সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা

। খুলাফয়ে রাশদীনের প্রতি অপবাদ

আপনার নবম দফা হলো: “খলীফাগন উত্তমরূপেই জানতেন যে, ওহী আল-কিতাব এর মধ্যে সংরক্ষিত আছে এবং অতপর মহানবী (স) যা কিছু করতেন তা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। তাই তার ইন্তেকালের পর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসতে পারেনি। রাজ্যের সীমা বর্ধিত হওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজনের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। এজন্য সামনের দিনগুলোতে নিত্য নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। এর সামাধানের জন্য পূর্বের কোন সিধান্ত পাওয়া গেলে এবং তার মধ্যে পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তারা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এসব কিছুই কুরআনের আলোকে করা হত। এটাও ছিল রসূলল্লাহ (স) এর প্রদর্শিত পন্থা এবং তার স্থলাভিষিক্তগণও তা কায়েম রাখেন। এরই নাম ছিল রসূলুল্লাহ (স) যা কিছু করতেন তা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। অথচ রসূলুল্লাহ (স) কেবল কাজ সমাধার পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেই পরার্মশ করেছেন  এবং সেগুলোও ঐসব পন্থাপদ্ধতি যে সম্পর্কে ওহীর সাহায্যে তিনি কিছু প্রাপ্ত হননি। কুরআন পাকের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তার কোন শব্দের বা বাক্যাংশের বিশেষ উদ্দেশ্য নির্ধারণে তিনি কারও পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এ ক্ষেত্রে তার নিজের ব্যাখ্যাই ছিল চুড়ান্ত। অনুরূপভাবে তার গোটা নবূওয়াতী জিন্দেগীতে কখনও লোকের জন্য কোন কিছু ফরজ, ওয়াজিব, হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েয, সিদ্ধ-নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করার জন্য কোন পারামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়নিএবং সমাজে কি রীতিনীতি ও বিচার-ব্যবস্থা কায়েম করা হবে সে সম্পর্কেও এ ধরনের কোন পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। মহানবী (স) এর পবিত্র জিন্দেগীতে কিবলমাত্র তার বক্তব্য এবং তার বাস্তব জীবনধারাই ছিল আইন পরিষদ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি উপরোক্ত বিষয়ে মহাবনী (স) এর সামনে মুখ খোলার চিন্তাও করতে পারত না। আপনি কি এমন কোন উদাহরণ পেশ করতে পারেন যে, রিসালাত যুগে কুরআন পাকের কোন নির্দেশের ব্যাখ্যা পরামর্শের ভিত্তিতে করা হয়েছে, অথবা কোন আইন পরামর্শের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে? অনেকগুলোর প্রয়োজন নাই, আপনি কেবল একটি দৃষ্টান্তই পেশ করুন।

দ্বিতীয়ত, বাস্তব ঘটনার পরিপন্থী কথা আপনি এই বলেছেন যে, খুলাফায়ে রাশেদীন শুধুমাত্র কুরআন মজীদকে হেদায়াতের উৎস মনে করতেন এবং রসূলুল্লাহ (স) এর কথা ও কাজকে অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয় আইনের উৎস মনে করতনে না। এটা তাদের প্রতি আপনার আরোপিত মারাত্মক অপবাদ যার সমর্থনে আপনি তাদের কোন কথা বা কার্যক্রম পেশ করতে পারবেন না। যদি এর কোন প্রমাণ আপনার নিকট থেকে থাকে তবে তা পেশ করুন। তাদের কার্যক্রমের যে সাক্ষ্য তাদের যুগের সাথে সম্পৃক্ত লোকেরা পেশ করেছেন তা তো নিম্নরূপ:

ইবনে সীরিন (৩৩-১১০ হি:) বলেন, “আবু বাবর (রা) এর সামনে যখন কোন বিষয় পেশ করা হত এবং তিনি যদি আল্লাহর কিতাবে কোন সমাধান না পেতেন আর সুন্নাতেও না পেতেন তার কোন নযীর, তখন তিনি নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এবং বলতেন: এটা আমার ব্যক্তিগত মত, যদি সঠিক হয় তবে তা আল্লাহর-ই অনুগ্রহ” (ইবনুল কায়্যিম, আলামুল মুওয়াক্কিঈন, ১খ,পৃ. ৫৪)।

মায়মূন ইবনে মিহরান (২৭-১০৭ হি.) বলেন, আবু বাকর সিদ্দীক (রা) এর কর্মনীতি এই ছিল যে, তাকে কোন বিষয়ের ফয়সালা করতে হলে তিনি প্রথমে আল্লাহর কিতাবে অনুসন্ধান করতেন। যদি তাতে নির্দেশ নাপাওয়া যেত তবে তিনি রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতে তালাশ করতেন। যদি তাতে হুকুম পাওয়া যেত তবে তিনি তদনুযয়ী ফয়সালা করতেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি তার কাছে সুন্নাতের জ্ঞান না থাকতে তবে তিনি অন্যদের নিকট জিজ্ঞাসা করতেন যে, এ ধরনের কোন বিষয়ে রসূলুল্লাহ (স ) এর কোন ফয়সালা তোমাদের কারো জানা আছে কি?”(ঐ গ্রন্থ, পৃ৬২)।

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ) পরিপূর্ণ পর্যালোচনা পর তার গবেষণার ফল এভাবে ব্যক্ত করেন

“আবু বাকর সিদ্দিক (রা) এর জীবনে কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধীতা করার একটি দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় না”-(ঐ গ্রন্থ.৪খ.পৃ.১২০)।

একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এই যে, এক দাদী তার নাতির ওয়ারিশী স্বত্বের দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়। মৃতের মা জীবিত ছিল না। আবু বাকর (রা) বলেন, আমি আল্লাহর কিতাবে কোন হুকুম পাচ্ছি না যার ভিত্তিতে তোমকে নাতির ওয়ারিশ বানানো যেতে পারে। অতপর তিনি লোকদের নিকট জিজ্ঞসা করেন যে, মহানবী (স) এ জাতীয় ব্যাপরে কোন হুকুম দিয়েছিলেন কি না। একথা শুনে মুগীরা ইবনে শো‘বা (রা) এবং মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা) দাড়িয়ে সাক্ষ্য দেন যে, মহানবী (স) দাদীকে এক-ষষ্ঠাংশ (অর্থ্যাত মায়ের প্রাপ্য) দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব আবু বাকর (রা) তদনুযায়ী ফয়সালা করে দেন (বুখারী ও মুসলিম সহ হাদীসের সমস্ত প্রসিদ্ধ গ্রন্থে ঘটনাটির উল্লেখ আছে।

ইমাম মালিক (রহ) এর আল-মুওয়াত্তা গ্রন্থে এই ঘটনা উল্লেখ আছে যে, হযরত আবু বাকর সিদ্দীক (রা) নিজ কন্যা হযরত আয়েশা (রা) কে নিজের জীবদ্দশায় কিছু মাল দেয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তার স্মরণ ছিল না যে, এই মাল তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে কিনা। মৃত্যুর কাছাকাছি সময় তিনি তাকে বলেন, যদি সেই মাল তুমি ইতিমধ্যে হস্তগত করে নিয়ে থাক তবে তা তোমারই মালিকানায় থাকবে (কারণ তা দান বা হেবা হিসাবে গন্য  হবে)। আর তুমি যদি এখন পর্যন্ত তা হস্তগত না করে থাক তবে তা এখন আমার সকল ওয়ারিসের মধ্যে বন্টিত হবে। কারণ এখন আর তা হেবার পর্যায়ে নাই, বরং ওসীয়াতের পর্যায়ভুক্ত এবং “লা ওয়াসিয়্যাতা লি ওয়ারিছ” (ওয়ারিসদের জন্য কোন ওসিয়াত করা যাবে না) শীর্ষক হাদীসের আলোকে ওয়ারিসের জন্য কোন ওসীয়াত মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে কার্যকর হতে পার না। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ প্রথম খলীফার জীবনে পাওয়া যায় যাতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি রসূলুল্লাহ (স) এর তরীকা থেকে চুল পরিমাণ দূরে সরে যাওয়াও জায়েয মনে করতেন না।

কে না জানে যে, খলীফা হওয়ার পার হযরত আাবু বাকর (রা)-র সর্বপ্রথম ঘোষণা এই ছিল যে:

“তোমরা আমার আনুগত্য কর যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তার রসূলের আনুগত্য করি। আমি যদি আল্লাহ ও তার রসূলের অবাধ্যাচরণ করি তবে আমার আনুগত্য করা তোমাদের কর্তব্য নয়।”

 কে না জানে, তিনি মহানবী (স) এর ইন্তেকালের পর উসামা বাহিনীকে কেবলমাত্র এজন্য অভিযানে পাঠাতে জোর দিয়েছেন, যে কাজের ফয়সালা স্বয়ং মহানবী (স) করেছেন তার পরিবর্তন করার অধিকার তার নেই বলেই তিনি মনে করতেন। আরবে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব লক্ষ্য করা যাচ্ছিল,সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহাবায়ে কিরাম (রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম) এই মুহুর্তে সিরিয়ায় সেনাবাহিণী পাঠানো যুক্তিসংগত মনে করেননি তখন হযরত আবু বাকর (রা) এই জওয়াব দিয়েছিলেন:

“কুকুর ও নেকড়ে বাঘেরা যদি আমাকে ছিনিয়েও নিয়ে যায় তবুও আমি রসূলুল্লাহ (স) এর কৃত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করব না।”

হযরত উমার ফরূক (রা) আকাংখা ব্যক্ত করেন যে,অন্তত উসামাকে এই বাহিনীর সেনাপতিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হোক। কারণ অনেক প্রবীণ

(৫২ পৃ)১. হাদীস অস্বীকারকারীগণ বলে যে,কুরআন মজীদে যেখানেই “আল্লাহ ও রসূল” শব্দদ্বয় এসেছে তার অর্থ “জতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব”। কিন্তু এই সূক্ষ্ম বিষয়টি হযরত আবু বাকর (রা)-র বুঝে আসেনি। তিনি বেচারা বুঝেছেন  যে, “জাতির কেন্দ্রীয় নেতা” হিসাবে আমি আল্লাহ ও তার রসূলের অনুগত থাকতে বাধ্য। প্রথম খলীফার শপথ গ্রহণের সময় হয়ত যদি“তুলূয়ে ইসলাম” প্রকাশিত হযে থাকত তবে তা তাকে বলে দিত যে, হে জাতির কেন্দ্রবিন্দু! আল্লাহ ও রসূল তো এখন তুমি নিজেই। তুমি আবার কোন আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করতে যাচ্ছ!

সাহাবী এই যুবক ছেলের নেতৃত্বে কাজ করতে আগ্রহী নন। আবু বাকর (রা) তাঁর দাড়ি ধরে বলেন:

“হে খাত্তাবের পুত্র! তোমার মা তোমার জন্য ক্রন্দন করুক এবং তোমাকে হারিয়ে ফেলুক। তাকে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স) নিয়োগ করেছেন, আর আমাকে বলছ আমি তাকে বরখাস্ত করি!”

উক্ত সেনাবাহিনীকে বিদায় দেয়ার প্রক্কালে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে বলেছিলেন:

“আমি তো অনুসরণকারী ও আনুগত্যকারী মাত্র, বিদআত সৃষ্টিকারী নাই।”

তাছাড়া একথাই বা কে না জানে যে, হযরত ফাতিমা যোহরা (রা)  ও হযরত আব্বাস (রা)-র মীরাসের দাবী হযরত আবু বাকর সিদ্দিক (রা) রসূলুল্লাহ (স)-এর হাদীসের ভিত্তিতেই মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন এবং এই “অপরাধের” জন্য তিনি আজও (শীআদের) গালি খাচ্ছেন। যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের বিরুদ্ধে তিনি যখন জিহাদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন তখন হযরত উমার (রা) এর মতে ব্যক্তিত্বের এই সিদ্ধান্তের যথার্থতা সম্পর্কে এজন্য সংশয় ছিল যে, যেসব লোক কলেমা  (আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নাই) এর প্রবক্তা তাদের বিরুদ্ধে কি করে অস্ত্র ধরা যেতে পারে? কিন্তু আবু বাকর (রা) এর যে জওয়াব দিয়েছেন তা হলো:

“আল্লাহর শপথ! তারা যদি উট বাঁধার একটি রশিও এই যাকাত থেকে রেখে দেয় যা তারা রসূলুল্লাহ (স) এর যুগে দিত, তবে আমি এজন্য তাদের বিরুদ্বে যুদ্ধ করব।”

এই কথা এবং এই কাজ ছিল সেই মহান ব্যক্তির যিনি মহানবী (স) এর পরে সর্বপ্রথম উম্মাতের নেতৃত্বের লাগাম শক্ত হাতে তুলে নেন। আর আপনি বলেছেন যে, মহান খলীফাগণ নিজেদেরকে রসূলূল্লাহ (স) এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অধিকারী মনে করতেন। হযরত আবু বাকর (রা) এর পর হযরত উমার ফারূক (রা)-র এক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভংগি ছিল তা তিনি নিজেই কাযী সুরাইহ (রহ) কে লিখিত এক পত্রে এভাবে উল্লেখ করেছেন:

“তুমি যদি কোন হুকুম আল্লাহর কিতাবে পেয়ে যাও তবে তদনুযায়ী ফয়সালা করবে এবং তার বর্তমানে অন্য কোন জিনিসের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে না। আর যদি এমন কোন বিষয় উপস্থিত হয় যার মীমাংসা আল্লাহর কিতাবে নেই, তবে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতে যে মীমাংসা পাওয়া যায় তদনুযায়ী ফয়সালা কর। যদি এমন কোন বিষয়ে আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত উভয়ই নীরব থাকে তবে তোমার এ অধিকার রয়েছে যে, সামনে অগ্রসর হয়ে নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে সমাধান পেশ কর অথবা মীমাংসা স্থগিত রেখে অপেক্ষা কর।১ তবে আমার মতে তোমার জন্য অপেক্ষা করাই অধিক শ্রেয়”-(ইলামুল মুওয়ক্কিঈন, ২খ.পৃ. ৬১-৬২)।

এটা হযরত উমার (রা)-র স্বলিখিত সরকারী নির্দেশনামা যা তিনি সমসাময়িক খলীফা হিসাবে বিচারালয়ের নীতিমালা সম্পর্কে কূফা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নিকট পাঠিয়েছিলেন। এরপরও কি তার দৃষ্টিভংগি সম্পর্কে কারো ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকার থাকে?

(হযরত উমার (রা)-পরে তৃতীয় খলীফা ছিলেন হযরত উসমান (রা)।২ শপথ অনুষ্ঠানের পর তিনি মুসলিম সর্বসাধারণের সামনে যে প্রকাশ্য ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে বলেন:

“সাবধান! আমি আনুহ্যকারী ও অনুসরণকারী, বিদআত সৃষ্টিকারী নই। আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের আনুগত্য করার পর আমার উপর তোমাদের তিনটি অধিকার রয়েছে যার যিম্মাদারী আমি নিচ্ছি। (এক) আমার পূর্ববর্তী খলীফাগণের আমলে তোমদের ঐক্যমত অনুযায়ী যেসব সিদ্ধান্ত ও পন্থা গৃহীত হয়েছে আমি তার অনুসরণ করব। (দুই) উত্তম ও যোগ্য লোকদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এখন যেসব ফয়সালা হবে আমি তা কার্যকর করব। (তিন) তোমাদের উপর হস্তক্ষেপ থেকে আমি বিরত থাকব, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আইনের আওতায় গ্রেফতার হওয়ার যোগ্য না হও”-(তারীখে তাবারী, ৩খ.,পৃ.৪৪৬)।

চতুর্থ খলীফা ছিলেন হযরত আলী (রা)। খলীফা হওয়ার পর তিনি মিসরবাসীদের নিকট থেকে আনুগত্যের শপথ গ্রহণের জন্য স্বীয়

১. (৫২ পৃ)অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐক্যমত প্রসূত সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাক।

২. এই অংশ পরে সংযোজন করা হয়েছে।

গর্ভনর কায়স ইবনে সাদ ইবনে উবাদাকে প্রেরণের সময় তার হাতে যে সরকারী ফরমান অর্পন করেন তাতে তিনি বলেন:

“সাবধান! আমার উপর তোমাদের অধিকার এই যে, আমি মহান আল্লাহর কিতাব এবং তার রসূলের সুন্নাত অনুযায়ী কাজ করব, তোমাদের কিতাব ও সুন্নাহ প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করব, রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত কার্যকর করব এবং তোমাদের অজ্ঞাতেও তোমাদের কল্যাণ চিন্তা করব”-(তারীখে তাবারী,৩খ.পৃ.৫৫০)।

খুলাফায়ে রাশেদীনের চারজন খলীফার বক্তব্যই উপরে উল্লেখ করা হল, আপনি কোন খলীফাদের কথা বলেছেন যারা নিজেদেরকে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের অনুসরণ থেকে মুক্ত ছিল? তাদের সেই দৃষ্টিভংগী আপনি কি কি উপায়ে অবগত হলেন?

আপনার এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন যে, খুলাফায়ে রাশেদীন কুরআন মজীদের হুকুম-আহকাম তো চূড়ান্তভাবে এবং অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয় মনে করতেন, কিন্তু রসূলুল্লাহ (স) এর সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে যেগুলোকে তারা বহাল রাখা যুক্তিসংগত মনে করতেন সেগুলোকে বহাল রাখতেন এবং যেগুলোর পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করতেন সেগুলো পরিবর্তন করে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। আপনি এর নযীর পেশ করুন যে খিলাফতে রাশেদার সমগ্র যুগে মহানবী (স) এর কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে, অথবা কোন খলীফা বা কোন সাহাবী মত ব্যক্ত করেছেন যে, তাঁরা প্রয়োজনমত মহানবী (স) এর কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেয়ার অধিকার রাখতেন।

১০.মহানবী (স) এর নিকট কুরআন ছাড়াও কি ওহী আসত?

এখন কেবল আপনার সর্বশেষ দফা অবশিষ্ট থাকল যা আপনি নিম্নোক্ত বাক্য ব্যক্ত করেছেন: “যদি ধরে নেয়া হয় যেমন আপনি মনে করেন যে, মহানবী (স) যা কিছু করতেন ওহীর আলোকে করতেন-তবে এর অর্থ এই দাড়ায় যে, আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে যে ওহী প্রেরণ করতেন তার উপর (নাউযুবিল্লাহ) আশ্বস্ত না হতে পারায় আরেক প্রকারের ওহী নাযিল শুরু হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত এই দুই রং এর ওহী কেন? পূর্বকালে আগত নবীগণের উপর যে ওহী নাযিল হত তাতে কুরআন নাযিল হত তাতে কুরআন নাযিল হওয়ার ইংগিত থাকত। অতএব আপনি যে দ্বিতীয় প্রকার ওহী নাযিল হওয়ার কথা বলেছেন-কুরআন মজীদে তার প্রতি ইংগিত করাটা কি আল্লাহর জন্য খুব কঠিন ব্যাপার ছিল যিনি সব কিছুর উপর শক্তিমান? কুরআনে তো এমন কোন জিনিস আমার নজরে পরড়ছে না। আপনি যদি এ ধরনের কোন আয়াতের দিকে ইংগিত করতে পারেন তবে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।”

খুবই সান্ত্বনার কথা। আপনার রায় অনুযায়ী মনে হয় আল্লাহ মিয়া বান্দাদের হেদায়াতের জন্য নয়, বরং নিজের সান্ত্বনার জন্য ওহী নাযিল করতেন এবং তার সান্ত্বনার জন্য বাস এক ধরনের ওহী যথেষ্ট হওয়া প্রয়োজন ছিল।

আপনি তো দুই রং-এর ওহীর কথা শুনেই অস্থির। কিন্তু চোখ মেলে যদি আপনি কুরআন মজীদ পাঠ করে থাকতেন তবে জানতে পারতেন যে, এই কিতাব ছয় রং-এর ওহীর কথা উল্লেখ করেছে-যার মধ্যে শুধুমাত্র এক রং-এর ওহী কুরআন মজীদে সংকলন করা হয়েছে।

“কোন মানুষের এমন মর্যাদা নাই যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যমে ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন বার্তাবাহক প্রেরণ ব্যতিরেকে যে তার অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন। তিনি সমুন্নত,প্রজ্ঞাময়”-(সূরা শূরা:৫১)।

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কোন মানুষের উপর নির্দেশনামা এবং হেদায়াত নাযিল হওয়ার তিনটি পন্থার কথা বলা হয়েছে। সরাসরি ওহী (ইলকা ও ইলহাম), অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে কথোপকথন,, অথবা আল্লাহর বার্তাবাহকের(ফেরেশতা) মাধ্যমে ওহী প্রেরণ। কুরআন মজীদে যেসব ওহী সংকলন করা হয়েছে তা উপরোক্ত তিন প্রকারের ওহীর মধ্যে কেবলমাত্র তৃতীয় প্রকারের ওহী। এর বিবরণী আল্লাহ তাআলা সরাসরি কুরআন মজীদেই পেশ করেছেন।

“(হে নবী ) বল, যে কেউ জিবরীলের শত্রু এজন্য যে, সে আল্লাহর নির্দেশে তোমার অন্তরে কুরআন নাযিল করেছে-যা এর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমার্থক এবং যা মুমিনদের জন্য  পথপ্রদর্শক ও শুভ সংবাদ — আল্লাহ নিশ্চয় কাফেরদের শত্রু”- (শত্রু বাকারা:৯৭-৯৮)।

“তা বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের নাযিলকৃত কিতাব। রুহুল আমীন কা নিয়ে তোমার হৃদয়ে অবতীর্ হয়-যাতে তুমি সৎর্ককারী হতে পার” –(সূরা শুআরাঃ ১৯২-৯৪)

এ থেকে জানা গেল যে, কুরআন মজীদ কেবলমাত্র এক প্রকারের ওহীর সংগ্রহ। রসূলূল্লাহ (স) আর যে দুটি উপায়ে হেদায়াত লাভ করতেন যার উল্লেখ সূরা শূরার আয়াতে করা হয়েছে-তা উপরোক্ত ওহী থেকে স্বতন্ত্র। এখন স্বয়ং কুরআন মজীদ আমাদের বলে দিচ্ছে যে, এসব উপায়েও মহানবী (স) হেদায়াত লাভ করতেন।

১. যেমন  আমি আপনার চতুর্থ দফার উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলে এসেছি-সূরা বাকারার ১৪৩-৪৪ নং আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মসজিদুল হারামকে কিবলা বানানোর পূর্বে মহানবী (স) ও মুসলমানগণ অন্য কোন কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়তেন। আল্লাহ তাআলা কিবলা পরিবর্তনের হুকুম দিতে গিয়ে জোরালো ভাষায় বলেছেন, প্রথম যে কিবলার দেকে মুখ করে নামায পড়া হত তাও আমার হুকুমে নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু কুরআন মজীদে এমন আয়াত কোথাও নাই যাতে ঐ কিবলার দিকে মুখ করার প্রাথমিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে-মহানবী (স) এর উপর কুরআন ব্যতীত আর কোন প্রকারের ওহী না এলে তিনি কি উপায়ে এই হুকুম লাভ করেছিলেন? এ থেকে কি পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় না যে, মহানবী (স) এমন নির্দেশও লাভ করতেন যা কুরআন মজীদে উল্লেখ নাই?

২. রসূলুল্লাহ (স) মদীনায় স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি মক্কা মুআজ্জমায় প্রবেশ করেছেন এবং বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করছেন। তিনি সাহাবায়ে কিরামের নিকট এই স্বপ্নের কথা বলেন এবং চৌদ্দশত সাহাবী সাথে নিয়ে উমরা আদায়ের জন্য রওনা হয়ে যান। মক্কার কাফেররা তাঁকে হুদাইবিয়া নামক স্থানে বাধা দেয় এবং তার ফলশ্রুতিতে হুদাইবিয়ার সন্ধি অনুষ্ঠিত হয়। কোন কোন সাহাবীর মনে সংশয় ও অস্থিরতার সৃষ্টি হলে হযরত উমার (রা) প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রসূল! “আপনি কি আমাদের অবহিত করেননি যে, আমরা মক্কায় প্রবেশ করব এবং তাওয়াফ করব? তিনি বলেন: “আমি কি বলেছিলাম, এই সফরেই তা হবে? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা কুরআন পাকে আয়াত নাযিল করেনঃ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর রসূলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে-কেউ মাথা কামিয়ে, কেউ চুল ছোট করে। তোমাদের কোন ভয় থাকবে না। আল্লাহ জানেন তোমরা যা জান না। এছাড়াও তিনি তোমাদের দিয়েছেন এক সদ্য বিজয়”-(সূরা ফাতহ:২৭)।

এ থেকে জানা গেল যে, মহানবী (স) কে স্বপ্নের মাধ্যমে মক্কা মুআজ্জমায় প্রবেশের এই পন্থা বলে দেয়া হয়েছে যে, তিনি তার সাহাবীদের নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন, কাফেররা বাধা দেবে এবং শেষে সন্ধি স্থাপিত হবে-যার ফলে পরবর্তী বছল উমরা করার সুযোগ পাওয়া যাবে এবং ভবিষ্যত বিজয়ের পথও খলে যাবে। এটা কি কুরআন মজীদ ছাড়াও ভিন্নতর পন্থায় পথনির্দেশনা লাভের সুস্পষ্ট প্রমাণ নয়?

৩. মহানবী (স) তার স্ত্রীদের কোন একজনের নিকট একটি একান্ত গোপন কাথা বলেন। তিনি (স্ত্রী) তা অন্যদের নিকট ফাঁস করে দেন। মহানবী (স) এজন্য তাকে অীভযুক্ত করলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনি কিভাবে জানতে পারলেন আমি অন্যদের নিকট একথা বলে দিয়েছি? মহানবী (স) জওয়াব দেন, আমাকে মহাজ্ঞানী ও সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত সত্তা (আল্লাহ) অবহিত করেছে।

“যখন নবী তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিল, অতপর সে তা যখন অন্যদের বলে দিয়েছিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তখন নবী এই বিষয়ে কিছু ব্যক্ত করল এবং কিছু অব্যক্ত রাখল, যখন নবী তা তার সেই স্ত্রীকে জানালো তখন সে বলল, কে আপনাকে তা অবহিত করল? নবী বলল, আমাকে তিনি অবহিত করেছেন-যিনি সর্বজ্ঞ, সম্যক অবগত”-(সূরা তাহরীম:৩)।

এখন বলুল, কুরআন মজীদে সেই আয়াতটি কোথায় যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মহানবী (স) কে অবহিত করেছিলেন যে. তোমার স্ত্রী তোমার গোপন কথা অন্যদের নিকট ফাস করে দিয়েছে? যদি এরূপ কোন আয়াত না থেকে থাকে তবে তি প্রমানিত হল না যে, আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদ ছাড়াও মহানবী (স) এর নিকট পয়গান পাঠাতেন?

৪. মহানবী (স) এর মুখডাকা পুত্র যায়েদ ইবনে হারিসা (রা) নিজ স্ত্রীকে তালাক দেন। অতপর মহানবী (স) তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিবাহ করেন এটাকে কেন্দ্র করে মুনাফিক ও কাফেররা মহানবী (স) এর বিরূদ্ধে প্রপ্রাগান্ডার এক ভয়ংকর তুফান উত্থিত তরে এবং অভিযোগের পাহাড় দাঁড় করায়। আল্লাহ তাআলা এই অভিযোগের জবাব সূরা আহযাবের একটি পূর্ণ রুকুতে দান করেন এবং এই প্রসঙ্গে লোকদের বলেন, আমার নবী স্বয়ং এই বিবাহ করেননি, বরং আমার নির্দেশে করেছেন।

“অতপর যায়েদ যখন তার (যয়নবের) সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে তাদের বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ননা হয়”-(সূরা আহযাব:৩৭)।

এ আয়াতে তো উপরোক্ত ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘটনার পূর্বে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মহানবী (স) কে হুকুম করা হয়েছিল,তুমি যায়েদের তালাকপ্রাপ্তাকে বিবাহ কর, তা কুরআনের কোথায় উল্লেখ আছে?

৫. মহানবী (স) বানূ নাদীর গোত্রের একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভংগে অতিষ্ঠ হয়ে মদীনার সংলগ্ন তাদের বসতি এলাকায় সৈন্য পরিচালনা করেন এবং অবরোধ চলাকালীন ইসলামী ফৌজ আশপাশের বাগানসমূহের অনেক গাছগাছালী কেটে ফেলেন যাতে আক্রমণের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যায়। বিরুদ্ধবাদীরা অপপ্রচার চালায় যে, বাগানসমূহ বিরান করে এবং ফলবান বৃক্ষকেটে ফেলে মুসলমানরা জমীনের বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এর প্রতিবাদে আল্লাহ তাআলা বলেন:

“তোমরা খেজুর গাছগুলো কেটেছ এবং যেগুলো কান্ডের উপর স্থির রেখে দিয়েছ তা তো আল্লহার-ই অনুমতিক্রমে-”(সূরা হাশর:৫)।

আপনি কি বলতে পারেন-এই অনুমতি কুরআন মজীদের কোন আয়াতে নাযিল হয়েছিল?

৬. বদরের যুদ্ধ শেষে গণীমতের মাল বন্টনের প্রশ্ন দেখা দিলে সূরা আল-আনফাল নাযিল হয় এবং তাতে গোটা যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা এই পর্যালোচনার সূত্রপাত করেন সেই সময় থেকে যখন মহানবী (স) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে রওনা হয়ে যান এবং এ প্রসঙ্গে মুসলমানদের সম্বোধন করে বলেন:

“এবং আল্লাহ তাআলা যখন তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে-দুই দলের (ব্যবসায়ী কাফেলা এবংকুরাইশ সেনাবাহিনী) চাচ্ছিলে নিরস্ত্র দলটি (অর্থাৎ ব্যবসায়ী কাফেলা) তোমাদের আয়ত্তাধীন হোক। আর আল্লাহ চাচ্ছিলেন যে, তিনি সত্যকে তার বাণী দ্ধারা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং কাফেরদের নির্মূল করেন-”(সূরা আনফাল:৭)।

এখন আপনি কি সমগ্র কুরআন মজীদ থেকে এমন কোন আয়াতের উল্লেখ করতে পারেন যার মধ্যে আল্লাহ তাআলা এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মদীনা থেকে বদরের দিকে অভিযাত্রীগণ! আমি দুই দলের এক দল তোমাদের আয়াত্তাধীন করে দেব?

৭. ঐ বদর যুদ্ধের পর্যালোচনা করতে গিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে ইরশাদ হচ্ছে;

“তোমরা যখন তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলে তখন তিনি তা কবুল করেছিলেন এবং বলেছিলেন-আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য একাধারে এক হাজার ফেরেশতা পাঠাব”-(সূরা আনফাল:৯)।

আপনি কি বলতে পারেন যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুসলমানদের দোয়ার এই উত্তর কুরআন মজীদের কোন আয়াতে নাযিল হয়েছিল?

আপনি মাত্র একটি উদাহরণ চাচ্ছিলেন। আমি আপনার সামনে কুরআন মজীদে থেকে সাতটি উদাহরণ পেশ করলাম যার সাহায্যে প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (স) এর নিকট কুরআন মজীদ ছাড়াও ওহী আসৎ। এরপর আরো আলোচনা সূত্রপাত করার পূর্বে আমি দেখতে চাই যে, আপনি সত্যের সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত কি না?

তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ও নভেম্বর ১৯৬০ খৃ.।

বিনীত

আবুল আ‘লা

সুন্নাত সম্পর্কে আরও কতিপয় প্রশ্ন

[পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে ডক্টর আবদুল ওযাদূদ সাহেব ও গ্রন্থারের মধ্যেকার পত্রালাপ পাঠকগণের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাহেবের আরও একটি পত্র হস্তগত হয়েছে, যা গ্রন্থকারের উত্তরসহ নিম্নেউল্লেখ করা গেলো।]

ডক্টর সাহেবের চিঠি

মুহতারাম মাওলানা,

আসসালামু আলাইকুম। আমার ১৭ আগস্টের চিঠি আপনার প্রদত্ত জবাবসহ তরজমানুল কুরআন পত্রিকার অক্টোবর ও নভেম্বর সংখ্যায় ডাক মারফত হস্তগত হয়েছে। এই উত্তরমালার শেষ ভাগে আপনি দেখতে চান যে, আমি সত্যের সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত আছি কি না।

মুহতারাম! একজন সাচ্চা মুসলমানের মত আমি সব সময় সত্যের সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত। কিন্তু যেখানে আমি সব সময় সত্যের সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত। কিন্তু যেখানে সত্য বর্তমান নেই, বরং কোন মূর্তির সামনে অবনত হওয়া উদ্দেশ্য , সেখানে আমি অন্তত মাথা নত করতে পারি না। কারণ ব্যক্তিপূজা আমার আদর্শ নয়। আমি আপনাকে বারবার এজন্য কষ্ট দিচ্ছি যে, আলোচ্য বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাক এবং একই দেশে বসবাসকারী এবং একই মনযিলে মাকসূদের দিকে ধাবিত ব্যক্তিগণ পৃথক পৃথক পথ অবলম্বন না করুক। আর আপনি তো কেবল বাকচাতুর্য ও আবেগের সমাবেশে ঘটিয়ে কলমের সমস্ত শক্তি শেষ করে দিয়েছেন এ উদ্দেশ্যে যে, আমি অবনত হয়ে যাব। এত দীর্ঘ জবাব তৈরী করতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনাকে যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আপনার উত্তর পাঠে আমার মধ্যে আরও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

আপনি যর্থাথই বলেছেন যে, আমার অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কুরআন অধ্যয়নও অন্তর্ভুক্ত এবং আপনি আপনার জীবন এর এক একটি শব্দের উপর চিন্তা ভাবনায় ও তার অন্তর্নিহিত ভাব উদঘটনে ব্যয় করেছেন। কিন্তু আমাকে দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে যে, আপনার জীবনভর এই পরিশ্রম নিজের জন্য হয়ে থাকলে আমার কোন কাথা নেই। কিন্তু মুসলিম সর্বসাধারণের জন্য তা সামান্য পরিমাণও লাভজনক প্রমানিত হতে পারে না। আপনার চিঠিতে অনেকগুলো দ্ব্যর্থবোধক কথা রয়েছে। আবার কতগুলো কথা কুরআনের পরিপন্থী। আর কতগুলো কথার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আপনি কুরআনের অর্থ ও তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য বিস্তারিত জবাবের প্রয়োজন রয়েছে। ইনশাআল্লাহুল আযীয প্রথম অবসরেই তার পূণাঙ্গ জবাব তৈরী করব। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এমন দুই একটি কথা রয়েছে যা সুস্পষ্ট হওয়ার একান্ত প্রয়োজন। এই সময় আমি কেবল সেগুলোই পেশ করতে চই।

আমি মনে করি, গোটা আলোচনা ঘুরেফিরে একটি স্থানেই এসে জড়ো হয়েছে যে, আল্লাহর তরফ থেকে রসূলুল্লাহ (স) এর উপর যে ওহী নাযিল হয়েছে তার সবটাই কি কুরআন মজীদের আছে না বাইরে অন্য কোথাও আছে? আপনার দাবী এই যে, কুরআন ব্যতীতও ওহীর একটি অংশ রয়েছে এই প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

১. ঈমান আনা ও আনুগত্য করার ক্ষেত্রে উভয় প্রকার ওহীর মর্যাদা কি সমান?

২. কুরআন মজীদ যেখানে (“যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে”) বলেছে তার দ্বারা কি শুধু কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, না এর মধ্যে ওহীর উল্লেখিত প্রধান অংশও অন্তর্ভূক্ত আছে?

৩. ওহীর এই দ্বিতীয় অংশ কোথায়? কুরানের মত তার সংরক্ষণের দায়িত্বও কি আল্লাহ তাআলা নিয়েছেন?

৪. কুরআনের কোন স্থানে আরবী শব্দের পরিবর্তে একই অর্থ প্রকাশক ভিন্ন শব্দ স্থাপন করলে তাকে কি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত মনে করা হবে? ওহীর উল্লেখিত দ্বিতীয় অংশের অবস্থাও কি তাই?

৫. কতিপয় লোক বলে যে, মহানবী (স) নবুওয়াত লাভের পর থেকে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত যা কিছু করেছেন তা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহী। আপনি কি তাদের সাথেও একমত? যদি একমত না হন তবে এ ক্ষেত্রে আপনার আকীদা বিশ্বাস কি?

৬. আপনি যদি মনে করেন যে, মহানবী (স) এর কতিপয় বাণী ওহীর সমষ্টি আর কতগুলো বাণী ওহী ছিল না তবে আপনি কি বলবেন যে, মহানবী (স) এর যেসব বাণী ওহী তার সংকলন কোথায় আছে?

অন্তত তার যেসব বাণী ওহী ছিল না-মুসলমানদের ঈমান ও আনুগত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তার মর্যাদা কি?

৭. কোন ব্যক্তি যদি কুরআন পাকের আয়াত সম্পর্কে বলে, “তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত নয়,” তবে আপনি কি এ কথার সাথ একমত হবেন যে, সে ইসলামের গন্ডি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যায়? যদি কোন ব্যক্তি হাদীসের বর্তমান সংগ্রহসমূহের কোন হাদীস সম্পর্কে বলে যে, তা আল্লাহর ওহী নয় তবে সেও কি ইসলামের গন্ডি থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে?

৮. রসূলুল্লাহ (স) দীন ইসলামের বিধানসমূহ কার্যকর করার জন্য যেসব পন্থার প্রস্তাব করেছেন, কোন যুগের চাহিদা ও সার্বিক কল্যাণের দিক থেকে তার আংশিক পরিবর্তন বা প্রত্যাখ্যান করা যায় কি না? কুরআনের বিধানের ক্ষেত্রেও এরূপ আংশিক পরিবর্তন বা প্রত্যাখ্যান করা যায় কি না?

ওয়াসসালাম।

বিনীত

আবদুল ওয়াদুদ

গ্রন্থকারের জওয়াব

মুহতারামী ও মুকাররমী

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। ৫ নবেম্বর, ১৯৬০ খৃ. আপনার পত্র পেয়েছি। কিছুটা স্বাস্থ্যগত কারণে এবং কিছুটা ব্যস্ততার কারণে উত্তরদানে বিলম্ব হলো। এজন্য ওজর পেশ করছি।

আপনি পূর্বের ন্যায় আবার একই পন্থা অবলম্বন করেছেন এবং একটি আলোচনা পরিষ্কার করে আসা থেকে গা বাচিয়ে পুনরায় কতগুলো নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। অথচ প্রশ্ন উত্থাপন করার পূর্বে আপনার বলা দরকার ছিল যে, পূর্বের চিঠিতে আমি আপনার দশটি বিষয়ের উপর যে আলোচনাকরেছি তার মধ্যে কোন জিনিসটিমানেন আর কোন জিনিসটি মানেন না এবং যে জিনিসটি মানেন না তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য আপনার নিকট কি যুক্তিপ্রমাণ আছে। আমার সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট প্রশ্নবলীরও কোন উত্তর দেয়া আপনার উচিত ছিল, যা আমি আমার চিঠিতে আপনাকে করেছি। কিন্তু এসব প্রশ্নের মোকাবিলা করা থেকে পশ্চাতপদ হয়ে এখন আবার নতুন করে আপনি কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছেন এবং আমার নিকট তার উত্তর দাবী করছেন। এটা শেষ পর্যন্ত আলোচনার কি ধরনের পন্থা? আমার পূর্বেকার চিঠি সম্পর্কে আপনার পর্যালোচনা কিছুটা অদ্ভুত প্রকৃতির। এই আলোচনায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে এবং যেসব মৌলিক বিষয়ের উপর আমি আলোকপাত করেছি তার সবগুলো উপেক্ষা করে সর্বপ্রথম আপনার দৃষ্টি পড়েছে আমার সর্বশেষ বাক্যের উপর এবং তার জওয়াবে আপনি বলছেন যে, “আমি সত্যের সমানে মাথা নত করতে প্রস্তুত কিন্তু প্রতিমার সামনে আমি অবনত হতে পারি না এবং ব্যক্তিপূজা আমার আদর্শ নয়।” প্রশ্ন হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সেই “প্রতিমাটি” কি যার সামনে আপনাকে অবনত হতে বলা হয়েছিল এবং কোন ব্যক্তিপূজার দাওয়াত আপনাকে দেয়া হয়েছিল?

আমি তো কুরআন মজীদের সুস্পষ্ট আয়তের সাহায্যে প্রমাণ করেছি যে, রসূলুল্লাহ (স) আল্লাহ তাআলার নিযুক্ত রাষ্ট্রনায়ক, আইন প্রণেতা, বিচারক, শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক এবং আল্লাহ তাআলারই নির্দেশের ভিত্তিতে তার আনুগত্য ও অনুসরণ প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির উপর ফরজ। এই সত্যের সামনে অবনত হওয়ার জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করেছেলাম। এর উপর আপনার উপরোক্ত বক্তব্য সন্দেহের সৃষ্টি করে যে, সম্ভবত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণই সেই “প্রতিমা” যার সামনে অবনত হতে আপনি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন এবং এটাই সেই “ব্যক্তিত্বপূজা” যার প্রতি আপনি রুষ্ট। আমার এই সন্দেহ যদি সঠিক হয় তবে আমি আবেদন করবো যে, আপনি মূলত ব্যক্তিত্ব পূজা প্রত্যাখ্যান করেননি, বরং আল্লাহর পূজাকে অস্বীকার করছেন এবং একটি প্রকান্ড প্রতিমা আপনার নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে আছে যার সামনে আপনিসিজদাবনত। যেখানে আনুগত্যের মস্তক অবনত করার জন্য আল্লাহ তাআলা হুকুম দিয়েছে, সেখানে অবনত হওয়াটা প্রতিমার সামনে অবনত হওয়া নয়, বরং আল্লাহর সামনেই অবনত হওয়া এবং পূজা নয় বরং আল্লাহর উপাসনা। অবশ্য যে ব্যক্তি তা অস্কীকার করে সে মূলত আল্লাহর সামনে অবনত হওয়ার পরিবর্তে নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিমার সামনে অবনত হয়।

তাছাড়া আপনি আমার সমস্ত যুক্তি প্রমাণ এমনভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, “তুমি বাকচাতুর্য ও আবেগের সমাহারে কলমের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছ।” আপনি ইচ্ছা করলে সন্তুষ্ট চিত্তে এইমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু এর মীমাংসা এখন হাজারো পাঠক করবেন যে, আমি যুক্তিপ্রমাণ পেশ করেছি না শুধু বাকচাতুর্য প্রদর্শন করেছি? আর তারা এ বিচার করবেন যে, আপনি হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছেন নাকি সত্যের উপাসনা করছেন?

আপনি আপনার দুর্ভাগ্যের জন্য আক্ষেপ করছেন যে, আমার উত্তরমালায় আপনার মনের জটিলতা ও সংশয়-সন্দেহ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য আমারও আক্ষেপ হয়। কিন্তু এই সন্দেহ ও জটিলতার উৎস বাইরে কোথায় নয়, আপনার নিজের অভ্যন্তরেই বিদ্যমান। আপনি এই পত্রালাপ বাস্তবিকই যদি বক্তব্য বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার জন্য করে থাকতেন তবে সোজা কথা সোজাভাবে আপনার বুঝে এসে যেত। কিন্তু আপনার পরিকল্পনা তো ছিল ভিন্ন কিছু। আপনার প্রথম দিককার প্রশ্নাবলী আমার নিকট পাঠানোর সাথে সাথে আপনি তা আরও কতিপয় আলেমের নিকট এই আশায় প্রেরণ করেছেন যে, তাদের নিকট থেকে ভিন্নতর জওয়াব পাওয়া যাবে।১ অতপর তার সবগুলো প্রকাশ করে এই প্রোপাগান্ডা করা যাবে যে, সুন্নাতের ব্যাপারে একমত নন। এই একই কৌশলের একটি দৃষ্টান্ত আমরা মুনীর রিপোর্টও দেখতে পাই। এখন আমার উত্তরমালার মাধ্যমে আপনার এই পরিকল্পনা আপনার  ঘাড়েই গিয়ে উল্টে পড়েছে। তাই আমি আপনাকে বুঝানোর যতই চেষ্টা করি না কেন আপনার মনের জটিলতা ও সংশয় বৃদ্ধিই পেতে থাকবে। এই ধরনের জটিলতার শেষ পর্যন্ত আমি কি চিকিৎসা করতে পারি? এর চিকিৎসা তো আপনার নিজের হাতেই রয়েছে। সত্য কথা বুঝার এবং তা মেনে নেয়ার অকৃত্রিম আকাংখা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করুন এবং একটি বিশেষ চিন্তাধারায় সপক্ষে প্রচাণার উদ্দেশ্যে অস্ত্র সরবসাহেরও চিন্তা ত্যাগ করুণ। এরপর ইনশা আল্লাহ প্রতিটি যুক্তিসংগত কথা সহজে আপনার বুঝে এসে যাবে।

অতপর আপনি একটি ভ্রান্ত দাবী আমার প্রতি আরোপ করেছেন যে, “আমি আমার জীবন কুরআনের এক একটি শব্দ নিয়ে চিন্তা করে এবং তার অন্তর্নিহিত ভাবধারা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য ব্যয় করে দিয়েছি।” অথচ আমার সম্পর্কে কখনও আমি এরূপ দাবী করিনি। আমার পূর্বেকার চিঠিতে আমি যা বলেছি তা তো এই ছিল যে, ইসলামের ইতিহাসে এমন অসংখ্য ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছে যার দৃষ্টান্ত আজও পাওয়া যায়-যার নিজেদের জীবন এ কাজে ব্যয় করেছেন। উপরোক্ত কথা থেকে আপনি কিভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌছলেন যে, আমি নিজের সম্পর্কে এই দাবী করছি?

এতটা অপ্রসঙ্গিক কথা বলার পর আপনি আমার চিঠির মূল আলোচনা সম্পর্কে শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলাই যথেষ্ট মনে করেছেন যে, “আপনার চিঠির মধ্যে যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে যা থেকে জানা যায় যে, আপনি সঠিকভাবে কুরআনের তাৎপর্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।” প্রশ্ন হচ্ছে আপনার এ বক্তব্যের চেয়ে

১. পরে আমি মাওলানা দাউদ গযনবী ও মুফতী সিয়াহুদ্দীন কাকাখীল এবং আরও কয়েকজন লোকের মাধ্যমে জানতে পারি যে, আপনি তাদের নিকটও একই প্রশ্নমালা পঠিয়েছেন।]

অধিক দ্ব্যর্থবোধক কোন কথা হতে পারে কি? আপনি যদি কিছু দেখিয়ে দিতেন যে, আমার ঐ চিঠিতে কি দ্ব্যর্থবোধক কথা ছিল, কোন জিনিস কুরআনের পরিপন্থী ছিল এবং কুরআনের কোন আয়াতের সঠিক অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি? এই সমস্ত কথাই আপনি ভবিষ্যতের অবসরের জন্য তুলে রেখে দিয়েছেন এবং এখনকার হাতের সময় কতগুলো নতুন প্রশ্ন রচনায় ব্যয় করেছেন। অথচ এই সময়টা পূর্বেকার প্রশ্নবলীর উপর বক্তব্য রাখতে ব্যবহার  করা উচিত ছিল।

এই পত্র বিনিময়ে যদি শুধুমাত্র আপনাকে “কথা বুঝিয়ে দেয়া” আমার উদ্দেশ্য হত তবে আপনার পক্ষ থেকে “কথা বুঝার” চেষ্টার এই নমুনা দেখে আমি ভবিষ্যতের জন্য অপারগতা পেশ করতাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি আপনাকে উপলক্ষ করে অন্যান্য বহু রোগীর চিকিৎসার চিন্তা করছি, যাদের মনমগজকে ঐ ধরনের প্রশ্নাবলী নিক্ষেপ করে বিভ্রান্ত করার চেষ্ট চলছে। ইনশাআল্লাহ এজন্য আমি আপনার এই সদ্য প্রাপ্ত প্রশ্নগুলোরও  জবাবও দেব। এর ফলে যাদের মনে এরূপ পথভ্রষ্টতার জন্য এখনও হঠকারিতা ও জেদ সৃষ্টি হয়নি তারা যেন সুন্নাতের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি দিক উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এবং তাদেরকে সহজে পথভ্রষ্ট করা না যায়।

ওহীর উপর ঈমান আনার কারণ

আপনার প্রথম প্রশ্ন হলো, “ওহীর সাথে ঈমান ও আনুগত্যের যতদূর সম্পর্ক রয়েছে-এ ক্ষেত্রে ওহীর উভয় অংশের মর্যাদা কি সমান?”

এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কোন ব্যক্তির বুঝে উত্তমরূপে আসতে পারে না যতক্ষণ সে প্রথমে হৃদয়ঙ্গম না করবে যে, ওহীর উপর ঈমান আনয়ন এবং তার অনুসরণের আসল ভিত্তি কি? সুস্পষ্ট কথা হলো, ওহী যে ধরনেরই হোক না কেন তা সরাসরি আমাদের নিকট আসেনি যে, আমরা স্বয়ং তা আল্লাহর তরফ থেকে নাযিল হওয়ার বিষয়টি জানতে পরি এবং তার অনুসরণ করতে পারি। তা তো আমরা রসূলুল্লাহ (স) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছি এবং তিনিই আমাদের বলেছেন যে, এই হেদায়াত বাণী আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নিকট এসেছে। ওহীর (আল্লাহর তরফ থেকে আসার) উপর ঈমান আনার পূর্বে আমরা রসূলের উপর ঈমান আনি এবং তাকে আল্লাহ তাআলার সত্য বণীবাহক বলে স্বীকার করি। আমরা রসূলের বর্ণনার উপর আস্থা স্থাপন করার পরই তার ওহীকে আল্লাহর তরফ থেকে পাঠানো ওহী হিসাবে মেনে নেয়ার এবং তার অনুসরণ করার পালা আসে। অতএব আসল জিনিস ওহীর উপর ঈমান নয়, বরং রসূলুল্লাহ (স) এর উপর ঈমান এবং তাকে সত্যবদী বলে মেনে নেয়া। তাকে সত্যবাদী বলে মেনে নেয়ার ফলশ্রুতিতে আমরা ওহীকে আল্লাহ প্রদত্ত ওহী বলে মেনে নেই। অন্য কথায় বিষয়টি এভাবে বলা যেতে পারে যে, রসূলের রিসালাতের উপর ঈমান আনার কারণ কুরআন নয়, বরং কুরআনের উপর আমদের ঈমানের কারণ রসূলের রিসালাতের উপর ঈমান। ঘটনাসমূহের ক্রমবিন্যাস এই নয় যে, প্রথমে আমাদের নিকট কুরআন এসেছে. তা আমাদেরকে মুহাম্মাদুর রসলুল্লাহ (স) এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে একং এর বক্তব্য সঠিক মনে করে আমরা রসূলুল্লাহ (স) কে আল্লাহর রসূল হিসাবে মেনে নিয়েছি। বরং ঘটনার সঠিক ক্রমবিন্যাস এই যে, প্রথমে মুহাম্মদ (স) এসে রিসালাতের দাবী পেশ করেছেন অতপর যে ব্যক্তিই তাকে সত্যবাদী রসূল বলে মেনে নিয়েছে সে তার এই কথাও সত্য সঠিক বলে মেনে নিয়েছে যে, এই যে কুরআন তিনি পেশ করছেন তা মুহাম্মদ (স) এর কালাম নয়, বরং আল্লাহ তাআলার কালাম নয়, বরং আল্লাহ তাআলার কালাম।

এটা এমন একটি স্বতঃসিদ্ধ মর্যাদা যা কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে না। এই পজিশন যদি আপনি স্বীকার করেন তবে নিজ স্থানে চিন্তা করে দেখুন, যে রসূলের বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে আমরা কুরআনকে ওহী হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছি, সেই রসূলই যদি আমাদের বলেন যে, ুতিনি কুরআন ছাড়াও ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে হেদায়াত ও বিধান লাভ করে থাকেন তবে তা বিশ্বাস না করার শেষ পর্যন্ত কি কারণ থাকতে পারে? যখন রিসালাতের প্রতি ঈমান আনয়ন-ই ওহীর উপর ঈমান আনয়নের মূল ভিত্তি তখন আনুগত্যকারীর জন্য এতে কি পার্থক্য সৃষ্টি হয় যে, রসূল (স) আল্লাহর আদেশ কুরআনের কোন আয়াতের আকারে আমাদের নিকট পৌছে দেন অথবা কোন নির্দেশ বা কাজের আকারে? দৃষ্টন্তস্বরূপ পাঁচ ওয়াক্ত নামায সর্বাবস্থায় আমাদের উপর ফরজ এবং কুরআনের কোন আয়াতে “হে মুসলমানগন! তোমাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নাময ফরজ করা হয়েছে” এরূপা নির্দেশ না আসা সত্ত্বেও উম্মাত তা ফরজ হিসাবে মান্য করে। প্রশ্ন হলো কুরআন মজীদে যদি এই হুকুমও এসে যেত তবে এর ফরজিয়াতের মধ্যে এবং এর গুরুত্বের মধ্যে কি শ্রীবৃদ্ধি ঘটতো? তখনও তা ঠিক সেভাবেই ফরজ হত যেভাবে এখন রসূলুল্লাহ (স) এর বক্তব্যের মাধ্যমে ফরজ আছে।

‘মা আনযালাল্লাহু’ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো “কুরআন মজীদ যেখানে     (যা তোমার উপর নাযিল করা হয়েছে) বলেছে, তার দ্বারা কি শুধুমাত্র কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, না তার মধ্যে ওহীর উল্লেখিত প্রধান অংশও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে? এর জওয়াব এই যে, কুরআন মজীদে যেখানে “নাযিল করা”- সাথে “কিতাব” অথবা “যিকর” অথবা “কুরআন” ইত্যাদি শব্দ এসেছে কেবলমাত্র সেখানে    (আল্লাহ যা নাযিল করেছেন) এর দ্বারা কুরআন মজীদ বুঝঅনো হয়েছে। আর যেসব স্থানে কোন সম্বন্ধপদ উক্ত বাক্যকে কুরআনের জন্য নির্দিষ্ট করে না সেখানে উক্ত বাক্য দ্বারা আমরা মহানবী (স) এর নিকট থেকে যেসব শিক্ষা ও হেদায়াত লাভ করেছি সেগুলো সবই বুঝায়, তা কুরআনের আয়াতের আকারেই হোক অথবা অন্য কোন আকারে। এর প্রমাণ স্বয়ং কুরআন মজীদেই বিদ্যমান রয়েছে। কুরআন আমাদের বলে যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে  মহানবী (স) এর উপর শুধুমত্র কুরআনই নাযিল হয়নি, বরং আরো কিছু নাযিল হয়েছে। সূরা নিসার ইরশাদ হচ্ছে:

“আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাহ নাযিল করেছেন এবং তুমি যা জানতে না তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন”- (আয়াত নং ১১৩)।

অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত আয়াত সূরা বাকারায়ও রয়েছে। যেমন:

“এবং তোমরা স্মরণ কর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতসমূহের এবং তিনি তোমাদের উপর কিতাব ও হিকমাত থেকে যা নাযিল করেছেন, যার সাহায্যে তিনি তোমাদের উপদেশ দেন-”(আয়াত নং১৩১)।

এই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে সূরা আহযাবে, যেখানে মহানবী (স) এর ণকে উপদেশ দান করা হয়েছে।

“আল্লাহর আয়াতসমূহ ও জ্ঞানের কথা-যা তোমাদের ঘরসমূহের পঠিত হয় তা তোমরা স্মরণ রাখবে”-(আয়াত নং ৩৪)।

উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, মহানবী (স) এর উপর কিতাব ছাড়াও একটি জিনিস “হিকমাহ” ও নাযিল করা হয়েছিল যা শিক্ষা তিনি লোকদের দান করতেন। এর অর্থ এছাড়া আর কি হতে পারে যে, মহানবী (স) যে বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা সহকারে কুরআন মজীদের পরিকল্পনা বস্তবায়িত করার জন্য কাজ করতেন এবং নেতৃত্ব ও পথনির্দেশের দায়িত্ব পালন করতেন তা শুধুমাত্র তাঁর স্বাধীন ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং তাও আল্লাহ তাআলা তার উপর নাযিল করেন। অনন্তর তা এমন কোন জিনিস ছিল যা স্বয়ং তিনিই ব্যবহার করতেন না, বরং লোকদেরও শিক্ষা দিতেন।

প্রকাশ থাকে যে,. এই শিখানোর কাজ কথার আকারেও হতে পারে কিংবা বাস্তব কর্মের আকারেও হতে পারে। তাই উম্মাত মহানবী (স) এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত দুটি জিনিস লাভ করেছিল: একটি কিতাব এবং দ্বিতীয়টি হিকমাহ (কর্মকৌশল)। আর এই হিকমাহ তারা লাভ করেছে তার বাণীসমূহের আকারেও এবং বাস্তব কার্যবলীর আকারেও।

পুনশ্চ কুরআন মজীদ আরও একটি জিনিসের কথা উল্লেখ করেছে যা আল্লাহ তাআলা কিতাবের সাথে নাযিল করেছেন।

“আল্লাহ-ই নাযিল করেছেন সত্যসহ কিতাব ও তুলাদন্ড”-(সূরা শূরা: ১৭)।

“নিশ্চয়ই আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমানাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে কিতাব ও তুলাদন্ড দিয়েছি যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে”-(সূরা হাদীদ:২৫)।

এই মীযান (তুলাদন্ড) যা কিতাবের সাথে নাযিল করা হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবেই দোকানে দোকানে রক্ষিত দাড়িপাল্লা নয়, বরং এর দ্বারা এমন কোন জিনিস বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ তাআলার হেদায়াত অনুযায়ী মানবীয় জীবনে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে, তার বিকৃতিকে পরিশুদ্ধ করে দেয় এবং বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতা দূরীভূত করে মানব চরিত্র, আচার-আচরণ ও আদান-প্রদানকে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠা করে। কিতাবের সাথে এই জিনিস নবী-রসূলগণের উপর নাযিল করার পরিষ্কার অর্থ এই যে, আল্লাহ তাআলা নবীগণকে বিশেষভাবে নিজের পক্ষ থেকে পথ প্রর্দশনের এমন যোগ্যতা দান করেছিলেন যার সাহায্যে তারা আল্লাহর কিতাবের লক্ষ্য অনুযায়ী ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্টে ন্যয়ানুগ ব্যবস্থা কায়েম করেছেন। এই কাজ তাদের ব্যক্তিগত ইজতিহাদী ক্ষমতা ও রায়ের উপর সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত তুলাদন্ডের সাহায্যে মেপে মেপে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন যে, মানব জীবনের বিভিন্ন উপাদানের কোন অংশের কত ওজন হওয়া উচিত।

পুনশ্চ কুরআন মজীদ একটি তৃতীয় জিনিসের খবর দেয় যা কিতাবের অতিরিক্ত নাযিল করা হয়েছে।

“অতএব তোমরা ঈমান আন আল্লাহ ও তার রসূলের উপর এবং সেই নূরের উপর যা আমি নাযিল করেছে” (সূরা তাগাবুন:৮)।

“অতএব যারা এই রসূলের প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করে তারই সফলকাম”(সূরা আরাফ:: ১৫৭)।

“আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের নিকট এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব এসে গেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় এর দ্বারা তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন” (সূরা মাইদা: ১৫-১৬)।

উল্লেখিত আয়াতসমূহে যে নূরের কথা বলা হয়েছে তা ছিল কিতাব থেকে স্বতন্ত্র একটি জিনিস যেমন তৃতীয় আয়াতের শব্দসমূহ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে। এই নূরও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার রসূলের উপর নাযিল করা হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা মহানবী (স) কে যে জ্ঞান বুদ্ধিবিবেক,প্রজ্ঞা দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা দান করেছিলেন, যার সাহায্যে তিনি জীবনের চলার পথসমূহের মধ্যে সঠিক ও ভ্রান্ত পথ চিহ্নিত করেছেন, জীবন সমস্যার সমাধান পেশ করেছেন এবং যার আলোকে কাজ করে তিনি নৈতিকতা ও আধ্যত্বিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি এবং আইন ও রাজনীতির জগতে মহান বিপ্লব সাধন করেছেন-এই নূর বলতে স্পষ্টতই সেই সব শক্তিকেই বুঝায়। এটা কারো ব্যক্তিগত কাজ ছিল না যে, সে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে নিজের বুঝ অনুযায়ী চেষ্ট সাধনা করে থাকবে। বরং এটা ছিল আল্লাহ তাআলার সেই মহান প্রতিনিধির কাজ যিনি কিতাব লাভের সাথে সাথে সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে জ্ঞান ও বিচক্ষণতার নূরও লাভ করেছিলেন।

উপরোক্ত আলোচনার পর একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরআন মজীদ যখন আমাদেরকে অন্য সব জিনিস ত্যাগ করে শুধুমাত্র (আল্লাহ যা নাযিল করেছেন)-এর অনুসরণের নির্দেশ দেয়া তখন এর অর্থ কেবলমাত্র কুরআনেরই অনুসরণ বুঝায় না, বরং সেই নূর, হিকমাহও মীযানেরও অনুসরণ করা বুঝায় যা কুরআনের সাথে মহানবী (স) এর উপর নাযিল করা হয়েছিল এবং যার প্রকাশ অবশ্যম্ভাবীরূপে মহানবী (স) এর জীবনাচার নৈতিকতা, কাজ ও কর্মের মধ্যেই হয়েছিল। তাই কুরআন মজীদ কোথাও বলে, (আল্লাহ যা নাযিল করেছেন )এর আনুগত্য কর ( যেমন: ৩. ৩১, ৩৩.২১ এবং ৭.১৫৬ নং আয়াত)। তা যদি স্বতন্ত্র দুটি জিনিস হত তাহলে একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআনের হেদায়াত পরস্পর বিপরীত হয়ে যেত।

সুন্নাত কোথায় আছে?

আপনার তৃতীয় প্রশ্ন এই যে, “ওহীর দ্বিতীয় অংশ কোথায়? কুরআনের মত তার সংরক্ষণের দায়িত্বও কি আল্লাহ তাআলা নিয়েছেন?”

এই প্রশ্নের দুটি ভিন্ন ভিন্ন অংশ রয়েছে। প্রথশ অংশ  “ওহীর এই দ্বিতীয় অংশ কোথায়?” হুবহু এই প্রশ্নই আপনি পূর্বে আমাকে করেছিলেন এবং আমিও তার বিস্তারিত উত্তর দিয়েছি। কিন্তু আপনি তা পুনর্বার এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন যেন আপানি মূলত এর কোন উত্তরই পাননি। অনুগ্রহপূর্বক আপনার প্রথম চিঠি তুলে নিয়ে দেখুন, যার মধ্যে দুই নম্বর প্রশ্নের বিষয়বস্তু তাই ছিল যা আপনার বর্তমান প্রশ্নের বিষয়বস্তু। অতপর আমার দ্বিতীয় পত্রখানী তুলে পড়ে দেখুন যার মধ্যে আমি আপনাকে এই প্রশ্নের বিস্তারিত জওয়াব দিয়েছি। এখন আপনার উক্ত প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করা এবং আমার পূর্বেকার জওয়াব সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার অর্থ এই দাড়ায় যে, আপনি হয় আপনার কল্পনার জগতে হারিয়ে গেছেন এবং অন্যের কথা আপনার মগজ পর্যন্ত পৌছার কোন পথ পায় না, অথবা আপনি এই বিতর্ক শুধুমাত্র বিতর্ক হিসাবেই করেছেন।

সুন্নাতের হেফাজতও কি আল্লাহ করেছেন?

আপনার এই প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের জওয়াব শুনার পূর্বে এ কথার উপর সামান্য চিন্তা করুন যে, কুরআন মজীদের হেফাজতের যে দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেছেন তা কি তিনি সরাসরি হেফাজত করছেন না মানুষের মাধ্যমে হেফাজত করছেন? এর উত্তর আপনি এছাড়া আর কিছুই দিতে পারবেন না যে, তার হেফাজতের জন্য মানুষকেই মাধ্যমে বানাণো হয়েছে। আর কার্যত তার হেফাজত এভাবে হয়েছে যে, মহানবী (স) এর নিকট থেকে লোকেরা যে কুরআন লাভ করছিল তা সমসাময়িক কালে হাজারো ব্যক্তি অক্ষরে অক্ষরে মুখস্ত করে নেন, অতপর হাজার থেকে লাখ এবং লাখ থেকে কোটি কোটি মানুষ বংশ পরস্পরায় তা গ্রহণ করেছে এবং মুখস্ত করে আসছে। এমনকি কুরআনের কোন শব্দ দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অথবা কখনও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হওয়া এবং সাথে সাথে তা দৃষ্টিতে না পড়া সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে গেছে। হেফাজতের এই অসাধারণ ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত দুনিয়ার অন্য কোন পুস্তকের জন্য সম্ভবপর হয়নি এবং তা প্রমাণ করে যে, এটা আল্লাহ তাআলার পর্কিল্পিত ব্যবস্থা।

আচ্ছা এখন নিরীক্ষণ করে দেখুন যে, সর্বকালের জন্য যে রসূলকে গোটা দুনিয়াবাসীর রসূল বানানো হয়েছিল এবং যার পরে নবূওয়াতরে দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার জীবনের কর্মকান্ডের হেফাজতের ব্যবস্থা আল্লাহ তাআলা এমনভাবে করেছেন যে, মানব জাতির ইতিহাসে আজ পর্যন্ত বিগত কোন নবী, কোন পথপ্রদর্শক, নেতা, পরিচালক, বাদশাহ অথবা বিজয়ী বীরের ইতিহাস এভাবে সংরক্ষিত নেই। এই হেফাজতের ব্যবস্থাও সেইসব উপায়-উপকরণের সাহায্যে করা হয়েছে যে সবের মাধ্যমে কুরআনের হেফাজতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির ঘোষণার অর্থ স্বয়ং এই যে, আল্লাহ তাআলা তার নিযুক্ত সর্বশেষ রসূলের পথপ্রদর্শন এবং তার পদাংক কিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত রাখার যিম্মাদারী নিয়ে নিয়েছেন, যাতে তার জীবন সর্বকালে মানব জাতিকে পথপ্রদর্শন করতে পারে এবং তার পরে কোন নতুন নবীর আগমনের প্রয়োজনীয়তা অবশিষ্ট না থাকে। এখন আপনি নিজেই দেখে নিন যে আল্লাহ তাআলা বাস্তবিকই পৃথিবীর পরতে পরতে এই পদচিহ্ন কিভাবে মজবুত করে দিয়েছেন যে,আজ কোন শক্তি তা বিলীন করতে সক্ষম নন।

আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না, এই যে উযূ, পাঁচ ওয়াক্তের এই নামায, এই আযান, জামাআত সহকারে মসজিদের এই নামায, ঈদের নামায, হজ্জের অনুষ্ঠান, ঈদুল আযহার কুরবানী, যাকাত, খাতনা, বিবাহ ও তালাক, উত্তরাধিকারের নীতিমালা, হালাল-হারামের নিয়মকানুন এবং ইসলামী তাহযীব-তমদ্দুনের আরও অসংখ্য মূলনীতি ও পন্থা-পদ্ধতির যে দিন মহানবী (স) সূচনা করলেন সেদিন থেকে তা মুসলিম সমাজে ঠিক সেভাবে প্রচলিত হল যেভাবে কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ মানুষের মুখে আবৃত্ত হচ্ছে। অতপর হাজার থেকে লাখ এবং লাখ থেকে কোটি কোটি মুসলমান পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকায় বংশ পরষ্পরায় ঠিক সেইভাবে তার অনুসরণ করে আসছে যেভাবে তার বংশ পরষ্পরায় কুরআন বহন করে আসছে। আমাদের সংস্কৃতির বুনিয়াদী কাঠামো রাসূলে পাকের যেসব সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত তা সঠিক ও যথার্থ হওয়ার প্রমাণ হুবহু তাই-যা কুরআন পাকের সংরক্ষিত থাকার প্রমাণ হিসাবে গণ্য। এটাকে যে ব্যক্তি চ্যলেজ্ঞ করে সে মূলত কুরআনকে চ্যালেজ্ঞ করার পথ ইসলামের দুশমনদের দেখিয়ে দেয়।

পুনরায় দেখুন যে, রসূলুল্লাহ (স) এর জীবনাচার এবং তার যুগের সমাজের কেমন বিস্তারিত নকশা, কেমন খুটিনাটি বর্ণনা সহকারে, কেমন নির্ভরযোগ্য রেকর্ডের আকারে আজ আমরা পাচ্ছি। এক একটি ঘটনা এবং প্রতিটি কথা ও কাজের সনদ (বর্ণনা পরস্পরা) বর্তমান রয়েছে যা যাচাই করে যে কোন সময় জানা যেতে পরে যে, বর্ননা হাদীস কতটা নির্ভরযোগ্য? শুধুমাত্র এক ব্যক্তির অবস্থা অবহিত হওয়ার জন্য সেই যুগের প্রায় ছয় লাখ লোকের অবস্থা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যার ফলে কোন ব্যক্তি এই মহা মানবের নামে কোন কথা বর্ণনা করেছেন তার ব্যক্তিত্ব বিচার-বিশ্লেষণ করে রায় কায়েম করা যেতে পারে যে, আমরা তার বর্ণনার উপর কতটা নির্ভর করতে পারি। ঐতিহাসিক সমালোচনার একটি ব্যাপক বিষয় একান্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টি সহকারে শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হলো যে, এই অনুপম ব্যক্তিত্বের সাথে যে কথাই সংশ্লিষ্ট হবে তা যে কোন দিক থেকে পর্যালোচনা করে যেন তার যথার্থতা সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়া যায়। পৃথিবীর গোটা ইতিহাসে এমন আর কোন দৃষ্টান্ত আছে কি যে, কোন ব্যক্তির সার্বিক অবস্থার সংরক্ষণের জর‌্য মানবীয় হাতের সাহায্যে এইরূপ চেষ্টা বাস্তব রূপ লাভ করেছে? যদি না পাওয়া যায় এবং পাওয়া যাবেও না, তবে তা কি এ কথার সুস্পষ্ট প্রমাণ নয় যে, এই চেষ্টার পেছনেও সেই মহান আল্লাহর অভিসন্ধি কার্যকর রয়েছে যা কুরআন পাকের হেফাজতের জন্য কার্যকর রয়েছে?

ওহী বলতে কি বুঝায়?

আপনার চতুর্থ প্রশ্ন এই যে “কুরআনের কোন স্থানে আরবী শব্দের পরিবর্তে একই অর্থ প্রকাশক ভিন্ন শব্দ স্থাপন করলে তাকে কি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত মনে করা হবে? ওহীর উল্লেখিত দ্বিতীয় অংশের অবস্থাও কি তাই?

এটা আপনি এমন একটা অর্থহীন প্রশ্ন করেছেন যে, আমি কোন শিক্ষিত লোকের নিকট থেকে এরূপ প্রশ্নের আশা করতাম না। শেষ পর্যন্ত আপনাকে কে বলেছে যে, রসূলুল্লাহ (স) কুরআন পাকের ভাষ্যকার এই অর্থে যে, তিনি তাফসীরে বায়দাবী অথবা জালালাইনের মত কোন তাফসীর লিখেছিলেন, যার মধ্যে কুরআনের আরবী শব্দসমূহের ব্যাখ্যায় সমার্থবোধক কতিপয় আরবী শব্দ লিখে দিয়েছিলেন এবং এই ব্যাখ্যামূলক অংশকে এখন কোন ব্যক্তি “আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত ওহী” বলছে? যে কথা আপনাকে পুনপুন বলা হচ্ছে তা এই যে, রসূলুল্লাহ (স) পয়গাম্বর হিসাবে যা কিছুই করেছেন এবং বলেছেন তা ওহীর ভিত্তিতেই। তার গোটা নবুওয়াতী কার্যক্রম তিনি ব্যক্তি হিসাবে করেননি, বরং আল্লাহর নিযুক্ত প্রতিনিধি হিসাবে যা কিছুই করেছেন এবং বলেছেন তা ওহীর ভিত্তিতেই। তার গোটা নবুওয়াতী কার্যক্রম তিনি ব্যক্তি হিসাবে করেননি, বরং আল্লাহর মর্জির বিরুদ্ধে অথবা তার ইচ্ছা ছাড়া করতে পারেন না। একজন, শিক্ষক, মুরব্বী, নৈতিক সংস্কারক, সভ্যতা-সংস্কৃতির নির্মাতা,বিচারক, আইনপ্রণেতা, পরামর্শদাতা, সেনাপতি এবং একজন রাষ্টনায়ক হিসাবে তিনি যত কাজই করেছেন তার সবই মূলতঃআল্লাহর রসূল হিসাবে তাঁর কাজ ছিল। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর ওহী তার পথপ্রদর্শন ও তত্ত্বাবধান করত। কোথাও সামান্যতম ক্রটি-বিচ্যুতি হওয়া গেলে আল্লাহর ওহী যথা সময়ে তার সংশোধন করে দিত। এই ওহীকে আপনি যদি এ অর্থে গ্রহণ করেন যে, কুরআনের শব্দাবলীর ব্যাখ্যায় আরবী ভাষার কতিপয় সমার্থবোধক শব্দ নাযিল হয়ে যেত তবে আমি এছাড়া আর কি বলতে পারি যে-    “বুদ্ধিজ্ঞানের বহর যাদের এই তাদের থেকে দুরে থাকা বাঞ্চনীয়।”

আপনার জানা উচিত যে, ওহী অপরিহার্যরূপে কেবল শব্দসমষ্টির আকারেই আসৎ না, তা একটি ধারণার আকারেও হতে পারে যা অন্তরে ঢেলে দেয়া হয়। তা মনমগজ ও চিন্তার জন্য পথ নির্দেশনার আকারে হতে পারে। তা কোন একটি বিষয়ের সঠিক বোধশক্তির আকারে, কোন সমস্যার যথার্থ সমাধানের আকারে অথবা কোন অবস্থা বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের যথোপযুক্ত কৌশল হৃদয়ঙ্গম করানোর আকারেও হতে পারে। তা শুধুমাত্র একটি আলোকবর্তিকাও হতে পারে যার সাহায্যে কোন ব্যক্তি তার সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যেতে পারে। তা একটি সত্য স্বপ্নও হতে পারে। তা পর্দার আড়াল থেকে একটি আওয়াজ অথবা ফেরেশতার মাধ্যমে আগত একটি বার্তাও হতে পারে। আরবী ভাষায় “ওহী” শব্দের অর্থ “সুক্ষ্মইংগিত”। ইংরেজী ভাষায় এর কাছাকাছি শব্দ হলো Revelation. আপনি যদি আরবী না জানেন তবে ইংরেজী ভাষারই কোন অভধানে উপরোক্ত শব্দের অর্থ দেখে নিন। এরপর আপনি নিজেই জানতে পারবেন যে, কোন শব্দের পরিবর্তে তদস্থলে সমার্থবোধক শব্দ স্থাপন করার এই অদ্ভুত ধারণা-যাকে আপনি ওহীর অর্থে গ্রহণ করেছেন কতটা শিশু সুলভ ধারণা!

আপনার পঞ্চম প্রশ্ন এই যে, “কোন কোন লোক বলে যে, মহানবী (স) নবুওয়াত লাভের পর থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত  যা কিছু করেছেন তা ছিল আল্লাহর পক্ষথেকে প্রাপ্ত ওহী আপনি কি তাদের সাথে একমত? যদি একমত না হন তবে এক্ষেত্রে আপনার আকীদা-বিশ্বাস কি?

এই প্রশ্নের উত্তর চার নম্বর প্রশ্নের উত্তরে এসে গেছে এবং উপরে আমি যে আকীদা বর্ণনা করেছি তা “কোন কোন লোকের” নয়, বরং ইসলামের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আকীদা।

প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি মাত্র

আপনার ষষ্ঠ প্রশ্ন হলো, “আপনি যদি মনে করেন মহানবী (স) এর কতিপয় বাণী ওহীর সমষ্টি এবং কতিপয় বাণী ওহী ছিল না তবে আপনি কি বলবেন যে, মহানবী (স) এর যেসব বাণী ওহী ছিল তার সংকলন কোথায় আছে? অনন্তর তার যেসব বাণী ওহী ছিল না, মুসলমানদের ঈমান ও আগত্যের বিচারে তার মর্যাদা কি?

উপরোক্ত প্রশ্নের প্রথম অংশে আপনি আপনার তিন নম্বর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং এর জওয়াবও তাই যা উপরে ঐ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে আপনি আপনার দুই নম্বর চিঠিতে যে কথা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং আমি তার জওয়াবও দিয়েছি। সন্দেহ হচ্ছে, আপনি আমার উত্তরসমূহ মনোনিবেশ সহকারে পড়েনও না এবং একই ধরনের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছেন।

ঈমান ও কুফরের মাপকাঠি

আপনার সপ্তম প্রশ্ন এই যে, “কোন ব্যক্তি যদি কুরআন পাকের কোন আয়াত সম্পর্কে বলে, “তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত নয়” তবে আপনি কি একমত হবেন যে, সে ইসলামের গন্ডী থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাবে? যদি কোন ব্যক্তি হাদীসের বর্তমান সংগ্রসমূহের কোন হাদীস সম্পর্কে বলে যে, তা আলাহর ওহী নয় তবে সেও কি ইসলামের গন্ডি থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে?”

উপরোক্ত প্রশ্নের জওয়াব এই যে, হাদীসের বর্তমান সংগ্রহসমূহ থেকে যেসব সুন্নাতের সাক্ষ্য পাওয়া তা দুইটি বৃহত ভাগে বিভক্ত। এক প্রকারের সুন্নাত হলো, উম্মাত শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেগুলোর সুন্নাত হওয়ার ব্যাপরে একমত পোষণ করে আসছে, অর্থাৎ অন্য কথায় তা মুতাওয়াতির (ধারাবহিকভাবে প্রাপ্ত ) সুন্নাতসমূহ এবং তার উপর উম্মাতের উজমা (ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে কোনটি মানতে যে ব্যক্তিই অস্বীকার করবে সে ঠিক সেভাবে ইসলামের গন্ডি থেকে বহিষ্কার হয়ে যাবে যেমন কুরআনোর কোন আয়াত অস্বীকারকারী ইসলামের গন্ডি  থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রকারের সুন্নাতহ হল যেগুলো সম্পর্ক মতভেদ আছে, অথবা মতভেদ হতে পরে। এই প্রকারের সুন্নাতের মধ্যে থেকে কোনটি সম্পর্কে যদি কোন ব্যক্তি বরে যে, তার সার্বিক পর্যালোচনা অনুযায়ী অমুক সুন্নাতটি প্রমাণিত নয়, তাই আমি তা গ্রহণ করছি না, তবে এই কথায় তার ঈমানের কোন ক্ষতি হবে না। ইলমী দিক থেকে তার অভিমত আমাদের সঠিক অথবা ভ্রান্ত মনে করাটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। কিন্তু সে যদি যে, তা বাস্তবিকই রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত হলেও আমি তার অনুগত্য করাতে প্রস্তুত নই, তবে তার ইসলামের গন্ডি থেকে বিচ্যুত হওয়ার ব্যাপরে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কারণ সে রসূলূল্লাহ (স) এর কর্তৃত্ব (Authority) কে চ্যালেঞ্জ করছে, যার সুযোগ ইসলামের গন্ডিতে নাই।

সুন্নাতের বিধানের কি পরিবর্তন হতে পারে?

আপনার আট নম্বর এই যে, “রসূলুল্লাহ (স) দীন ইসলামের বিধানসমূহ কার্যকর করার জন্য যেসব পন্থার প্রস্তাব করেছেন, কোন যুগের চাহিদা ও সার্বিক কল্যাণের বিবেচনায় তার আংশিক পরিবর্তন বা প্রত্যাখ্যান করা যায় কি না? কুরআনের বিধানের ক্ষেত্রেও এরুপ আংশিক পরিবর্তন বা প্রত্যাখ্যান করা যায় কি না?

উপরোক্ত প্রশ্নের জওয়াব এই যে, কুরআনিক বিধানের আংশবিশেষ, উভয় ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সেই অবস্থায় এবং সেই সীমা পর্যন্ত পরিবর্তন হতে পারে যখন এবং যে সীমা পর্যন্ত বিধানের মূল পাঠ কোন পরিবর্তনের সুযোগ দেয়, অথবা এমন অন্য কোন নস (কুরআনের আয়াত ও প্রমাণিত সুন্নাত) পাওয়া যায় যা কোন বিশেষ অবস্থার পেক্ষিতে কোন বিশেষ ধরনের বিধানে পরিবর্তন সাধনের অনুমতি দেয়। এছাড়া কোন মুমিন ব্যক্তি নিজেকে কোন অবস্থায়ই আল্লাহ ও তার রসূলের বিধানে পরিবর্তন সাধনের অধিকারী বা উপযুক্ত বলে চিন্তাও করতে পারে না। অবশ্য যেসব লোক ইসলাম থেকে বহিষ্কার হয়েও মুসলমান থাকতে চায় তাদের কথা স্বতন্ত্র। তাদের কর্মপন্থা হলো, প্রথমে তারা আল্লাহর রসূল (স) কে আইন-কানুন থেকে বেদখল করে “মুহাম্মদ বিহীন কুরআন” অনুসরণের অদ্ভুত মতবাদ আবিষ্কার করে, অতপর কুরআন থেকে গা বাচানোর জন্য তার এমন পছন্দসই ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করে যা দেখে ইবলীস শয়তানও তাদের পরাকাষ্ঠার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

বিনীত

আবুল আ‘লা

অভিযোগ ও জবাব

[পূর্বোক্ত পত্রালাপের পর ড: আবদুল ওয়াদূদ সাহেবের যে দীর্ঘ চিঠি হস্তগত হয়েছিল তা তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় ‘মানসাবে রিসালাত’ সংখ্যায় ছাপানো হয়েছে। এই সুদীর্ঘ পত্রের এখানে পুনরুক্তি সম্পূর্ন নিষ্প্রোয়জন যা অনেক অনর্থক কথায় পরিপূর্ণ। তাই সর্বসাধারণের সুবিধার জন্য পত্রলেখকের অপ্রাসংগিক বক্তব্যগুলো পরিহার করে শুধুমাত্র তহার আপত্তিসমূহ এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাচ্ছে এবং সাথে সাথে প্রতিটি অভিযোগের জওয়াবও দেয়া হচ্ছে, যাতে পাঠকগণ হাদীস অস্বীকারকারীদের অস্ত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে সৎর্ক হয়ে যান এবং সাথে সাথে জানতে পারেন যে, তাদের অস্ত্র কতই না দুর্বল।]

১. বাযমে তুলূ-ই ইসলাম পত্রিকার সাথে সম্পর্ক

অভিযোগঃ“আপনি পত্রালাপের সূচনায় আমাকে ‘বাযমে তুলূ-ই ইসলাম পত্রিকার অন্যতম সদস্য বলেছেন। এ সম্পর্কে আমি তার প্রাথমিক অথবা সাধারণ সদস্যও নই এবং জোর দিয়ে বলেছিলাম যে, আপনি আমার একথা পত্রিকায় ছেপে দিন। কিন্তু আপনি তা ছাপেননি,বরং ছাপানো চিঠিতে এর প্রতি সামান্য ইংগিতও করেননি। অথচ সৎতা ও সুবিচারের দাবী অনুযায়ী আপনার ভুল স্বীকার কারা এবং অক্ষমতা প্রকাশ করা উচিত ছিল’’।

উত্তরঃডকটর সাহেবের এই আপত্তির জওয়াব স্বয়ং তুলূ-ই ইসলাম এর পাতায় অন্য কারো মুখে নয়, বরং পারভেয সাহেবের মুখ থেকে শুনাই অধিক উত্তম। ১৯৯০ সনের ৮, ৯ ও ১০ এপ্রিল লাহোরে তুলূ-ই ইসলাম কনোনেশনের চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে ডকটর আবদুল ওয়াদূদ সাহেবের ভাষণের পূর্বে পারভেয সাহেব তার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন:

“ডকটর সাহেবের বন্ধুত্ব আমাদের জন্য গৌরবের বিষয় এবং আমাদের উপর তার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এই যে তিনি আমার কুরআনের দরস ও ইতিহাসের ক্লসের প্রতিটি ভাষণের এক একটি শব্দ লেখার আওতায় নিয়ে এসেছেন। একাজ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য যা তিনি এতটা আনন্দের সাথে সম্পাদন করে যাচ্ছেন”-(তুলূ-ই ইসলাম, মে-জুন সংখ্যা, ১৯৬০খৃ.পৃ.২৫)।

এখন যদি ডকটর সাহেব বলেন যে, তিনি বাযমে তুলু-ই ইসলামের প্রাথমিক সদস্যও নান তবে তা গান্ধীজির অনুরূপ কথাই হবে। কারণ তিনি বলতেন, আমি কংগ্রেসের চার আনার সদস্যও নই। তুলু-ই ইসলামের প্রচারণা সম্পর্কে অবহিত যে কোন ব্যক্তিই এই পত্রালাপ পাঠ করে দেখতে পারেন যে, ডকটর সাহেবের মুখ দিয়ে স্বয়ং তুলু-ই ইসলাম কথা বলছে না অন্য কেউ?

২. দুর্মুখ প্রশ্নমালার উদ্দেশ্য কি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান ছিল?

অভিযোগঃআপনি লিছেছেন, “আপনি এই পত্রালাপ বাস্তবিকই যদি কথা বুঝার উদ্দেশ্য করে থাকতেন তবে সোজা কথা সহজভাবে আপনার বুঝে এসে যেত। কিন্তু আপনার পরিকল্পনাই তো ছিল ভিন্ন কিছু। আপনি আপনার প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশ্নবলী আমর নিকট পাঠানোর সাথে সাথে তা অপর কতিপয় আলেমের নিকটও এই আশায় পাঠিয়েছিলেন যে, তাদের নিকট থেকে ভিন্ন রকম উত্তর পাওয়া যাবে। অতপর এসব উত্তর পত্রস্থ করে অপপ্রচার করা যাবে যে, সুন্নাতের সম্পর্কে ঐক্যমত পাওয়া যায় না”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৬০ খৃ.)।

আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি যে, আপনি আমার এই পরিকল্পনা সম্পর্কে কিভাবে জ্ঞাত হলেন? আপনি যে উদ্দেশ্য আমার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তাই যে আমার উদ্দেশ্য এর সপক্ষে আপনার নিকট কোন প্রমাণ আছে কি?

উত্তর:মানুষের অন্তরের নিয়াত সম্পর্কে তো একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে অবহিত হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য মানুষ যেসব জিনিসের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির নিয়াত (উদ্দেশ্য) সম্পর্কে আন্দাজ-অনুমান করে থাকে তা হচ্ছে, তার কার্যকলাপ এবং যেসব লোকের সাথে একত্রিত হয়ে সে কাজ করে তাদের সামগ্রিক কার্যকলাপ। ডকটর সাহেব হাদীস-বিরোধী লোকদের যে দলের সাহায্য সহযোগিতা করছেন তারা আপাদমস্তক সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, হাদীস একটি সংশয়পূর্ণ ও বিতর্কিত জিনিস। এই উদ্দেশ্য তাদের পক্ষ থেকে যে ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তার সাক্ষী প্রমাণ তুলূ-ই ইসলামের পৃষ্ঠাগুলো এবং এই সংস্থার পক্ষ থেকে প্রকাশিত পুস্তকাদি এসব কাজ দেখে খুব কষ্টেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে, সেই দলেরই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ডকটর আবদুল ওয়াদূদ সাহেবের পক্ষ থেকে উলাময়ে কিরামগণের নামে যে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়েছিল তা আকৃত্রিভাবই বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণের জন্যই ছিল।

৩. রসূলুল্লাহ (স) এর ব্যক্তিসত্তা ও নববী সত্তা

অভিযোগঃ“আপনার তাফহীমাত গন্থে আপনি বলেছিলেন যে, কুরআন মজীদের কোথাও সামান্যতম অস্পষ্ট ইংগিতও পাওয়া যায় না যার ভিত্তিতে মহানবী (স) এর ব্যক্তি সত্তা ও নববী সত্তার মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়েছে। অথচ এখন আপনি বলেছেন, মহানবী (স) রসূল হিসাবে যা কিছু করেছেন তা সুন্নাত এবং অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয়। আর যা কিছু তিনি ব্যক্তি হিসাবে করেছেন তা সুন্নাত নয় এবং অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয় নয়। এভাবে আপনি দুইটি বিপরীতধর্মী কথা বলেছেন।”

উত্তর: উক্ত পত্রালাপ চলাকালে ডকটর সাহেব এই বিষয়টি প্রথম উত্থাপন করেন এবং তাকে এর জওয়াবও দেয়া হয়েছে? আমি তার নিকট আবেদন করেছিলাম যে, তিনি যদি বিষয়টি হৃদয়ংগম করতে চান তবে আমার “রসূলুল্লাহ (স) এর ব্যক্তিসত্তা ও নাববী সত্ত” শীর্ষক প্রবন্ধ তরজমানুল কুরআন পত্রিকার ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় পড়ে নিন। তাতে বিস্তারিতভাবে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে ডকটর সাহেব তা পাঠ করার কষ্ট স্বীকার করেননি। যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে হাদীস প্রত্যাখ্যনকারীরা বিভিন্ন পন্থায় লোকদের মনমগজে ভ্রান্ত ধারণার বীজ বপন করার চেষ্টায় রত আছে তার মধ্যে এই বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই এখানে বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে।

এতে কোন সন্দেহ নাই যে, আল্লাহ তাআলা রসূলুল্লাহ (স) এর আনুগত্য করার যে নির্দেশ দিয়েছেন  তা তার কোনো ব্যক্তিগত অধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং তার ভিত্তি এই যে, তিনি তাঁকে তার রসূল বানিয়েছেন। এই দিক থেকে একটি মতাদর্শ হিসাবে তার ব্যক্তি মর্যাদা ও নববী মর্যাদা ও মধ্যে নিশ্চিতই পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু যেহেতু একই সত্তার মধ্যে কার্যত ব্যক্তি মর্যাদা ও নববী মর্যাদার সম্মিলন ঘটেছে এবং আমাদেরকে তার আনুগত্যের সাধারণ নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তই আমরা স্বয়ং এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী নই যে, আমরা মহানবী (স) এর অমুক কথা মানব, কারণ তিনি রসূল হিসাবে তা করেছেন বা বলেছেন এবং অমুক কথা মানব না, কারণ এর সম্পর্ক রয়েছে তাঁর ব্যক্তিসত্তার সাথে। এটা রসূলুল্লাহ (স) এর কাজ ছিল। ব্যক্তিগত ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি লোকদের কেবল স্বাদীনতাই প্রদান করেননি,  বরং স্বাধীন মত প্রদানের প্রশিক্ষণও দিতেন এবং রিসালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি তাদের বিনা বাক্য ব্যয়ে আনুগত্য করাতেন। এক্ষেত্রে আমাদের যতটুকু স্বাধীনতা রয়েছে তা রসূলুল্লাহ (স) কর্তৃক পদত্ত, যার মূলনীতি ও সীমা রসূলুল্লাহ (স) নিজিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটা আমাদের একচ্ছত্র স্বাধীনতা নয়। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আমি এ প্রসংঙ্গে বলেছিলাম:

যেগুলো স্পষ্টতই ব্যক্তিগত বিষয়,যেমন এক ব্যক্তির পানারহার,পোশাক পরিধান, বিাবহ, পুত্র-পরিজনের সাথে বসবাস, সাংসারিক কাজকর্ম সম্পাদন, গোসল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন, পায়খানা-পেশাব ইত্যাদি সব কাজও মহানবী (স) এর জীবনে একান্তই ব্যক্তিগত পর্যায়ভুক্ত নয়, বরং তার মধ্যেও শরীআতের সীমা ও পন্থা এবং নিয়ম-কানূনের শিক্ষাও শামিল রয়েছে।….. যেমন মহানবী (স) এর পোশাক পরিচ্ছদ ও পানারহারে র বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করুণ। এর একটি দিক তো এই ছিল যে, তিনি একটি বিশেষ মাপকাঠির পোশাক পরিধান করতেন, যা তৎকালীন আরবে প্রচলিত ছিল এবং যা নির্বাচনে তার ব্যক্তিগত রুচিও যুক্ত ছিল। অনুরূপভাবে সমসাময়িক আরব পরিবারগুলোতে যে ধরনের খাদ্য ও পরিধানের ক্ষেত্রে তিনি নিজের কাজ ও কথার মাধ্যমে শরীআতের সীমা এবং ইসলামী শিষ্টাচারের শিক্ষা দিতেন। এখন একথা স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স) এর শিখানো শরীআতের মূলনীতি থেকে আমরা জানতে পারি যে, এর মধ্যে একটি জিনিস তার ব্যক্তিসত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং দ্বিতীয় দিকটি তার নববী সত্তার সাথে জড়িত ছিল। করণ যে শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট ছিলেন, লোকেরা কিভাবে নিজেদের পোশাক সেলাই করবে, নিজেদের খাদ্য কিভাবে রান্নাকরবে-শরীআত তা নিজ কার্যসীমার আওতাভুক্ত করেনি। অবশ্য পানাহার ও পরিধানের ক্ষেত্রে হারাম-হালাল ও জায়েয-নাজায়েযের সীমা নির্দিষ্ট করার বিষয়টি এবং ঈমানদার লোকদের নীতি- নৈতিকতা ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচার-ব্যবহার ও শিষ্টাচারের শিক্ষা শরীআত তার আওতাভুক্ত করেছে।”

এই বিষয়ের আলোচনা শেষ করতে গিয়ে আমি উপসংহারে যে কথা বলেছি তা হলো, “মহানবী (স) এর ব্যক্তিসত্তা ও নববী সত্তার মধ্যে বাস্তবিকপক্ষে যে পার্থক্যই থাক তা আল্লাহ তাআলার নিকটি এবং রসূলুল্লাহ (স) এর নিকট রয়েছে এবং আমাদেরকে এ সম্পর্কে শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্য অবহিত করা হয়েছে যে, আমরা যেন কোথাও আকীদা-বিশ্বাসের ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (স) ক্ষেত্রে যদি আমাদের কোন স্বাধীনতা থেকে ই থাকে তবে তাও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স) কতৃক প্রদত্ত হওয়ার কারণেই? এবং মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) ই তার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আর এই স্বাধীনতা প্রয়োগের প্রশিক্ষণও আমাদেরকে আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ (স) ই দিয়েছেন।

যে ব্যক্তিই হঠকারিতা মুক্ত হয়ে উপরোক্ত বক্তব্য পাঠ করবে সে নিজেই সিদ্ধন্তে পৌছুতে সক্ষম হবে যে, হাদীস অস্বীকরকারীরা যে জটিলতায় ভুগছে তার আসল কারণ কি আমার বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে না তাদের মনমগজে?