন রয়েছে-সেই লক্ষ্যে যে ব্যক্তি পৌছিয়ে দেন তার স্থান ও মর্যাদা অনেক উপরে। কারণ তিনি পয়গাম এজন্য পৌছে দেন যে,ওহী তিনি ছাড়া আর কারো কাছে আসে না। সুতরাং কুরআন মজীদ এজন্য পরিষ্কার করে দিয়েছে যে- “ কেউ রসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল“-(নিসা:৮০)। অতএব রসূলুল্লাহ (স) উম্মাতের কেন্দ্রবিন্দুও ছিলেন। আর রসূলুল্লাহ (স)-এর পরেও এই কেন্দ্রিকতাকে কয়েম রাখা হবে। অতএব এই বিষয়টি কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত বাক্যে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে-

“মুহাম্মদ একজন রসূল মাত্র, তার পূর্বে রসূলগণ গত হয়েছে। অতএব যদি সে মারা যায় অথবা নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে?”-(আল-ইমরান:১৪)

প্রকাশ থাকে যে, আমর বিল-মারূফ ওয়া নাহয়ু আনিল মুনকার এর ধারাবাহিকতা (যদি এর উদ্দেশ্য ওয়াজ-নসীহত না হয়) এই অবস্থায় কয়েম থাকতে পারে যে, রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের উপর আমল করার মাধ্যমে জাতির কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতাকে অব্যাহতভাবে কার্যকর রাখা হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, যে আইন-ব্যবস্থার উপর চালানো মহানবী (স) এর উদ্দেশ্য ছিল এবং ভবিষ্যত উম্মাতের কেন্দ্রের উদ্দেশ্য হবে, এই আইন ব্যবস্থাকে অসম্পূর্ণ করা হবে।

আপনার আগের প্রশ্ন এই যে, মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে যে কাজ করেছেন তাতে তাঁর মর্যাদা কি ছিল? আমার  উত্তর এই যে, মহানবী (স) যা কিছু করে দেখিয়েছেন তা একজন মানুষ হিসাবে, কিন্তু “যা আল্লাহ নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী করে দেখিয়েছেন। মহানবী (স)-এর রিসালাতের দায়িত্ব সম্পাদন ছিল ব্যক্তি হিসাব, আমার এই উত্তর আমার নিজের মনমগজ প্রসূত নয়, বরং আল্লাহর কিতাব থেকে এর প্রমাণ পাওয়াম যায়। মহানবী (স) বারবার একথার উপর জোর দিয়েছেন যে, (‘আমি তোমাদের মতই মানুষ’)। কুরআনের আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, রাষ্টীয় ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে মহানবী (স)-এর মর্যাদা ছিলঃ একজন ব্যক্তি হিসাবে এবং কখনও কখনও তাঁর ইজতিহাদী ভুলও হয়ে যেত।

“বল! আমি বিভ্রান্ত হলে বিভ্রান্তির পরিণাম আমারই এবং যদি আমি সৎপথে থাকি তবে তা এজন্য যে, আমার নিকট আমার প্রতিপালক ওহী প্রেরণ করেন। তিনি সর্বশ্রোতা,অতীব নিকটে”-(সাবা:৫০)।

দীন ইসলামের কোন গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করার মত ইজতিহাদী ভুল হয়ে গেলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার সংশোধনীও এসে যেত। যেমন এক যুদ্ধের প্রাক্কালে কতিপয় লোক যুদ্ধে যোগদান না করে পেছনে থেকে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করল এবং মহানবী (স)-ও অনুমতি প্রদান করলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিল হলঃ

“আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করেছেন। কারা সত্যবাদী তা তোমার নিকট স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এবং কারা মিথ্যাবাদী তা না জানা পর্যন্ত তুমি কেন তাদের অব্যাহতি দিলে?”(তওবা:৪৩)।

অনুরূপভাবে সূরা তাহরীমেও সংশোধনী এসেছে:

“ হে নবী ! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন তুমি তা নিষিদ্ধ করছ কেন?-” (তাহরীম:১)

অনুরূপভাবে সূরা আবাসায়:

“ সে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এসেছে। তুমি কেমন করে জানবে, সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারি আসৎ। পক্ষান্তরে যে পরোয়া করে না তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছ। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নাই। পক্ষান্তরে যে তোমার নিকট ছুটে  এলো এাবং সে সশংকচিত্ত, তুমি অবজ্ঞা করলে“-(আয়াত নং ১-১০)।

উপরোক্ত আলোচনা প্রতিভাত হল যে, ওহীর আলোকে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী পরিচালনার ক্ষেত্রে আনুষংগিক বিষয়াদিতে রসূলুল্লাহ (স)-এর ইজতিহাদী ভুলও হয়ে যেত। আর মহনবী (স) মানুষ হিসাবে এসব কাজ সম্পাদন করার ক্ষেত্রেই এরূপ হওয়া সম্ভব ছিল। যদি এরূপ না হত তবে এর দুটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতির সৃষ্টি হত।

প্রথমত এই ধারণা যে, মহানবী (স) যা কিছু করেছেন তা যেহেতু নবী হিসাবে করেছেন তাই সাধারণ মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। সুতরাং আজও নিরাশার জগতে কোন স্থানে এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে, মহানবী (স) যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত এবং তা পুর্নবার কায়েম করা সম্ভব নয়। এই ধারণা স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ নাকচ করে দেয়।

এর দ্বিতীয় পরিণতি এই ধারণার আকারে প্রকাশ পেতে পারে যে, এজন্য মহানবী (স)-এর পরেও নবীগণের আগমন অত্যাবশ্যক-যাতে তারা পুর্নবার এই ধরনের সমাজ কায়েম করতে পারেন  যেহেতু সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়)।

আপনি নিজেই চিন্তা করুন যে, এই দুটি পরিণতি কত ভয়াবহ যা এই ধারণার ফলশ্রুতি হিসাবে আত্মপ্রাকাশ করে সামনে আসছে যে, মহানী (স) যা কিছুই করেছেন একজন নবী হিসাবেই করেছেন। খতমে নবূওয়াত (নবূওয়াতের পরিসমাপ্তি) মানবতার পরিভ্রমণ পথে একটি মাইল-ফলকের মর্যাদা সম্পন্ন। এখানে থেকে ব্যক্তিত্বের যুগ শেষ হয়ে যায় এবং মূলনীতি ও মূল্যবোধের যুগ শুরু হয়। সুতরাং “মহানবী (স) যা কিছু করেছেন একজন নবী হিসাবে করেছেন” এই ধারণা খতমে নবূওয়াতের মূলনীতি প্রত্যাখ্যানের কারণ হয়ে দাঁড়ায় (মুহাম্মদ একজন রসূলমাত্র-৩: ১৪৪)-এর মত সুস্পষ্ট আয়াত থাকতে একথা বলা যে, রসূলুল্লাহ (স) যা কিছু করতেন ওহীর আলোকেই করতেন [এবং ওহীর ধারাবাহিকতা মহানবী (স)-এর সত্তার সাথে শেষ হয়ে গেছে]-এই কথারই সুস্পষ্ট ঘোষণা যে, মহানবী (স) এর পর দীন ইসলামের ধারাবাহিকতা কায়েম থাকতে পারে না। খলীফাগণ উত্তমরূপেই বুঝতেন যে, ওহী আল-কিতাব এর মধ্যে সংরক্ষিত আছে এবং এরপর মহানবী (স)  যা কিছু করতেন পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। তাই তাঁর ইন্তেকালের পর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসতে পারেনি। রাষ্ট্রের সীমা বর্ধিত হওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজনের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। সামনের দিনগুলোতে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। এর সমাধানের জন্য পূর্বের কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে এবং তার মধ্যে পরিবর্তনের প্রয়োজন না হলে খলীফাগণ তাকে সঅসস্থায় বহাল রাখতেন। আর যদি পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে তবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন্ এসব কিছুই কুরআনের আলোকে করা হত। এটা রসূলুল্লাহ (স)-এর প্রদর্শিত পন্থাই ছিল এবং তাঁর স্থলাভিষিক্তগণও তা কায়েম রাখেন। এরই নাম ছিল রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ।

যদি ধরে নেয়া হয়, যেমন আপনি বলেন যে, মহানবী (স) কিছু করতেন ওহীর আলোকে করতেন, তবে এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে যে ওহী প্রেরণ করতেন তার উপর (ন্উাযুবিল্লাহ)আশ্বস্ত না হতে পারায় আরেক প্রকারের ওহী নাযিল শুরু হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত এই দুই রংগের ওহী কেন? পূর্বে আগত নবীগনের উপর যে ওহী নাযিল হত তাতে কুরআন নাযিল হওয়ার ইংগিত থাকত। অতএব আপনি যে দ্বিতীয় প্রকারের ওহীর কথা বলছেন,কুরআন মজীদে তার দিকে ইংগিত করাটা কি আল্লাহর জন্য খুব কঠিন ব্যাপার ছিল, যিনি সব কিছুর উপর শক্তিমান? কুরআনে তো এমন কোন জিনিস আমার নজরে পড়ছে না। আপনি যদি এ ধরনের কোন আয়াতের দিকে ইংগিত করতে পারেন তবে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। ওয়াসসালাম।

অকৃত্রিম

আবদুল ওয়াদূদ

প্রবন্ধকারের জবাব

মুহতারামী ওয়া মুকাররামী

আসসালামু আলঅইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। ১৭ আগষ্ট, ১৯৬০ খৃ. আপনার পত্র হস্তগত হয়েছে। সদ্য প্রাপ্ত এই পত্রে আপনার পূর্বেকার চারটি প্রশ্নের মধ্যে প্রথম প্রশ্নের উপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখে নবূওয়াত ও সুন্নাত সম্পর্কে আপনার যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, আপনার নবূওয়াত সম্পর্কিত ধারণাই মৌলিকভাবে ভ্রান্ত। প্রকাশ থাকে যে, ভিত্তির মধ্যেই যদি গলদ থাকে তবে এই ভিত্তির সাথে সংশ্লিষ্ট পরের প্রশ্নগুলোর উপর আলোচনা করে আমরা কোন সিদ্ধান্তে   পৌছতে পারছি না। এজন্যেই আমি আবেদন করেলিলাম যে, আপনি আমার প্রদত্ত উত্তরের উপর আরো প্রশ্ন উত্থাপন করার পরিবর্তে আমার উত্তরের মধ্যে উল্লেখিত আসল বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখুন। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ যে, আপনি আমার এই আবেদন গ্রহণপূর্বক সর্বপ্রথম মৌলিক প্রশ্নের উপর নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এখন আমি আপনার এবং যেসব লোক এই ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত আছেন তাদের কিছু খেদমত করার সুযোগ পাব।

নবূওয়াত ও সুন্নাতের যে ধারণা ব্যক্ত করেছেন তা কুরআন মজীদের নিত্যন্ত ক্রটিপূর্ন অধ্যয়নেরই ফল। সবচেয়ে বড় বিপদ এই যে, আপনি এই নেহায়েত ক্রটিপূণৃ ও স্বল্প অধ্যয়নের উপর এতটা নির্ভর করে বসে আছেন যে, ১ম হিজরী শতক থেকে আজ পর্যন্ত  এ সম্পর্কে গোটা উম্মাতের আলেম সমাজ ও সর্বসাধারণের যে ঐক্যবদ্ধ আকীদা ও কার্যক্রম চলে আসছে তাকে আপনি ভ্রান্ত মনে করে বসেছেন এবং আপনি নিজের কাছে এই ধারণা করে বসে আছেন যে, পৌনে চৌদ্দশত বছরের দীর্ঘ সময়ব্যাপী সমস্ত মুসলমান মহানবী (স) এর পদমর্যাদা অনুধাবন করার ব্যাপারে হোঁচট খেয়েছে, তাদের সমস্ত আইনজ্ঞ আলেম সুন্নাতকে আইনের উৎস মেনে নিয়ে ভুল করেছেন এবং তাদের সমগ্র সাম্রাজ্য নিজের আইন-ব্যবস্থার ভিত্তি সুন্নাতের উপরন রেখে ভ্রান্তির শিকার হয়েছে। আপনার এই ধারণার উপর বিস্তারিত আলোচনা তো সামনে অগ্রসর হয়ে করব। কিন্তু এই আলোচনা শুরু করার পূর্বে আমি চাচ্ছি যে, আপনি শান্ত মনে আপনার দীনী জ্ঞানের পরিমাণটা স্বয়ং যাচাই করুন এবং নিজেই চিন্তা করুন যে, এ সম্পর্কে আপনি যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছেন তা কি এতবড় একটি ধারণার জন্য যথেষ্ট? কুরআন মজীদ তো কেবল আপনি একাই পড়েননি, কোটি কোটি মুসলমান প্রতিটি যুগে এবং পৃথিবীর প্রতিটি অংশে তা অধ্যয়ন করেছেন এবং এমন অসংখ্য ব্যক্তিত্ব ইসলামের ইতিহাসে অতীত হয়েছেন এবং আজও পাওয়া যাচ্ছে, যাদের জন্য কুরআনের অধ্যয়ন তাদের অসংখ্য ব্যস্তাতার মধ্যে একটি আনুষংগিক  (গৌন) ব্যস্ততা ছিল না, বরং তারা নিজেদের গোটা জীবন কুরআনের এক একটি শব্দ সম্পর্কে চিন্তা করার মধ্যে, তার অন্তর্নিহিত ভাব হৃদয়ংগম করায় এবং তার থেকে সিদ্ধান্ত বের করায় অতিবাহিত করে দিয়েছেন এবং এখনও করছেন। শেষ পর্যন্ত আপনি কিভাবে এই ভ্রান্তির শিকার হলেন যে, নবূওয়াতের মত গুরূত্বপূর্ন মৌলিক বিষয়ে এসব লোক কুরআন মজীদের উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ উল্টা বুঝেছেন এবং সঠিক উদ্দেশ্য কেবল আপনার নিকট ও আপনার মত গুটিকয়েক ব্যক্তির সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে? গোটা ইসলামের ইতিহাসে আপনি উল্লেখযোগ্য একজন আলেমের নামও নিতে পারবেন না যিনি কুরআন মজীদের আলোকে নবূওয়াতের পদমর্যাদা সম্পর্কে আপনার অনুরূপ ধারণা ব্যক্ত করেছেন এবং সুন্নাতের মর্যাদাও আপনার অনুরূপ সাব্যস্ত করেছেন। আপনি যদি এ ধরনের কোন একজন আলেমেরও বরাত দিতে পারেন তবে অনুগ্রহপূর্বক তার নামটা বলে দিন।

১.নবূওয়াতের পদমর্যাদা ও তার দায়িত্ব

আপনার বুদ্ধি ও বিবেকের নিকট এই অকৃত্রিম আবেদন করার জর এখন আমি আপনার পেশকৃত ধারণা সম্পর্কে কিছু আরজ করব। আপনার গোটা আলোচনা দশটি দফা সম্বলিত। তার মধ্যে প্রথম দফা স্বয়ং আপনার বাক্য অনুযায়ী এই যে:

“আমি আপনার সাথে শতকরা একশো ভাগ একমত যে, মহানবী (স) শিক্ষকও ছিলেন, বিচারকও ছিলেন এবং সেনাপতিও। তিনি লোকদের প্রশিক্ষণ দেয়েছেন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়ে একটি সুসংগঠিত জামাআতও প্রতিষ্ঠা করেছেন, অতপর একটি রাষ্ট্রও কায়েম করেছেন।”

আপনি যে শতকরা ১০০% ভাগ ঐক্যমতের কথা বলেছেন তা মূলত শতকরা একভাগ বরং হাজারের একভাগওনয়। কারণ আপনি মহানবী (স) কে শুধুমাত্র শিক্ষক, বিচারক, রাষ্ট্রপ্রধান ইত্যাদি মেনে নিয়েছেন,কিন্তু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ হওয়ার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসহ মানেননি। অথচ এই বৈশিষ্ট্য স্বীকার করা বা না করার করণেই সমস্ত পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। সামনে অগ্রসর হয়ে আপনি নিজেই একথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, আপনার মতে মহানবী (স) এই সমস্ত কাজ রসূল হিসাব নয় বরং একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে করেছেন। আর একারণেই সাধারণ মানুষ হিসাবে তিনি যেসব কাজ করেছেন তাকে আপনি সেই সুন্নাত বলে স্বীকার করেন না যা আইনের  উৎস হিসাবে গণ্য। অন্য কথায় মহানবী (স) আপনার মতানুযায়ী  একজন শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলার নিয়োগকৃত নয়, বরং দুনিয়াতি যেমন অন্যান্য শিক্ষক হয়ে থাকে তিনিও তদ্রুপ একজন শিক্ষক ছিলেন। অনুরূপভাবে তিনি বিচারকও ছিলেন,কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে তাকে বিচারক নিয়োগ করেননি, বরং তিনিও দুনিয়ার সাধারণ বিচারকদের ন্যায় একজন বিচারক ছিলেন। শাসক, সংস্কারক নেতা ও পথপ্রদর্শকের ক্ষেত্রেও আপনি একই দৃষ্টিভংগী গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে কোন পদই আপনার ধারণায় মহানবী (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘দায়িত্ব প্রাপ্ত’ হিসাবে লাভ করেননি।

প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে মহানবী (স) এই পদগুলো কিভাবে লাভ করলেন? মক্কার ইসলাম গ্রহণকরী লোকের কি স্বেচ্ছায় তাকে নিজেদের  নেতা নির্বাচন করেছিল এবং তারা নেতৃত্বের এই পদ থেকে তাকে পদচ্যুত করারও অধিকারী ছিল? মদীনায় পৌছে যখন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা হল, সেই সময় কি আনসার ও মুহাজিরগণ কোন পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আমাদের এই রাষ্ট্রের কর্ণধার, প্রধান বিচারপতি এবং সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হবেন? মহানবী (স) এর বর্তমানে কি অপর কোন মুসলমান এসব পদের জন্য নির্বাচিত হতে পারত? মহানবী (স) এর নিকট থেকে এসব পদ অথবা এর মধ্যে কোন একটি পদ ফেরত নিয়ে কি মুসলমানগণ পারস্পরিক পরামর্শেরভিত্তিতে অপর কাউকে প্রদান করার অধিকারী ছিল? তাছাড়া এমন কিছুও ঘটেছে কি যে, মদীনার এই রাষ্ট্রের জন্য কুরআন মজীদের আওতায় ব্যাপক বিধানও সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে মহানবী (স) এর যুগে কোন আইন পরিষদ গঠন করা হয়েছিল যেখানে তিনি তার সাহবীগণের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য অনুধাবনের চেষ্টা করে থাকবেন এবং পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুরআনের যে অর্থ নির্দিষ্ট হয়ে থাকত তদনুযায় আইন-কানূন রচিত হয়ে থাকবে? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি ইতিবাচক হয় তবে অনুগ্রহপূর্বক তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পেশ করুন। আর যদি নেতিবাচক হয় তবে অনুগ্রহপূর্বক তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পেশ করুন। আর যদি নেতিবাচক হয় তবে আপনি কি বলতে চান যে, মহানী (স) গায়ের জোরে নিজেই পথপ্রদর্শক, রাষ্টপ্রধান,বিচারপতি,আইনপ্রণেতা ও মহান নেতা হয়ে বসেছেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো,মহানবী (স) এর যে মর্যাদা আপনি সাব্যস্ত করছেন কুরআন মজীদও কি তার অনুরূপ মর্যাদা সাব্যস্ত করে? এ প্রসংগে একটু কুরআন শরীফ খুলে তার ভাষ্য দেখুন।